X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

জুয়েল আইচ, মাবিয়া ও ফিলিস্তিনে ভূলুণ্ঠিত মানবতা

মোস্তফা হোসেইন
২১ অক্টোবর ২০২৩, ১৬:১০আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:৩১

জাদুশিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল আইচ সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে নিউইয়র্ক গিয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে অভিনব এক দৃশ্য রচনা করলেন তিনি। রচনা করলেন না বলে, এমন বলা যায়, তাকে ঘিরে অপূর্ব এক দৃশ্য দেখলো অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকরা। ঘটনাটা এরকম, তিনি স্টেজ থেকে নামার পর মধ্যবয়সী এক মহিলা তাকে জড়িয়ে ধরেন। চোখের পানি পড়ছে মহিলার। চোখ ছল ছল শিল্পীরও। সম্পূর্ণ অচেনা এক বোন কিংবা মা সেই মহিলা। এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কারণ কী হতে পারে? জুয়েল আইচ বাংলাদেশের সন্তান, জুয়েল আইচ একজন বিখ্যাত জাদুশিল্পী সর্বোপরী তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এই দৃশ্যের ছবি দেখে মনে হচ্ছে– মহিলা জুয়েল আইচকে কোনও মানব চরিত্র মনে করেননি। জুয়েল আইচ এর মধ্যে গোটা বাংলাদেশকে দেখেছেন তিনি। তিনি নিজ মাতৃভূমিকেই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানিয়েছেন, ব্যক্তি জুয়েল আইচ সেখানে গৌণ ভূমিকা পালন করেছে।

জুয়েল আইচ তার ফেসবুক পেজে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন,তার চোখ তখন ছল ছল করছিলো। অত্যন্ত সুললিত ভাষায় বর্ণনা ছিল। যারা জুয়েল আইচের লেখা সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা স্বীকার করেন, জাদুশিল্পী কিংবা বংশীবাদক জুয়েল আইচের শব্দচয়নেও জাদুর ছোঁয়া থাকে। 

এই কান্নাজড়িত ভালোবাসার ছবি দেখে বিশেষ করে জুয়েল আইচের জাদুকরীয় ভাষার ব্যবহার দেখে আমিও ক্ষণিকের জন্য ওই মহিলার মতো আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম। সত্যিই আমার বাংলাদেশ, জুয়েল আইচের বাংলাদেশ একজন মুক্তিযোদ্ধার বাংলাদেশ। আমিও যে এর গর্বিত অংশীদার। জুয়েল আইচকে এবং তাঁর মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমি সালাম জানাই, ভালোবাসা জানাই। 

জুয়েল আইচকে কান্নায় সম্মান জানানোর মতো আরেকটি কান্নার কথা সবারই জানা। ২০১৬ সালে ভারতের শিলং-গুয়াহাটিতে  এসএ গেমসের দ্বাদশ আসরে ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় প্রথম সোনার পদক জয়ী মাবিয়ার কান্না সারাদেশকে আনন্দের কান্নায় ভাসিয়ে দিয়েছিলো। ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে ১৪৯ কেজি তুলেছিলেন মাবিয়া। সবারই মনে থাকার কথা আমাদের এই নারী ক্রীড়াবিদ পুরস্কার গ্রহণকালে যখন জাতীয় সংগীত বেজে ওঠে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। মনে আছে কি সেই কান্নার কথা? পরদিন বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো সেই মেয়ের কান্নার ছবি অত্যন্ত গুরুত্বসহ সংবাদে স্থান দেয়। এই আনন্দের কান্নায় দেশের মাটির ছোঁয়া থাকে। শত বিপত্তি-বাধার মুখেও এক মুহূর্ত হলেও দেশের প্রতি প্রতিটি নাগরিকের কাঙ্ক্ষিত কান্নার সুযোগ হয়। 

দুটি ঘটনার কথা বলার উদ্দেশ্য– দেশপ্রেমের উদাহরণ দেওয়া। আসলে দেশপ্রেম কখনও ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশের মতো নয়। এটা সম্পূর্ণ অন্তরের বিষয়। হয়তো প্রকাশভঙ্গিটা একেকজনের একেকরকম হয়ে থাকে। আর দেশপ্রেমের প্রসঙ্গটি আনার পেছনের মূল কারণ হচ্ছে ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার ঘটনা। ফিলিস্তিনের মাটির জন্য তাদের মানবতার জন্য কি এমন একজন মাবিয়া কিংবা একজন জুয়েল আইচ জন্ম হতে পারে না? যিনি তাদের অনুপ্রেরণার প্রতীক হবেন,তাদের জন্য এক মুহূর্তের আনন্দাশ্রু উপহার দিতে পারেন?
আগ্রাসী রাষ্ট্র ইসরায়েল ফিলিস্তিনে অবিবেচক ও মানবতা বিরোধী আগ্রাসন চালিয়ে বিশ্বসভ্যতার মুখে কালি লেপন করে দিয়েছে। শিশু নারী ভেদে সাধারণ মানুষকে ওরা অগুনিতভাবে হত্যা করছে। এই গণহত্যার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে মুসলমানরা কী করছে? ধর্মীয় বিবেচনায় নয়, মানবতার খাতিরেও কি মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ হতে পারে না? তাদের পাশে দাঁড়ানো কি মানুষের দায়িত্বভুক্ত হতে পারে না? যারা ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ্বাস করেন তাদের কাছে  প্রশ্নটা সবার আগে করা যায়। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীরা বুকে হাত দিয়ে কি বলতে পারবেন, তাদের জাতিগোষ্ঠীর ওপর যে বর্বরোচিত হামলা করা হচ্ছে, তা প্রতিরোধের জন্য তারা কি পদক্ষেপ নিয়েছেন?

আমি এটা বলছি না বিভিন্ন দেশ থেকে সৈনিকেরা গিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুক। কিন্তু  বিশ্বজনমত তৈরি করে পরাশক্তিগুলোর ভিত কাঁপিয়ে দেওয়ার শক্তি কি তাদের নেই? অবশ্যই সেই ক্ষমতা মুসলিম জাতি বিশ্বাসীদের আছে। কোথায় তাদের জাতিপ্রেম? 

যারা ধর্মজাতির স্লোগান দেন, যারা মিশর, সৌদী আরব কিংবা আরব আমিরাতের দেশগুলোকে তাদের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের তীর্থস্থান মনে করেন, তাদের অবস্থান কী? ইসরায়েলিদের গণহত্যা চালানোর কয়েকদিন পর মাত্র ১৪ অক্টোবর খবর হয়েছে, সৌদি আরব ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি সংলাপ স্থগিত করেছে। যেসব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তারা কি কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে মানবতা বিরোধী এই অপরাধ থামানোর জন্য? এখনও চোখে পড়েনি ওআইসি’র তৎপরতার কোনও খবরও।

২০১৯ সালের বিশ্বজনসংখ্যা রিপোর্ট  অনুযায়ী, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৭৭১.৫০ কোটি। এর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ২০০ কোটি। এই চার বছরে আরও অন্তত ৫০ কোটি মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে। অর্থাৎ ২৫০ কোটি মুসলমানের এই পৃথিবীতে মাত্র ৯৭ লাখ মানুষের দেশ ইসরায়েল কীভাবে এমন অত্যাচার চালিয়ে যেতে পারে? আরও দেখার বিষয় হচ্ছে এই ৯৭ লাখ ইসরায়েলবাসীর মধ্যে ২১ শতাংশই মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। সেই হিসেবে ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ সেখানে ইহুদি ধর্মাবলম্বী। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে তারা যদি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতো তাহলে ক্ষুদ্র একটি দেশ ইসরায়েল কি এভাবে বছরের পর বছর ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ চালানোর সাহস পেত?

এটা মনে করার কারণ নেই ফিলিস্তিনের এই দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্বটা শুধু মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদেরই। যারা মানবতার পক্ষে কথা বলেন, যারা দুনিয়াটাকে সুস্থ মানুষের বসতি হিসেবে দেখতে চান, তাদেরও ভূমিকাটা কী? ফিলিস্তিনের নিরপরাধ নারী, শিশু এবং প্রবীণদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তারা কি সোচ্চার হয়েছেন? বাস্তবতা হচ্ছে ইউরোপে যখন মানবতাবাদীরা ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে মিছিল করতে যায় সেখানে তারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। অথচ ওইসব দেশ অহর্নিশ গণতন্ত্রের কথা মানবতার কথা বলে। যে মুহূর্তে তারা ফিলিস্তিনি মানুষের ওপর অমানবিক আচরণ বন্ধের কথা বলে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এর দেশগুলো যখন নিজেদের গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী বলে দাবি করে তখন তাদের প্রতি করুণা হয়। 

এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় জুয়েল আইচ এবং মাবিয়ার মতো দেশাত্মবোধের মানুষ দরকার। যারা মানবতাকে ভালোবাসার কারণে মানুষকে আনন্দাশ্রু বর্ষণের সুযোগ করে দেবেন। 

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
ভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগ, সেমিফাইনালভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ