X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের ক্রিকেট কি এখনও হোয়াইটওয়াশ পর্যায়েই আছে?

রেজানুর রহমান
০২ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:২৫আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৩১

রেজানুর রহমান আমি ক্রিকেটের ব্যাকরণ তেমন একটা বুঝি না। তবে ক্রিকেট ভালোবাসি। ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোনও খেলা থাকলে আনন্দ-উত্তেজনায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। কখনও কখনও এমনও হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিশ্চিত হেরে যাচ্ছে দেখেও টিভি পর্দা থেকে চোখ ফেরাতে পারি না। শুধু একটাই প্রত্যাশা, বাংলাদেশ হারলেও যেন সম্মানের সঙ্গে হারে। যেন গর্ব করে বলতে পারি- সমানে সমানে লড়াই হয়েছে। আমাদের ভাগ্য খারাপ তাই অল্পের জন্য হেরে গেছি।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নয়ন ধারা এতটাই বেগবান ছিল যে, এখন আর নেতিবাচক কোনও চিন্তা-ভাবনাই মাথায় আসে না। বরং সমানে সমানে লড়াই করার সাহসটাই বেশি করে ধরা দেয়। দেবেইবা না কেন? গত বছর আমাদের ক্রিকেটের অর্জন তো কম ছিল না। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলেছে আমাদের লড়াকু ক্রিকেটাররা। কাউকে হোয়াইটওয়াশ, কারও সঙ্গে সিরিজ জয়ের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে তারা। সঙ্গত কারণেই দেশবাসীর কাছে একটা ধারণা পোক্ত হয়ে যায়, তা হলো আমাদের ক্রিকেট এগিয়েছে। সে কারণে বাংলাদেশ এবার নিউজিল্যান্ডে খেলতে যাওয়ার আগে থেকে একটা স্বপ্ন ও প্রত্যাশার ডালপালা বিস্তৃত হতে থাকে। তা হলো, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন খেলতে নামার আগেই মানসিকভাবে হেরে যায় না, লড়াই করে জেতে। কাজেই নিউজিল্যান্ড সিরিজ একটা চমক দেখাবেই।
হ্যাঁ, নিউজিল্যান্ড সিরিজে বাংলাদেশের ক্রিকেট দল সত্যি সত্যি চমক দেখিয়েছে। যা দেখে গোটা দেশের মানুষ শুধু বিস্মিত নয়, কিছুটা লজ্জিতও বটে। অনেকে হয়তো বলতে চাইবেন, খেলায় হারজিৎ থাকবেই। কাজেই বিস্মিত ও লজ্জিত হওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কেন? উত্তরে বিনীতভাবে বলি, প্রসঙ্গটা আসছে এই জন্য যে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্রিকেট এখন শুধু একটি খেলা নয়, ঐক্যেরও প্রতীক বটে। এই একটি খেলায় গোটা দেশের মানুষ দলমত ভুলে গিয়ে এক হয়। জয়ে আনন্দধ্বনি দেয়, আর পরাজয়ে ব্যথিত হয়। এমন তো নয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আমাদের শুধুই ব্যথিত করেছে। অসংখ্যবার আমাদের আনন্দের সাগরে ভাসিয়েছে। যোগ্যতর দল হিসেবে নিজেদের প্রমাণিত করেছে। সে কারণে আমরা ভুলে গেছি বাংলাদেশও ক্রিকেটে হোয়াইটওয়াশ হতে পারে। 'হোয়াইটওয়াশ' শব্দটা সত্যিকার অর্থে হঠাৎ করেই আবার বেদনার জন্ম দিয়েছে।
যেখানে স্বপ্ন ছিল বছরের শেষে বিদেশে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ দল। জয়ের আনন্দ দিয়েই বছরটা নিশ্চয়ই শুরু হবে। কিন্তু তা হলো কই! একটা প্রশ্নই বার বার মনের ভেতর তোলপাড় করছে, তাহলে কি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যোগ্যতর দল হয়ে ওঠেনি এখনও?
অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নিয়ে কত প্রত্যাশা আমাদের। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের রাত-দিনের সময়ে বেশ পার্থক্য আছে। নিউজিল্যান্ডে প্রথম যেদিন বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা শুরু হলো, বাংলাদেশে ঘড়ির কাঁটায় তখন ভোর ৪টা। গোটা দেশের মানুষের ঘুমিয়ে থাকার কথা। অথচ গোটা দেশই যেন জেগে উঠেছিল। প্রত্যাশা একটাই- বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আজ নিশ্চয়ই একটা চমক দেখাবে। হোম কন্ডিশনে বাংলাদেশ ভালো দল। কিন্তু দেশের বাইরে বাংলাদেশকে তা প্রমাণ করতে হবে- সমালোচকদের এই কথার জবাব আজ নিশ্চয়ই দেবে বাংলাদেশ। দেশের প্রতিটি দৈনিক ও টিভি মাধ্যমে শুধুই প্রত্যাশার কথা- ঘুমন্ত শহরকে আজ জাগাবে কি বাংলাদেশ? কিন্তু না বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পারলো না। শুরুর দিনেই হোচট খেলো। নিউজিল্যান্ডের রানের পাহাড়ে চাপা পড়ে মোটামুটি বিধ্বস্ত হলো। এবার দ্বিতীয় ওয়ানডের পালা। আবারও দেশবাসীর প্রত্যাশা-প্রথমবার সাফল্য আসেনি দ্বিতীয়বারে নিশ্চয়ই সাফল্য আসবে। সত্যি সত্যি ঘুমন্ত শহরকে জাগাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। শুধু শহর নয় গোটা বাংলাদেশ জেগে ছিল সেদিন। কিন্তু এবারও সাফল্য এলো না। তৃতীয় ওয়ানডেতে প্রায় সবাই নিশ্চিত- বাংলাদেশ আজ জিতবেই। কারণ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন আর হোয়াইটওয়াশ হওয়ার মতো দল নয়। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দল সত্যি সত্যি হোয়াইটওয়াশ হলো।
আমাদের বাংলাদেশে হোয়াইটওয়াশকে নাম দিয়েছি ‘বাংলাওয়াশ’। নিউজিল্যান্ডে হোয়াইটওয়াশের বিকল্প কোনও নাম চালু হয়েছে কিনা জানি না। তবে টিভিতে তাদের চেহারা, অঙ্গভঙ্গি দেখে এটুকু মনে হয়েছে ওরা বেশ তৃপ্ত। ‘খুব তো বাংলাওয়াশ বলিস। এবার দ্যাখ নিউজিওয়াশ কাকে বলে!’
লেখার শুরুতে বলেছি আমি ক্রিকেটের ব্যাকরণ বুঝি না। তবে এটুকু বুঝি ক্রিকেট আমাদের হাসায় আবার কাঁদায়ও। নিউজিল্যান্ডে তৃতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল শোচনীয় ভাবে হেরে যাওয়ার পর-পরই আমার মোবাইল ফোনে পরিচিত এক তরুণের ফোন আসে। কলেজের ছাত্র। ফোনে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করলাম- কাঁদছো কেন? কী হয়েছে? তার কান্না থামছে না। আরও জোরে কেঁদে ফেললো সে। বললো- আমাদের ক্রিকেট দল কি এতটাই দুর্বল যে হোয়াইটওয়াশ হতে হবে? এই প্রশ্নটা আমারও।
নতুন কন্ডিশনে নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিধর ক্রিকেট দলের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রতিটি খেলায় জিতবে এমন স্বপ্ন আমি দেখি না। কিন্তু প্রতিটি খেলায় বাংলাদেশ হারবে এটা কি মেনে নেওয়ার মতো? আমাদের ক্রিকেটের রাজপুত্র মাশরাফি বিন মর্তুজার আমি একজন অন্ধ ভক্ত। একটি দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে তার সমকক্ষ আমি আর কাউকে দেখি না। মর্তুজা প্রায়ই একটা কথা বলেন। আমরা জয়ের জন্যই মাঠে নামি। পরাজয়ে আমাদেরও কষ্ট হয়। বিষয়টি যেন ভক্তরা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখেন।
মাশরাফির কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই- আমরা জয়ে আছি, পরাজয়েও আছি। কিন্তু প্রশ্ন একটাই বাংলাদেশ কি এখনও হোয়াইটওয়াশ হওয়ার মতো ক্রিকেট দল? নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশে এসে হেরেছে। কাজেই ওরা নিশ্চয়ই চাইবে বাংলাদেশও তাদের দেশে গিয়ে হারুক। বোধ করি ওরা সেভাবেই পরিকল্পনা সাজিয়েছে। আমরা কি সে কথা ভেবে আমাদের পরিকল্পনা সাজিয়েছি? নিউজিল্যান্ডে দারুণ শীতে আমাদের ছেলেরা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে কিনা, এ ব্যাপারে কি গুরুত্ব দিয়েছি? নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় কয়েকদিনের প্র্যাকটিস ক্যাম্প খোলা হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল সেখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে ক্রিকেটারদের অভ্যস্ত করার জন্য। প্রশ্ন উঠেছে এই ক্যাম্পটি নিউজিল্যান্ডে করলে কী সমস্যা ছিল? কারণ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আবহাওয়াগত পরিবেশ তো এক নয়।
শেষে একটি ছোট্ট ঘটনার কথা বলি। আমার এক বন্ধু নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরাজয় দেখে যারপরনাই ব্যথিত। কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছে আর বাংলাদেশের খেলা দেখবে না। দুপুরে প্রতিজ্ঞার কথা শুনিয়ে সন্ধ্যায় আবার এলো। জিজ্ঞেস করলো- আচ্ছা বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের পরবর্তী খেলা যেন কবে? তাকে প্রশ্ন করলাম- কী ব্যাপার তুমি না বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা আর দেখবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছ? অথচ জানতে চাইছ? মুখে হাসি ছড়িয়ে বন্ধু বলল, আজ হেরেছো তো কী হয়েছে? দেখিস ওরা কাল ঠিকই জিতবে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের জয় হোক।
লেখক: নাট্যকার, পরিচালক, কথাসাহিত্যিক। সম্পাদক, আনন্দ আলো

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ