X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষার মাসে ভাষার কান্না!

রেজানুর রহমান
০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:৫৪আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১২:৫৬

রেজানুর রহমান শিরোনামটা বোধকরি কঠিন হয়ে গেলো! ভাষার মাসে ভাষার কান্না! অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলতেই পারেন, আপনি কান্নাকাটি কোথায় দেখলেনরে ভাই? ভাষা আবার কাঁদে নাকি? কী সব আজগুবি ভাবনা! যারা একথা বলবেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমি কিন্তু রোজ ভাষার কান্না শুনতে পাই। আমার মতো অনেকেই ভাষার কান্না শোনেন। কিন্তু খেয়াল করেন না। আবার খেয়াল করলেও গুরুত্ব দেন না। আবার যারা গুরুত্ব দেন তারা অসহায়। কান্না শুনে করবেনই বা কী? আসলেই তো ভাষার কান্না শুনে কী-ই বা করার আছে। চারদিকে তো কত কান্না! চাল-ডালের কান্না, পিঁয়াজ-মরিচের কান্না, যার গুণ নাই সেই বেগুনের কান্না। আসলে চাল, ডাল, পিঁয়াজ, মরিচ এরা কাঁদে না। কাঁদি আমরা সাধারণ মধ্যবিত্তরা। বাজারে গিয়ে দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখে কাঁদি। এই কান্না অবশ্য চোখে দেখার কান্না নয়। এটা বুকের ভেতরের কান্না। দেখা যায় না। অনুভব করতে হয়। তেমনি ভাষার কান্নাও অনুভব করি প্রতিদিন। পথে বেরুলেই ভাষার কান্না খুব বেশি অনুভব করি। অফিসে-আদালতের সামনে সাইনবোর্ডগুলো দেখলেই ভাষার জন্য বুকের ভেতরে হাহাকারটা বাড়ে, শুধু বাড়েই। আমার মাতৃভাষা কোথাও নেই। যদিও বা কোথাও আছে খুবই ছোট... দূরবিন দিয়ে দেখতে হবে। অধিকাংশ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। গোটা গোটা ইংরেজি শব্দ। বাংলা শব্দ কোথাও নেই। অথচ নির্দেশ আছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু থাকতে হবে। ইংরেজি ভাষার ওপর আমার কোনও বিদ্বেষ নাই। যে যাই বলুক ইংরেজি না জানলে আমরা বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে মোটেই তাল মিলাতে পারবো না। সেজন্য ইংরেজির প্রতি আমাদেরকে গুরুত্ব দিতেই হবে। তাই বলে মাতৃভাষা বাংলাকে ভুলে যাবো? তাহলে কেনই বা ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে এই দেশে রক্ত ঝরেছিল? ভাষার মর্যাদা রক্ষায় শহীদ হয়েছিল কেন মানুষ?

ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই না বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন বেগমান হয়? অথচ সেই মাতৃভাষার অবস্থানটা এখন কোথায়? কোন স্তরে উপনীত হয়েছে? সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করো– এই স্লোগান তো ছিল সেই ‘৫২ সালে। আজও কি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে? দেশের শিক্ষা পদ্ধতি সামাজিক শিষ্টাচার, সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই মূলত ভাষার বিকাশ ঘটে। বাস্তবে এই মাধ্যমগুলো মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে কতটা আন্তরিক? শুরু হয়েছে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ভাষার মাস। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু না হলেও এই মাসে সর্বস্তরেই মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় অনেক কথা-বার্তা হবে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হবে। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় কান্নাকাটিও করবেন কেউ কেউ। টেবিল থাপড়ে বক্তৃতা দিতেও পিছ পা হবেন না অনেকে। ভাষার মর্যাদা রক্ষায় অনেক ভালো ভালো কথা বলবেন সবাই। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস পার হলেই সকলেই বেমালুম ভুলে যাবেন সব প্রতিশ্রুতি। তখন ভাব ভঙ্গিটাই এমন হবে– কিসের বাংলা ভাষা! বাড়িতে তো বাংলায় কথা বলি। অফিসে পারবো না ভাই। অফিসে বাংলায় কথা বলা অনেক ঝামেলা! তার চেয়ে বরং ইংরেজিটাই ভালো...

অফিসের প্রসঙ্গে পরে আসছি। আমরা বাসা-বাড়িতেও কি প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় কথা বলি? একটি পরিবারের উদাহরণ দিতে পারি। মা-বাবা দু’জনই কেউ ব্যবসা, কেউ চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। তাদের তিন ছেলে-মেয়ে। তিনজনই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে লেখাপড়া করে। সঙ্গত কারণেই পরিবারটিতে ইংরেজি ভাষাই ব্যবহার হয় বেশি। বাংলা ভাষার ব্যাপারে এই পরিবারের কারোই তেমন কোনও আগ্রহ নাই।

অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন এটাই তো দেশের আসল চিত্র নয়। এরকম সাহেব, মেম সাহেব টাইপের পরিবারকে দিয়ে তো আর বাংলাদেশকে বিচার-বিশ্লেষণ করা যাবে না। কথা সত্য। আসুন এবার একে নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের কথা বলি। পরিবারের কর্তা রিকশা চালায়। পরিবারের স্ত্রী সদস্য অন্যের বাসা-বাড়িতে কাজ করে। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে সাধারণ স্কুলে পড়ে। প্রাইভেট মাস্টার রাখার সামর্থ্য নাই। তাই স্কুলের পড়াশোনাই মূল ভরসা। পরিবারটির একমাত্র বিনোদন মাধ্যম হলো টেলিভিশন। দেশের টিভি চ্যানেলের চেয়ে বিদেশি টিভি চ্যানেল এই পরিবারের বেশি প্রিয়। সে কারণে মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে পাশের দেশের হিন্দি ভাষা এই পরিবারের আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার হয়তো অনেকেই বলবেন এটাও বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র নয়। তাহলে প্রকৃত চিত্র কী? মাতৃভাষা তার মর্যাদা ‘ঠিকঠাক’ পাচ্ছে তাহলে? প্রিয় পাঠক, আপনারা কি তরুণদের আড্ডায় সামিল হন? তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ তারাই তো মাতৃভাষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? কয়েকদিন আগে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শুরু হতে দেরি হবে। চেয়ারে একা বসে আছি। দূরে ৫/৭ জন তরুণ-তরুণী আড্ডা দিচ্ছে। ওরা কেউই শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে না। ওদের কথাবার্তার একটা নমুনা তুলে ধরছি। সবার কাঁধেই ব্যাগ ঝুলানো। ঢোলা প্যান্ট বারবার খুলে পড়তে চাচ্ছে। মনে হলো এটাই তাদের স্টাইল। একজন বললো– ‘অনুষ্ঠান স্টার্ট করতে লেট হইবো মনে হয়’। পাশের জন বলল– ‘লেট হইলে আমি নাই মামু... আরজেন্ট কাজ আছে...’ অন্য একজন জিজ্ঞেস করলো– ‘তোমার আবার আরজেন্ট কাম... বি ক্লিয়ার ম্যান...’ সঙ্গে সঙ্গে আরেজন বলে উঠলো– ‘আর ফাইভ মিনিটস... দেন আই উইল গো ম্যান...’

ওরা ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলেই যাচ্ছে। একবার ভাবলাম ওদেরকে গিয়ে বলি, বাবারা এটা কোন ভাষায় কথা বলছো তোমরা? এভাবে চর্চা করলে মাতৃভাষার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। মাতৃভাষা মরে যাবে একদিন... কিন্তু বলার সাহস পেলাম না। পাছে না তারা আমাকে অপমান করে এই ভয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম।

অনুষ্ঠান শুরু হতে সত্যি সত্যি দেরি হবে। তাই অনুষ্ঠান স্থল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। রিকশা অথবা সিএনজি অটোরিকশা যাইহোক একটার জন্য অপেক্ষা করছি। ফুটপাতে একটা পানের দোকানে রেডিওতে অনুষ্ঠান শোনা যাচ্ছে। নারীকণ্ঠ ভেসে এলো– ‘হ্যাল্লো লিসেনার কেমন আছেন আপনাড়া’ (‘র এর উচ্চারণ ড়’ এর মতো) ‘আই থিং আপনাড়া ভালোই আছেন। এবার আমি আপনাদেড় জন্য একটা সং প্লে করবো...’

রেড়িওতে গান শুরু হয়েছে। বাদ্যযন্ত্রের কর্কশ আওয়াজে গানের ভাষা বুঝতে পারছি না। অবশ্য আমি গানের ভাষার চেয়ে ঘোষিকার মুখের ভাষা নিয়ে বিচলিত হয়ে উঠলাম। আমি আপনাদের জন্য এখন একটা সং প্লে করবো... এটা তো একটা ভাষাকে গলা টিপে মেরে ফেলার লক্ষণ। এখানে ‘আমি এখন আপনাদেরকে একটা গান শোনাবো’ বললে কী এমন ক্ষতি হতো? পত্রিকায় তথ্যপ্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের একটি বিবৃতি পড়েছি। তিনি ‘বাংরিজ ভাষা’ পরিহার করার জন্য সকলকে পরামর্শ দিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন তার এলাকার সমস্ত সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার নির্দেশ দিয়েছেন। এই ফেব্রুয়ারিতে ভাষার মাসে মাতৃভাষার মর্যাদার রক্ষায় আরও হয়তো অনেক উদ্যোগের কথা শুনবো। কিন্তু এবারও কি সবকিছুই ‘কথার কথা’ বলে ফাইলে চাপা পড়ে যাবে! মাতৃভাষার কান্না কি শেষ পর্যন্ত থামবে না?

লেখক: সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ