X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুখ খুলেছেন সু চি

বিভুরঞ্জন সরকার
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:০০আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:০২

বিভুরঞ্জন সরকার মিয়ানমারের ‘গণতন্ত্রকামী নেত্রী’ বলে পরিচিত শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি আরাকানের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন ও গণহত্যা শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ পর মুখ খুলে যা বলেছেন তাতে বিশ্বের মানবতাবাদী – শান্তিকামী মানুষেরা বিস্মিত এবং হতাশ। তিনি চুপ ছিলেন সেটাই বরং ভালো ছিল। আশা ছিল যে, তিনি সেনা বর্বতার বিরুদ্ধে বলবেন এবং মানবতার পক্ষে দাঁড়াবেন। কিন্তু তিনি মুখ খোলার পর বোঝা গেলো, তার কাছে মানুষের প্রত্যাশাটা ছিল অকারণ। সেই সু চি আর এই সু চিতে অনেক তফাৎ। সেই সু চি ছিলেন মজলুম মানুষের পক্ষে আর এই সু চি সামরিক জান্তার পক্ষে। ২৫ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর – এই দুই সপ্তাহে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে ভিটেবাড়ি ছাড়া করে উদ্বাস্তু জীবনে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের গণমাধ্যমের খবর প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশেই ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আনুমানিক দুই লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রবেশ করেছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে তারা এক মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে সু চি কোনও কথা বলেননি। অথচ তিনিই কার্যত মিয়ানমারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি চাইলে রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে পারতেন বলে অনেকেরই বিশ্বাস।
ঘটনা শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান টেলিফোনে নিরপরাধ মানুষের ওপর সন্ত্রাসী তৎপরতার নিন্দা করলে সু চি বলেছেন, ভুয়া তথ্যের অবাধ প্রবাহে রাখাইনের পরিস্থিতি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এ ধরনের সংবাদ উগ্রপন্থীদের সাহায্য করছে। সু চি আরও বলেছেন, তার সরকার রাখাইনে বসবাসকারী লোকজনের নিরাপত্তায় সম্ভাব্য সবকিছুই করছে।

সু চির এই বক্তব্য খুবই দুঃখজনক। কোন তথ্যটা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে? সেনাবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়নি? ইতোমধ্যে শত শত নিরীহ রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়নি? প্রাণের মায়ায় এবং বাঁচার আশায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেনি? সু চির সরকার রাখাইনের কোন লোকজনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে? বাড়িঘরে আগুন দেওয়া, গুলি করে হত্যা করা, পালাতে বাধ্য করা – এ সব কি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা? 

সু চির জন্য দুঃখ হয়। তার প্রতি এক সময় দুনিয়াব্যাপী নিপীড়িত মানুষের সহানুভূতি ছিল পর্বতছোঁয়া। আজ ক্ষমতায় বসে তিনি সেই সব মানুষের অনুভূতির সঙ্গে তামাশা করছেন। তিনি এখন নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর না হয়ে উৎপীড়কের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত করছেন। তার এই বাঁক বদলে দুঃখ পেয়েছেন তার এক সময়ের ভক্তরা।

দুই.

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের মনোভাবে বাংলাদশের মানুষও আশাহত এবং ক্ষুব্ধ। ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন সর্বকালের মধ্যে উষ্ণতম বলে মনে করা হয়। এক বন্ধুদেশ আর এক বন্ধুদেশের অসময়ে পাশে দাঁড়াবে– এটাই সাধারণ প্রত্যাশা। বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে যথেষ্ট চাপের মধ্যে আছে। বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা ঘাড়ে নিয়ে নাজেহাল অবস্থায় আছে। এখন নতুন করে আরও লাখ লাখ উদ্বাস্তু এলে তার চাপ সহ্য করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। ভারতেও প্রায় ৪০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিয়ে আছে। সেই শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাতে চায় ভারত। কিন্তু মানবিকতার কারণে পারছে না। শরণার্থীর বোঝা বহন যে কতটা কষ্টকর সে অভিজ্ঞতা ভারতের যথেষ্ট থাকার কারণে আশা করা হয়েছিল ভারত শরণার্থী প্রশ্নে মিয়ারমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে যাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলো আবার নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে? কিন্তু এ ব্যাপারে মোদির নীরবতায় বাংলাদেশ কষ্ট পেয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফরে গিয়ে সু চির সঙ্গে বৈঠক শেষে সংক্ষিপ্ত যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের কোনও কথা নেই। বাংলাদেশের ওপর যে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বিরাট বোঝা হয়ে আছে, এটা যে বাংলাদেশ একক ভাবে বহনে অক্ষম, সে প্রসঙ্গেও কোনও কথা নেই। মোদি উল্টো রাখাইন প্রদেশে উগ্রপন্থী সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি আশা করেছেন, ‘দেশের একতা ও সংহতির স্বার্থে সহিংসতার সমাধান হবে’। 

অন্যদিকে মিয়ানমার নেত্রী সু চি বলেছেন, সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতীয় মনোভাবের জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। দুই দেশ একযোগে এই সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে পারবে। 

মোদি কিংবা সু চি কারো কথায় রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ নেই। এ থেকে কী বোঝা যায়? আরাকানে রোহিঙ্গা বলে কিছু নেই? উগ্রপন্থীরা সহিংসতা করছে– কিন্তু সেনাবাহিনী কী করছে? উগ্রপন্থীরা উগ্রপন্থী হলো কেন? তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার কারণ কী? তাদের দাবি কী অর্থাৎ তারা কী চায়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না খুঁজলে সমস্যার ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আরাকানে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায় না। সেটা কি তারা মুসলমান বলে, নাকি অন্য কোনও কারণ আছে? অথচ দফায় দফায় দেশছাড়া করার পরও রাখাইন প্রদেশে এখনও আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান আছেন। 

রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের সমস্যা নতুন নয়। ১৯৭৮ সালে তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানো হয়েছিল। তখনই বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের সেদেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে শাসকদের মধ্যে একধরনের ভীতি অনেকদিন ধরেই ক্রিয়াশীল আছে। তার পেছনে কারণ কী? মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গা মুসলমানরা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে রাখাইন প্রদেশে প্রবেশ করেছে। কিন্তু ইতিহাস বলে, শত শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা রাখাইনে বসবাস করছেন। হতে পারে তারা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকেই রাখাইন গেছেন। একসময় চট্টগ্রাম তো রাখাইনের সঙ্গেই ছিল। কিন্তু ১৯৪৮ সালে বার্মা, বর্তমান মিয়ানমার স্বাধীনতা লাভ করলে রোহিঙ্গারা তো বার্মার প্রতিই আনুগত্য প্রকাশ করেছে। তাহলে তাদের কেন নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না?

রোহিঙ্গাদের নিয়ে সর্বশেষ অভিযোগ হলো, বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তাদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করছে, এটা দেশটির নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক। 

এই অভিযোগ যদি সত্য বলেও ধরা হয়, তাহলেও প্রশ্ন হলো, সব রোহিঙ্গাই কি সন্ত্রাসী বা সবাই কি সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত? সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত গুটিকতক মানুষের জন্য একটি পুরো জনগোষ্ঠী দোষী হতে পারে না। সম্ভবত ভুল ধারণা ও ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে রোহিঙ্গাদের জীবন বিপন্ন করতে চলেছে মিয়ানমার সরকার। প্রতিবেশী বৃহৎ দুই রাষ্ট্র চীন ও ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের অবস্থানকে সমর্থন করায় বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হয়ে উঠেছে।

তিন.

রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের প্রবল আবেগ ও ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। এটা কতটা তাদের দুর্দশার কারণে, আর কতটা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের কারণে তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ আছে। তারা মুসলমান, তাদের ওপর জুলুম করা হচ্ছে, কাজেই আমরা তাদের পক্ষে– এমন একটি ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে দেশে সাম্প্রদায়িক মনোভাব বাড়ছে বলে আমার ধারণা। হিন্দুদের তাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের জায়গা দাও – এমন একটি প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। এটা ক্ষতিকর। রোহিঙ্গারা মানুষ। মানবতা বিপন্ন। মুসলমানের পাশে নয়, আমরা বিপন্ন মানবতার পাশে– এই মনোভাবের বিস্তারই কাম্য।

এখন কারও কারও মুখে বৌদ্ধ ধর্মের প্রশংসা শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, অহিংসা ও সকল মানবের সুখ প্রত্যাশা যে ধর্মের মূল বাণী, সেই ধর্মের অনুসারীরা কিভাবে মিয়ানমারে এমন হিংস্রতা চালাতে পারছে? মনে রাখতে হবে, যা হচ্ছে তা ধর্মের জন্য নয়, করা হচ্ছে স্বার্থের জন্য, রাজনীতির জন্য। ইসলাম শান্তির ধর্ম, সব মুসলমান ভাই ভাই – এমন কথা তো আমরা হামেশাই শুনে থাকি। কিন্তু মুসলমান কি মুসলমানকে নিধন করছে না? একাত্তরে পাকিস্তানিরা কী করেছিল? এখন মিয়ানমার বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারের জন্য রোহিঙ্গা বধ করছে না, করছে রাজনৈতিক বিবেচনা ও স্বার্থে। এসব ঘটনায় ধর্ম নিয়ে টানাটানি করাটা বিপজ্জনক।

চার.

সীমান্ত দিয়ে বানের পানির মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেখে অনেকেই একে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের সঙ্গে তুলনা করছেন। এই তুলনাটাও আমার কাছে ভ্রান্তিকর বলে মনে হয়। শরণার্থীর জীবন কষ্টের, বেদনার, গ্লানির। কিন্তু সবাই ঠিক এক কারণে শরণার্থী বা উদ্বাস্তু হয় না। বাংলাদেশের মানুষ একটি মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য, স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। এটা স্থায়ী উদ্বাস্তু জীবন ছিল না। আমাদের জানা ছিল, আমাদের দেশ স্বাধীন হবে এবং আমরা আবার দেশে ফিরে আসবো।

রোহিঙ্গারা কি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে? তারা কি জানে, তারা আার কবে দেশে ফিরে যেতে পারবে? তাদের কোনও লক্ষ্য আছে?  লক্ষ্য পূরণের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করার কোনও নেতা বা নের্তৃত্ব আছে? জাতিগত বা সম্প্রদায়গত দাঙ্গা বা জাতিগত নিধন ও গণহত্যাকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এক করে দেখায় কি আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করা হয় না? রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের অন্তরের সবটুকু ভালোবাসা আমরা উজাড় করে দেই, কিন্তু এর সঙ্গে যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে টেনে না আনি, গুলিয়ে না ফেলি। 

পৃথিবীর কোথাও কোনও কারণেই একজন মানুষের অকাল মৃত্যুও আমাদের কাম্য নয়। আজ মিয়ানমারে যে জাতি নিধনযজ্ঞ চলছে তার বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিবেক জাগ্রত করতেই হবে। সরকারগুলো স্বার্থতাড়িত। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিবেকতাড়িত। দেশে দেশে সাধারণ মানুষ ঘৃণা প্রকাশ করলে সু চি তার মন বদলালেও বদলাতে পারেন। তখন তার মুখে মানবতার পক্ষে কথা আবার ফুটলেও ফুটতে পারে। 

লেখক: কলামিস্ট

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ