X
সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
১৫ আষাঢ় ১৪৩২

সাকিবের ‘হারজিৎ চিরদিন থাকবে’

জনি হক
১২ আগস্ট ২০২২, ২১:১৮আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২২, ১৩:১৯

সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেট নামক ক্লাসের ফার্স্ট বয়। তার নিন্দুকেরাও এটা মানবেন জানি। আদতে তিনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, পুরো ক্লাসরুমই তার সমার্থক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের মেধা ও বুদ্ধিমত্তার মেলবন্ধন সতীর্থদের কাছে ক্লাসরুমের মতোই, যেসব দেখে নবীন ক্রিকেটাররা প্রতিনিয়ত শেখেন।

ক্লাসের ফার্স্ট বয় যদি বিতর্কিত কিছু করে বসেন তাহলে চারপাশ সরগরম হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। সাকিবকে কেন্দ্র করে তাই আবারও উত্তপ্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট। আসন্ন এশিয়া কাপে যেখানে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনার হাওয়া বইছিল, উল্টো দলেই তার থাকা নিয়ে পরে সংশয় দেখা দিলো। বেটউইনার নিউজ নামের একটি অনলাইন পোর্টালের শুভেচ্ছাদূত হওয়ায় সব ধরনের ক্রিকেট থেকে তার বাদ পড়ার শঙ্কা তৈরি হলো। তাকে পাওয়া না পাওয়ার দোলাচল থাকায় এখনও অনিশ্চয়তার সুতায় ঝুলছে এশিয়ার কাপের দল ঘোষণা।

কড়া অবস্থান নিয়ে বিসিবি হুঁশিয়ারি দেয়, জুয়ার প্রচারে কাজ করা এবং বাজি নির্ভর প্রতিষ্ঠান বেটউইনারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল না করলে কোনও ধরনের ক্রিকেটে থাকতে পারবেন না সাকিব। ফলে কয়েকদিন ধরে জলঘোলা হলো। গতকাল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, সাকিবকে যেকোনও একটা বেছে নিতে হবে। দেশ নাকি টাকা, বেটিং নাকি ব্যাটিং-বোলিং– কোনটা বেছে নেবেন সাকিব? প্রশ্নটা হয়ে দাঁড়ায় কোটি টাকার! তাও ১০ কোটি টাকার কাছাকাছি দামের মূল্যবান প্রশ্ন। বেটউইনার নিউজের সঙ্গে এত বিশাল অঙ্কে সাকিব চুক্তি করেছেন বলে গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে।

শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ে কে জিতবে, কে হারবে সেটাই ছিল দেখার। সাকিব নাকি বিসিবি? তবে সব বিতর্কের অবসান ঘটলো। গত ২ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেটউইনারের জার্সি পরা ছবি প্রকাশ করে যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন সাকিব, শেষমেষ তিনি নিজেই তাতে জল ঢেলে দিয়েছেন। বেটউইনার নিউজের সঙ্গে বিতর্কিত চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিশ্বসেরা এই ওয়ানডে অলরাউন্ডার। ফলে বিসিবি আপাতত স্বস্তিতে।

সাকিবের এবারের বিতর্কে মোহাম্মদ আশরাফুলের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এর কারণও আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম পোস্টার বয় ছিলেন আশরাফুল। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রানের তালিকায় তিনি এখনও শীর্ষ পাঁচে। ১৭৫ ওডিআই খেলে তার মোট রান ৩ হাজার ৪৬৮। তালিকায় আশরাফুলের ওপরে আছেন তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ। তারা সবাই দুই শতাধিক ওয়ানডে খেলেছেন।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএলে) ম্যাচ পাতানোর সঙ্গে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দেওয়ায় নিষিদ্ধ হন আশরাফুল। বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিল সেই ঘটনা। তবে ২০১৯ সালের অক্টোবরে জুয়াড়িদের প্রস্তাব গোপন করায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে সাকিবের একবছরের নিষেধাজ্ঞা ছাপিয়ে যায় আশরাফুলের কলঙ্কিত অধ্যায়। স্বাভাবিকভাবে ক্রিকেট বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দেয় এই ঘটনা। কারণ এমন একের ভেতর দুই প্রতিভা থাকা ক্রিকেটার বাংলাদেশের ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। সাকিব থাকলে একজন ব্যাটার ও একজন বোলার বাড়তি পাওয়া যায় দলে। ২০০৬ সালের ৬ আগস্ট অভিষেকের পর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ক্যানভাস আপন মনে রাঙিয়েছেন তিনি।

এশিয়া কাপ এবার হবে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সাকিব এমন কিছু রেকর্ড গড়েছেন যা বিশ্বের আর কারও নেই। টি-টোয়েন্টিতে কেবল তিনিই ২ হাজার রান ও ১২১ উইকেটের মালিক। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ৪০ উইকেট শিকারী তিনিই। তার বিকল্প সত্যিই নেই। এজন্য কিছুটা অতৃপ্তিও আছে, কারণ গত সাত-আট বছর ধরে তাকে কি সেভাবে দলে পাওয়া গেছে?

কারণ বিতর্ক ও সাকিব যেন একসুতোয় গাঁথা। বর্ণিল ক্যারিয়ারের বাঁকে বাঁকে অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি। ২০১৩ সালে অটোগ্রাফ চাওয়ায় এক দর্শকের কলার চেপে ধরেন। ২০১৪ সালে টিভি ক্যামেরায় অশালীন ভঙ্গি দেখিয়ে সমালোচিত ও তিন ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন। একই বছর স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করায় গ্যালারিতে গিয়ে এক দর্শককে পিটিয়েছেন। ২০১৪ সালেই বিসিবির অনাপত্তিপত্র না নিয়ে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলতে যান। ২০১৫ সালে বিপিএলে আম্পায়ারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করায় এক ম্যাচ নিষিদ্ধ হন। আরেকবার ঘরোয়া ক্রিকেটে ম্যাচ চলাকালে আম্পায়ারের ওপর ক্ষোভ দেখিয়ে স্টাম্পে লাথি দেন এবং তর্কে জড়িয়ে স্টাম্প উপড়ে ফেলেন।

ছুটি চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কিছুদিন পরপরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন সাকিব। অবশ্য ৩৫ বছরে এসে তার এই চাওয়া অযৌক্তিক নয় মোটেই। ভুলে গেলে চলবে না তার পরিবার থাকে আমেরিকায়। নিউজিল্যান্ডের পেস অ্যাটাকের অন্যতম ভরসা ট্রেন্ট বোল্ট তো পরিবারের জন্য কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকেই বেরিয়ে এসেছেন। বিশ্বের প্রথম সারির অনেক ক্রিকেটারই ছুটি চেয়ে নেন। বিভিন্ন দেশের বোর্ডও সিনিয়রদের কিছুটা বিশ্রাম দিয়ে থাকে। সাকিব কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে সরে যাননি। নিজের প্রয়োজনীয়তা বুঝে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ থেকেই কেবল নিজেকে সরিয়ে রাখেন। এতে দোষের কিছু আছে বলে মনে হয় না।

ছোটখাটো আরও কিছু ঘটনা আছে। সেসব আর না বলি। বিতর্কিত অধ্যায়ে সবশেষ সংযোজন বেটউইনার নিউজের সঙ্গে চুক্তি। জুয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত সবকিছুর বেলায় জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলে বিসিবি। বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতি অনুযায়ী, কোনও বেটিং ব্র্যান্ড বা তাদের সারোগেট ব্র্যান্ডের সঙ্গে বিসিবি বা বিসিবি সংশ্লিষ্ট কারও কোনও ধরনের সম্পর্ক থাকতে পারবে না। জুয়াড়িদের সঙ্গে সখ্য থাকলে কিংবা তাদের তথ্য গোপন রাখলে আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী ও নিরাপত্তা ইউনিট (আকসু) ক্রিকেটারদের শাস্তি দেয়। সবই ঠিকাছে। কিন্তু প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক, আইসিসি স্বীকৃত ম্যাচে কীভাবে জুয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান স্পন্সর হিসেবে থাকে? জিম্বাবুয়ের সঙ্গে সদ্য সমাপ্ত সিরিজে জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠান ডাফাবেট স্পন্সর ছিল। বেটওয়ে এবং বেট থ্রি সিক্সটি ফাইভকে তো বিভিন্ন সিরিজে হরহামেশা স্পন্সর হিসেবে দেখা যায়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট বোর্ড কিংবা অন্য দেশের ক্রিকেট বোর্ড এসব সিরিজ আয়োজন করেছে, কিন্তু আইসিসির নীতির সঙ্গে কি ব্যাপারটা সাংঘর্ষিক নয়? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব ম্যাচকে স্বীকৃতি দিয়ে পরোক্ষভাবে হলেও তো জুয়াকে সমর্থন দিচ্ছে। গোড়াতেই তো গলদ! নাকি?

ফেসবুক ও ইউটিউবে ‘বাংলা ট্রিবিউন প্রেস বক্স’ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে গিয়ে সমর্থকদের মন্তব্য দেখার সুযোগ হয় আমার। বেটউইনার ইস্যুতেও দেখলাম–  বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রাণভোমরা সাকিবের পক্ষে জনমতের জোয়ার উঠেছে। এমনিতেই বাংলাদেশের ক্রিকেট আর আবেগ হাত ধরাধরি করে চলে।

এটা সত্যি যে, বেটউইনার নিউজ সরাসরি জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠান না হলেও এর নেপথ্যে জুয়াই মুখ্য। তাই ভক্তরাও অনেকে চেয়েছেন, সাকিব এই চুক্তি থেকে সরে আসবেন। আমারও ধারণা ছিল, খামোখা একটা চুক্তির জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বাতিল হওয়ার মতো বড় ভুল তিনি করবেন না। সেটাই সত্যি হয়েছে। তবে চলমান বিতর্কটি বেটউইনারের বিপণনের মাস্টারস্ট্রোক ছিল কিনা সেই প্রশ্ন থেকে যায়। টাকা খরচ করেও কোনও প্রতিষ্ঠান এমন মিডিয়া কাভারেজ পায় কিনা তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে! বাংলাদেশের আইন সাকিব এবং বেটউইনার উভয়ের জানা ছিল এবং এর পরিণতি দুই পক্ষই অনুমান করেছিল। ফলে ধারণা করা যায়, চুক্তিটা মাঝপথেই বাতিল হওয়ার শঙ্কা মাথায় ছিল তাদের। তবে প্রত্যাশার কয়েক হাজার গুণ বেশি পেয়ে গেছে বেটউইনার!

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সাকিব। বাংলাদেশে কোনও পণ্যের প্রচারণা চালানোর জন্য তার চেয়ে বড় ব্র্যান্ড কি আছে? যেকোনও ব্র্যান্ডই সাকিবের সঙ্গে নিজেদের পণ্যের নাম জুড়ে দিতে চায়। সেজন্যই ভুরি ভুরি বিজ্ঞাপনের মডেল হওয়ার প্রস্তাব কড়া নাড়ে তার দুয়ারে। সেটা তিনি ভালোই বোঝেন। কারণ শুরুতেই বলেছি, বুদ্ধিমত্তায় অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে এই তারকা খেলোয়াড়। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন নিশ্চয়ই আরও অনেক বিজ্ঞাপনি চুক্তি হাতে নিতে চাইবেন। কারণ তিনি আরও তিন-চার বছর খেলবেন। ক্যারিয়ারের গোধূলি বেলায় এসে নিজেকে উজাড় করে দিতেই চাইবেন বাঁহাতি ব্যাটার-স্পিনার।

আশার কথা হলো, টেস্ট অধিনায়কের কাঁধেই টি-টোয়েন্টি দলের দায়িত্ব যেতে পারে। জনমত সেদিকেই। বিসিবিরও ইচ্ছে সেরকমই। তাকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া বিতর্কের প্রভাব মাঠের খেলায় খুব একটা পড়বে বলে মনে হয় না, কারণ নামটা সাকিব! তিনি এশিয়া কাপে খেলবেন এবং বাংলাদেশের হয়ে ম্যাচ জিতবেন সেই আশা করাই যায়। বেটউইনারের সঙ্গে চুক্তি করে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় তিনি যেমন জিতলেন, বেটউইনারকে জেতালেন! নেতা হিসেবে কোনও কোনও ম্যাচে হয়তো হারবেনও সাকিব। যেমন বিসিবির কাছে পরোক্ষভাবে তিনি হেরেছেন! সাকিবের এই হারজিৎ চিরদিন থাকবে। তবুও বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক: গীতিকবি; ডেপুটি নিউজ এডিটর, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিপর্যয়ের শিকার নারীরা’
‘পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিপর্যয়ের শিকার নারীরা’
ভারতবিরোধী কনটেন্ট করায় ক্রিয়েটরের বাড়িতে হামলার অভিযোগ
ভারতবিরোধী কনটেন্ট করায় ক্রিয়েটরের বাড়িতে হামলার অভিযোগ
ঢাকায় চিকিৎসায় এসে একই পরিবারের ৩ জনের রহস্যজনক মৃত্যু
ঢাকায় চিকিৎসায় এসে একই পরিবারের ৩ জনের রহস্যজনক মৃত্যু
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক