X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী: এগিয়ে, না পিছিয়ে?

বিভুরঞ্জন সরকার
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:৫৮আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৯

বিভুরঞ্জন সরকার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেই এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে বিএনপি। ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। একে একে অনেকগুলো বছর চলে গেলো। সাবেক সেনাশাসক ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত এই দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অপরিহার্য নাম। জিয়ার মৃত্যুর পর কোনও রাজনৈতিক পণ্ডিত ধারণা করেছিল, জিয়ার অবর্তমানে বিএনপি নিঃশেষ হয়ে যাবে, দুর্বল হয়ে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি। বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায়নি শুধু, দেশ শাসনের ক্ষমতাও পেয়েছে। বিএনপির পক্ষে এবং বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা আছে। সেটা ছোটবড় সব রাজনৈতিক দলেরই থাকে। তবে বিএনপি যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে– এট খুব কম কথা নয়। এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে বিএনপি কি নিজেদের সম্পর্কে কিছু মূল্যায়ন-পর্যালোচনা করবে? কিভাবে জন্ম, কিভাবে বেড়ে উঠলো, কোথায় গন্তব্য – এসবের খাতাকলমে একটা হিসাব থাকলে ভালো হয়।
আমরা এটা লক্ষ করছি যে, নানা ধরনের সংকট ও চাপে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির এখন চিঁড়ে চ্যাপ্টা অবস্থা। একদিকে আছে সরকারের চাপ, জেল-মামলা, গ্রফতার আতঙ্ক অন্যদিকে দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস চরমে। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। শীর্ষ নেতাদের কারও কারও বিরুদ্ধে সরকারের হয়ে কাজ করার অভিযোগ কর্মী-সমর্থকদের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যেই করা হয়। বছর খানেক আগে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বেগম জিয়ার সামনেই কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তাদের 'সরকারের এজেন্ট' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন কারণে বেগম জিয়াও কাউকে কাউকে অবিশ্বাস করেন বলে মনে হয়। দুই মাসের বেশি সময়ের জন্য লন্ডন গেলেও বেগম জিয়া কাউকে দায়িত্ব দিয়ে যাননি, সম্ভবত অবিশ্বাসজনিত কারণেই।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সময় তার সঙ্গীদের তালিকা থেকে শেষ মুহূর্তে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের নাম বাদ দিয়ে বেগম জিয়া তাদের প্রতি নিজের অবিশ্বাসের কথাই প্রকাশ করেছিলেন বলে ধারণা করা যায়। বছর খানেক আগে এই দুই নেতার দুই টেলিফোন সংলাপের অংশবিশেষ ফাঁস হওয়ায় দলের মধ্যে তাদের নিয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ একজন কর্মীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে বলেছেন, '...এই বিএনপি দিয়ে হবে না। জিয়াউর রহমানের বিএনপি যদি করতে পার...।' আর মাহবুবুর রহমানও আরেক কর্মীর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে দিয়ে কিছু হবে না’।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন এবং চরম হতাশা। দলের নেতৃত্ব পুনর্বিন্যাস কিংবা দলকে পুনর্গঠনের কথা অনেক দিন থেকেই বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করা সম্ভব হচ্ছে না। একদিকে বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থান, অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরে নেতাদের মধ্যে গ্রুপিং, কোন্দল, অবিশ্বাস। এ দুইয়ে মিলে বিএনপির এখন 'নট নড়নচড়ন' অবস্থা। বিএনপি খুব সহসা এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন যেমন রাজনৈতিক মহলে আছে, তেমনি বিএনপির ভেতরেও এ নিয়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, গণমাধ্যমে বিএনপির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সমস্যা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই খবর প্রকাশিত হলেও এসব নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের মধ্যে কোনও আলাপ-আলোচনা হচ্ছে না। দলীয় ফোরামে সমালোচনা-আত্মসমালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবর্তে যা হচ্ছে, তা সবই বাইরে বাইরে। সে জন্য কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে, বিএনপির কোনও কিছুই আপন শক্তিতে হচ্ছে না, বিএনপি আত্মশক্তিতে চলছে না, বিএনপি চলছে বাইরের শক্তিতে। এই 'বাইরের শক্তি' নিয়ে আছে ক্ষোভ-অসন্তোষ।

বেগম খালেদা জিয়া বিএনপিকে তিন তিন বার ক্ষমতায় যাওয়ার নেতৃত্ব দিয়ে নিজে 'তিনবারের প্রধানমন্ত্রী' হওয়ার গৌরব যেমন অর্জন করেছেন, তেমনি শেষ ধাপে এসে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপিকে বিপর্যয়ের মুখেও ঠেলে দিয়েছেন। বিএনপির বর্তমান করুণ অবস্থা দেখে অনেকে যেমন উৎফুল্ল হচ্ছেন, তেমনি অনেকে আবার দুঃখবোধও করছেন। যারা রাজনৈতিকভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে তারা বিএনপির বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে বেজায় খুশি। তারা হয়তো ভাবছেন, বিএনপির পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। দলটি শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করবে। আবার যারা সরাসরি বিএনপি করেন না অথচ দেশের রাজনীতিতে বিএনপির অস্তিত্ব প্রবলভাবেই থাকা উচিত বলে মনে করেন তারা পড়েছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। বিএনপির অসহায়ত্ব তারা মানতে পারছেন না, আবার ভুল শুধরে দলটি ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কিভাবে ফিরে পাবে, সেটাও বুঝতে পারছেন না। তারা এটা ভেবেও উদ্বেগবোধ করছেন যে, দেশে বিএনপির মতো একটি শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে উপযুক্ত প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী নেই ভেবে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রয়োগ করতে গিয়ে যেরকম বেপরোয়া হয়ে উঠবে যার লক্ষণ এর মধ্যই দেখা যাচ্ছে, সেটা দেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হবে না।

বিএনপির বর্তমান অবস্থা নিয়ে হতাশা থাকলেও বিএনপি মুসলিম লীগের পরিণতি বরণ করবে- এমন আশঙ্কা বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা কেউ করেন বলে মনে হয় না। এখন খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে ঠিকই, কিন্তু দলের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে গত কয়েক বছরে যেসব ভুল করা হয়েছে, সেগুলো সংশোধন করে বিএনপি যদি নতুনভাবে আরম্ভ করে তাহলে বর্তমান দুঃসময় কাটিয়ে ওঠা কোনও কঠিন কাজ হবে না। বিএনপির প্রতি দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সমর্থন রয়েছে। বিএনপির যারা অন্ধ সমর্থক তারা কোনও কিছু বাছ-বিচার না করেই বিএনপিকে ভোট দিয়ে থাকেন। দলের জন্য এই বিশেষ সুবিধার দিকটি বিবেচনা না করে বিএনপি নেতৃত্ব কেন বার বার হটকারী রাজনৈতিক কৌশল ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সে প্রশ্নের জবাব খোঁজা দরকার।
নীতি-নির্ধারণের জন্য দলের উপযুক্ত ফোরাম থাকা সত্ত্বেও সেখানে কোনও আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় সেটা জানা দরকার বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থকদের। কেন বার বার আন্দোলনের ডাক দিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে, সন্ত্রাস-সহিংসতার রাজনীতি করে না বলে দাবি করা সত্ত্বেও বিএনপির আন্দোলন কেন সন্ত্রাস-সহিংসতা-নাশকতামুক্ত হয় না, বিএনপির আন্দোলনকে সাবোটাজ করার জন্য অন্য পক্ষ যদি এসব করে থাকে তাহলে বারবার কেন সাবোটাজের সুযোগ করে দেওয়া হয়? দেশে গণতন্ত্র নেই বলে বিএনপির এত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অথচ বিএনপির দলীয় পর্যায়ে কেন গণতন্ত্রের চর্চা হয় না- এসব প্রশ্নের জবাব নেতৃত্বকে দিতে হবে। দলের মধ্যে আলাপ-আলোচনার দুয়ার খুলে দিতে হবে। বিএনপি নেতারা দাবি করে থাকেন সুষ্ঠু নির্বাচন হলে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে মানুষ বিএনপিকেই ভোট দেবে। এ দাবি হয়তো একেবারে অসত্য নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির এই ভোটাররা কেন বিএনপির ডাকে আন্দোলনে মাঠে নামে না? মানুষ কি তাহলে আন্দোলন করে সরকার বদল করতে চায় না? যদি তাই হয় তাহলে বিএনপি কেন ভোটের রাজনীতি বাদ দিয়ে আন্দোলনের নামে সহিংসতার পথ বেছে নেয়?

জরুরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিএনপির ওপর যখন দুর্যোগ নেমে এসেছিল তখন থেকেই দল পুনর্গঠনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু পুনর্গঠনের কাজটি কেন বার বার থমকে যায়, বাধাগ্রস্ত হয়? কে বা কারা বাধা দেয়? দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথাও সেই জিয়াউর রহমানের শেষ দিক থেকেই শোনা যাচ্ছে। জিয়াউর রহমান দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটানোর জন্যই চট্টগ্রাম গিয়ে 'বিদ্রোহী' সেনা সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। দল থেকে সুবিধাবাদী, দুর্নীতিবাজ, সরকারের সঙ্গে আঁতাতকারীদের বাদ দিয়ে কেন ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাদের নিয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে কমিটি গঠন করা হয় না? বলা হচ্ছে, সরকার বিএনপির ওপর এত দমন-পীড়ন চালাচ্ছে যে তারা এখন না পারছে আন্দোলন করতে, না পারছে দল গোছাতে। বিএনপির এসব কথা একেবারেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। বিএনপি যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করত, যদি বার বার সরকার পতনের হুমকি দিয়ে দেশের মধ্যে 'যুদ্ধ' পরিস্থিতি সৃষ্টি না করত তাহলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দিয়ে গ্রেফতার-নির্যাতন চালানোর সুযোগ সরকার পেত কি? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে জামায়াতের মতো জঙ্গি দলকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য হত্যা, অগ্নিসংযোগ, সম্পদ ধ্বংসের যে উন্মত্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল সে পরিস্থিতিতে কোনও দেশের কোনও সরকার কি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারত? সরকার দিয়েছিল ভোটের অধিকার আর বিএনপি চাইছিল মানুষ সেই অধিকার প্রয়োগ না করুক। বিএনপির বক্তব্য হলো- দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ভোটের ফলাফল বদলে দিয়ে বিএনপির বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হতো। নির্বাচনে অংশ নিলে যদি বিএনপিকে জোরজবরদস্তি করে হারিয়েও দেওয়া হতো তাহলেও রাজনৈতিকভাবে বিএনপি এখন সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতো, সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পেত। সরকার ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ পেত না। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপির কী লাভ হয়েছে? বিএনপি যতই বলুক ৫ জানুয়ারি কোনও নির্বাচন হয়নি, সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় আছে, তাতে তো বিএনপি কোনও সুবিধা পাচ্ছে না। তাদের এসব অভিযোগ সত্ত্বেও দেশ চালাতে সরকারের বড় ধরনের কোনও সমস্যা হচ্ছে না। বিদেশিরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যাই বলুক না কেন, তারা কেউ কি সরকারকে কোনও ধরনের চাপের মধ্যে রেখেছে? নাকি বিএনপিই এখন সংসদীয় রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে? সরকারতো ঠিকই তার মেয়াদ পূর্ণ করার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

বেগম জিয়া লন্ডনে গিয়ে প্রটোকলজনিত সমস্যায় অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারছেন না বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকলে এই সমস্যা হতো না। এর আগে সফরকারী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা নিয়েও সমস্যা হয়েছিল। মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তাকে নানাভাবে লবিং করতে হয়েছে। তিনি যেচে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাকি নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছায় সাক্ষাৎ হয়েছে তা নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। তিনি যেচে সাক্ষাৎ না চাইলে নরেন্দ্র মোদি নিজ আগ্রহে হয়তো তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইতেন না। বাংলাদেশের একটি 'বড়' রাজনৈতিক দলের নেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া সাক্ষাৎ করতে চেয়েছেন, নরেন্দ্র মোদি সেটা নাকচ করেননি। কিন্তু এই সাক্ষাৎ করায় বিএনপি কি রাজনৈতিকভাবে খুব লাভবান হয়েছে? বেগম জিয়া নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে কী বলেছেন বা নরেন্দ্র মোদিইবা তাকে কী বলেছেন তা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের গণমাধ্যমে নানা ধরনের খবর বের হচ্ছে। এই খবরগুলো বিএনপি এবং বেগম জিয়ার মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে বলে মনে হয় না। বেগম জিয়া পাঁচজন সঙ্গী নিয়ে সোনারগাঁও হোটেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে একগাদা নালিশ জানিয়েছেন। বেগম জিয়ার অভিযোগ: বাংলাদেশে বর্তমানে গণতন্ত্র নেই। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় জেঁকে বসেছে। বিরোধী দলের অর্থাৎ বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চলছে। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ইত্যাদি। শুধু মুখে বলা নয়, মোদির কাছে একটি লিখিত অভিযোগনামাও দাখিল করা হয়েছে। বিদেশি এক সরকারপ্রধানের কাছে এভাবে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে অভিযোগনামা দেওয়াটা কি খুব সমীচীন হয়েছে? বেগম জিয়া এবং তার সমর্থকরা বলে থাকেন, বর্তমান সরকার ভারতের 'করুণা' নিয়ে ক্ষমতায় আছে। অর্থাৎ ভারতের 'করুণা' নিয়ে ক্ষমতায় থাকাটা ভালো কাজ নয়। অথচ তিনি নিজেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে করুণা ভিক্ষা করছেন। এতে কি তার ইমেজ উজ্জ্বল হয়েছে?

আমাদের মতো দেশগুলোতে যারা ক্ষমতায় থাকে তারা বিরোধী দলের সঙ্গে খুব বন্ধুসুলভ আচরণ করে কি? ভারতের অভ্যন্তরের অবস্থা কী? যে রাজ্যে যারা ক্ষমতায় তারা কি বিরোধীদের আদর-আপ্যায়ন করছে, নাকি 'দাবাড়ের' ওপরই রাখছে? দিল্লিতে আম আদমি পার্টি সরকার গঠন করেছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কি তাদের যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করছে? একেবারে আমাদের বাড়ির কাছের পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি কী? কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে তার দলের খারাপ ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, '...আমাদের ভোট কিছু বেড়েছে। তবে সময় লাগবে। কারণ পশ্চিমবঙ্গে আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ হয়েছে। এই পাঁচ বছরে আমাদের প্রায় ৫০০ নেতা-কর্মী মারা গেছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মী বাড়িতেই থাকতে পারছে না। হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।' এই পরিস্থিতির জন্য সিপিএম নেতারা বিদেশে গিয়ে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ জানাচ্ছে? বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী দলের ওপর গ্রেফতার-নির্যাতন চালালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কী করার আছে? নিজ দেশের একটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের বেপরোয়া আচরণের বিরুদ্ধেই তো মোদির কার্যত করার তেমন কিছু নেই।

সরকারের কাছে গণতান্ত্রিক আচরণ প্রত্যাশা করলে বিএনপিকে আগে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুসরণ করতে হবে। আন্দোলনের নামে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নীতি-আদর্শ থেকে সরে গিয়ে বিএনপি জামায়াতনির্ভর হয়ে যে রাজনীতি করছে তাতে দলের বিপদ-বিপর্যয় কাটবে বলে অনেকেই মনে করছেন না।
চারদিক থেকেই এক ধরনের সতর্ক সংকেত বেজে উঠছে। এই সংকেতধ্বনি না শোনার ভান করলে ক্ষতি বাড়বে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, 'এই বিএনপি দিয়ে হবে না'- বলে মন্তব্য করায় তাকে দল থেকে বের করে দিলে কিংবা দলের মধ্যে কোণঠাসা করে রাখলে দল সংকটমুক্ত হবে না। এসব কথা কেউ না কেউ বলবেই। এ ধরনের কথাবার্তা বন্ধ করার জন্য রাজনীতিতে বিএনপি যে ‘ভুল’ করেছে তা আগে স্বীকার করতে হবে, ভুল নীতি-কৌশল থেকে সরে আসতে হবে। বিদেশিদের কাছে ধরণা দেওয়া বন্ধ করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে হবে। না হলে দল হিসেবে বিএনপি টিকে থাকলেও রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার আশঙ্কা দূর হবে না।
কথায় কথায় সরকারের পদত্যাগ দাবি করা বিএনপির একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর বিএনপি সরকারবিরোধী প্রচারণা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে সরকারকে 'ইরিটেট' করা ছাড়া বিএনপি অন্য কিছু লাভ হাসিল করতে পারছে কি? রায়ে সামরিক শাসনের যে কড়া সমালোচনা আছে তাতে কি জিয়াউর রহমানের ইমেজ খুব বেড়েছে? যদি না বেড়ে থাকে তাহলে জিয়ার দল কেন রায় নিয়ে ভুয়া উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে? বিএনপির বড় পুঁজিতো জিয়া। এখন বিএনপি কি আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করার জন্য জিয়ার শরীরেও কাদা মাখাতে চায়?
এবার দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বিএনপি এই বিষয়গুলোও ভাবুক।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট[email protected]

/এসএএস/আপ-এমও/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ