X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষার হালচাল

ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫:০৯আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৫:০৯

মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার নজির পৃথিবীতে আর নেই, আমাদের আছে। জাতির সেই বীর সন্তানদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। প্রতিবছর ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলে পুরো জাতি নতুন করে মাতৃভাষা নিয়ে ভাবার অবকাশ পায়। ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য বিগলিত হই বটে, তারপর আবার ‘পুনর্মূষিক ভব’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধস্বরূপ’। উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষার দুরবস্থা দূর করা জরুরি। এ কথা কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়, সব শিক্ষাচিন্তকই বলেছেন, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভ না করলে কোনও শিক্ষাই পূর্ণতা পায় না। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সব শাখায়ই শিক্ষার্থীকে বাংলা ও ইংরেজি এ দুটি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। ইংরেজির জন্য মনোযোগ থাকলেও এক্ষেত্রে বাংলার অবস্থা খুবই শোচনীয়। শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে না বুঝেই মুখস্থ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যে ব্যাহত হচ্ছে।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে আসার পর হঠাৎ করেই উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করতে বাধ্য হলেও তাদের আত্মস্থ করা, চিন্তা করা ও মনে রাখার প্রক্রিয়াটি বাংলাতেই হয়ে থাকে। এতে শিক্ষার্থীরা না শিখছে বাংলা, না ইংরেজি। এ জন্যই কবি বলেছেন, “নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশি ভাষা, পুরে কি আশা?” স্বাধীনতার পর দেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করা হয়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ আমরা কমই দেখতে পাই। অথচ প্রচলিত শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষায় আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সব ডিগ্রিকোর্স পর্যায়ে ১০০ নম্বরের ইংরেজি বিষয় সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি। অপ্রিয় হলেও সত্য, অনেকে এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বলেন, উচ্চশিক্ষায় বাংলায় ভালো কোনও বইপত্র/ পর্যাপ্ত গবেষণা/ গ্রন্থ পাওয়া যায় না। কিছু বইপত্র পাওয়া গেলেও তা দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক নয়। এছাড়া অনেকে বলেন, বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার অপ্রতুলতার জন্য বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভ করা সম্ভব নয়।

প্রসঙ্গত, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ব্যবহার সহজ করা। তবে প্রতিষ্ঠানটি এটি কি করতে ব্যর্থ হয়েছে !

মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি সে দেশে উন্নয়নের ধারা ততবেশি অগ্রসরমান। বর্তমানে চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তারা নিজেদের জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছে। বাস্তবিকপক্ষে, বাংলা ভাষার যেভাবে মূল্যায়ন দরকার, বাংলাদেশ সেক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। ফলে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। এর পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে অন্যদের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। যেহেতু সারা বিশ্বে ইংরেজি ভাষার প্রচলনই সবচেয়ে বেশি এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে তারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেহেতু একটি ভালো চাকরি, কর্মসংস্থান যাই বলি না কেন তা অনেকাংশে নির্ভর করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার ওপর। কিন্তু আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে যখন কোনও জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বিসর্জন দেয়, তখন তারা তাদের নিজস্ব জাতিসত্তা হারিয়ে ফেলে। উদাহরণস্বরূপ প্রাচীন মিসর থেকে শুরু করে বর্তমানের জিম্বাবুয়ে।

মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। অল্প সংখ্যক নীতিগত সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়টি একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ প্রথমটি হচ্ছে, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়বস্তুতে মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান ও গবেষণার অবারিত সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলা ভাষায় পাঠ্যবই রচনা ও গবেষণাকর্ম অনুবাদের (সহজবোধ্য এবং মান অক্ষুণ্ণ রেখে) নিমিত্ত স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।

দ্বিতীয়টি হলো, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে পারে এবং সেখানে বাংলা ভাষার মানোন্নয়ন ও নির্ভুল অনুবাদ নিয়ে গবেষণা করতে পারে।

তৃতীয়টি হলো, বাংলা একাডেমিকে সব ধরনের স্বার্থ এবং রাজনীতির ঊর্ধ্বে রেখে স্বাধীনভাবে দেশের নেতৃত্বস্থানীয় বাংলা ভাষা গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তর করতে পারে।

চতুর্থটি হলো, আর্থিক প্রণোদনা এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে অনুবাদক এবং ভাষাবিদদের সহযোগিতা করতে পারে।

পঞ্চমটি হলো, উন্নত বিশ্ব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রচলন করে তাদের ভাষাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরছে। চীন, জাপান ও উত্তর কোরিয়া নিজেদের ভাষায় চিহ্ন বা ছবি দিয়ে নিজেদের বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষায় বিরাট সাফল্য অর্জন করছে। আমরাও আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমাদের বাংলা ভাষাকে সর্বজনীন করে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে পারি।

ষষ্ঠটি হলো: বাংলা সংস্করণে বেশি বেশি কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি করা। সর্বোপরি সরকারের সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের মাতৃভাষাকে আমরা অবশ্যই আরও বেশি সমৃদ্ধ করতে পারি উচ্চশিক্ষায় ‘দূরদেশি ভাষা থেকে আমরা বাতির আলো সংগ্রহ করতে পারি মাত্র, কিন্তু আত্মপ্রকাশের জন্য প্রভাত-আলোক বিকীর্ণ হয় মায়ের ভাষায়।’

আমরাও আমাদের প্রভাত-আলোক বিকীর্ণ করি মায়ের ভাষায়। রক্ত দিয়ে কেনা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলায় উচ্চশিক্ষা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়, কারণ বাংলা অনেক শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল ভাষা। এ ভাষায় উচ্চশিক্ষার যেকোনও বিষয়ই প্রকাশ করা সম্ভব। এ জন্য দরকার সচেতনতা ও আন্তরিকতা। আর এভাবেই শুধু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নয়, বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়েও সমস্বরে বলি- ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।’

লেখক: অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ