X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যারিস্টার মইনুলের বিচার চাই

প্রভাষ আমিন
১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:২৩আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:৪৪

প্রভাষ আমিন গত ১৩ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ‘সুপুত্র’ হিসেবে। শুনে আমার হাসি পেয়েছে। আমি কখনও কাজ করিনি, কিন্তু যারা একসময় ইত্তেফাকে কাজ করেছেন, তারা জানেন তিনি কতটা ‘সুপুত্র’। ইত্তেফাকের দখল নিয়ে মানিক মিয়ার দুই ছেলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব একসময় দেশের গণমাধ্যমে গভীর অস্বস্তি তৈরি করেছিল। ব্যারিস্টার মইনুল তার ভাইকে যে ভাষায় গালি দেন; সেটা ভাইকে নয়, কলঙ্কিত করে তার মাকেই। শ্রদ্ধেয় মানিক মিয়া বেঁচে থাকলে ব্যারিস্টার মইনুলকে সুপুত্র হিসেবে স্বীকার করতেন কিনা সন্দেহ। দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বে ভেঙে যায় ইত্তেফাক। ভাগাভাগিতে লোভী ব্যারিস্টার মইনুল নিয়েছিলেন জমি আর ভবন। আর তার ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বাবার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে শুধু ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ লোগোটি নিয়েছিলেন। একসময় ইত্তেফাকের সাংবাদিক-কর্মচারী এবং গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরাই ব্যারিস্টার মইনুলকে চিনতেন। আমি মনে করি ১/১১-এর পর গোটা জাতিই তাকে ঘৃণা করে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বাংলাদেশের প্রথম সংসদের সদস্য ছিলেন। তার মতো একজন নোংরা মানুষকে কেন আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছিল, সেটা আমার অনেক দিনের কৌতূহল। অবশ্য আওয়ামী লীগের মনোনয়নে বিভিন্ন সময়ে অনেক নোংরা মানুষ, মাস্তান, চাঁদাবাজ সংসদ সদস্য হয়েছেন। তবে ব্যারিস্টার মইনুলের মনোনয়ন রহস্য শুনলাম দুদিন আগে। ব্যারিস্টার মইনুলের মা বঙ্গবন্ধুকে ছেলের মনোনয়নের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কৃতজ্ঞ ও উদার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মানিক মিয়ার স্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। অনুরোধে এমন অনেক ঢেঁকি গিলতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। পল্লীকবি জসীমউদদীনের অনুরোধে তার জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই দুই অকৃতজ্ঞ ব্যারিস্টার এখন বঙ্গবন্ধুর ঔদার্যের কী প্রতিদান দিচ্ছেন, জাতি তা দেখছেন।

৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও ’৭৫ সালেই বাকশাল করার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল। তখন অনেকেই তার সাহসের তারিফ করেছিল। কিন্তু নিজের আসল চেহারা দেখাতে একদম সময় নেননি এই ব্যারিস্টার। ৭৫-এর  ১৫ আগস্টের পর তিনি বনে যান খন্দকার মুশতাকের ঘনিষ্ঠ সহচরে। এই সেদিনও তিনি বলেছেন, ৭৫’র ১৫ আগস্টে নাকি রাস্তায় বেরিয়ে তিনি স্বস্তির ভাব দেখেছিলেন।

তবে ব্যারিস্টার মইনুলের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছে ১/১১ সরকারের সময়। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মানসপুত্র বারিস্টার মইনুল মাঠে নেমেছিলেন দেশ থেকে রাজনীতি, গণতন্ত্র দূর করার এসাইনমেন্ট নিয়ে। দুই নেত্রীকে মাইনাস করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন মইনুলরা। বেগম খালেদা জিয়া আজ  যে মামলায় কারাভোগ করছেন, সেটি কিন্তু ব্যারিস্টার মইনুলদের আমলেই করা। এখন তিনি বিএনপির উদ্ধারকর্তা সেজেছেন!

১/১১’র সময় সবচেয়ে সরব ছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল। প্রায় প্রতিদিনই তিনি জাতিকে সবক দিতেন। অবাক হয়ে তার চোটপাট দেখতাম। ভাবতাম, নিশ্চয়ই একদিন এই ব্যারিস্টারকে লোকজন জবাব দেবে, প্রকাশ্যে ঘৃণা করবে। কিন্তু হায়, সেই ব্যারিস্টার এই দেশে আবার বড় বড় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। বিরাজনীতিকরণের কুশীলবের কণ্ঠে এখন গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না। ব্যারিস্টার মইনুলকে দেখলে বুঝি আমাদের স্মৃতি কত স্বল্পস্থায়ী, আমরা অবলীলায় কত কিছু ভুলে যাই।

১/১১’র পর দীর্ঘ শীতনিদ্রায় ছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল। হঠাৎ গত ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশে ব্যারিস্টার মইনুলকে দেখে শঙ্কিত হই। ১/১১-এর কুশীলবরা আবার তাহলে মাঠে নেমেছে। এমনিতে সরকারের বিরুদ্ধে বি. চৌধুরী আর ড. কামালের বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা লক্ষ্য করছিলাম কৌতূহল নিয়ে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের ঐক্য গড়ার চেষ্টা অস্বাভাবিকও নয়, নতুনও নয়। আমি তাদের উদ্যোগকে বরাবরই স্বাগত জানিয়েছি। কিন্তু এই উদ্যোগে ব্যারিস্টার মইনুলের উপস্থিতি আমার কাছে এক মণ দুধে এক ফোঁটা চনা মনে হয়েছে। এখন দেখছি ঐক্য প্রক্রিয়ায় ব্যারিস্টার মইনুল এক ফোঁটা চনা নন, মনে হচ্ছে পুরো পাত্র চনায় ভর্তি করতেই মাঠে নেমেছেন তিনি। শুরুতে ঐক্য প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত ছিল, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে ঐক্য করবেন না তারা। এ ব্যাপারে অনড় ছিলেন বি. চৌধুরী ও মাহী বি. চৌধুরী। তাই ব্যারিস্টার মইনুল কৌশলে ড. কামালকে বাসা থেকে চেম্বারে নিয়ে গিয়ে বি. চৌধুরীকে তার বাসার সামনে থেকে ফিরে যেতে বাধ্য করেন। অপমানিত বি. চৌধুরী শুধু কামাল হোসেনের বাসার সামনে থেকে নন, ফিরে যান ঐক্য থেকেও। সরকারবিরোধী ঐক্যের শুরুটা যিনি করেছিলেন, সেই বি. চৌধুরীকে ছাড়াই তড়িঘড়ি করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ব্যারিস্টার মইনুলের চেষ্টায়ই বিএনপি ২০ দলীয় জোটে জামায়াতকে রেখেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেওয়ার সুযোগ পায়।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি রাজনৈতিক জোট। কিন্তু রহস্যজনক দুই অরাজনৈতিক ব্যক্তি এই ঐক্যের মূল ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছেন। একজন আত্মস্বীকৃত অসুস্থ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। অপরজন এই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। এই জোটে জামায়াতের আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণ নেই। কিন্তু যে কৌশলে বি. চৌধুরী ঐক্যফ্রন্টের বাইরে রাখা হলো, তাতে বোঝা যাচ্ছে জামায়াতের স্বার্থটা ভালোভাবেই রক্ষা করতে পারছেন ব্যারিস্টার মইনুল। তার জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অসংখ্য উদাহরণ ইউটিউবে আছে। তিনি বিভিন্ন সময়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সম্মেলনে গিয়ে লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে এসেছেন। সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক মাসুদা ভাট্টি এই প্রশ্নটাই করেছিলেন তাকে। মঙ্গলবার রাতে ৭১ টিভির টকশোতে মাসুদা ভাট্টি ব্যারিস্টার মইনুলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি ঐক্যফ্রন্টে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করেন কিনা। তিনি বলতে পারতেন, না করি না। কিন্তু তিনি তা না করে মাসুদা ভাট্টিকে ‘চরিত্রহীন’ বলে গাল দিয়ে দেন। আমরা জানি, কারো যখন যুক্তি ফুরিয়ে যায়, তখনই তিনি গালি দেন। যিনি ছাত্রশিবিরের অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা দেন, তাকে জামায়াতের প্রতিনিধি মনে করাটা অন্যায় নয়। মাসুদা ভাট্টি একজন সুপরিচিত সাংবাদিক। তিনি জাতীয় দৈনিক আমাদের অর্থনীতির সিনিয়র নির্বাহী সম্পাদক। তিনি লেখালেখি করেন। সেটা না হলেও কোনও নারীকে ‘চরিত্রহীন’ বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নারীকে কীভাবে সম্মান দিতে হয়, এটা বোধহয় জানেনই না মানিক মিয়ার ‘সুপুত্র’ ব্যারিস্টার মইনুল। অবশ্য ব্যারিস্টারি কোর্সের পাঠ্যক্রমে নারীকে সম্মান দেওয়া, মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়গুলো হয়তো পড়ানো হয় না। অবশ্য যিনি নিজের মাকে সম্মান দিতে জানেন না, তার কাছ থেকে নারীর প্রতি সম্মান আশা করা আর কাঁঠাল গাছে আম চাওয়া একই কথা। তবে ব্যারিস্টার সাহেব নিশ্চয়ই এটা জানেন, একজন নারীকে লাইভ অনুষ্ঠানে ‘চরিত্রহীন’ বলা যৌন হয়রানির মধ্যেও পড়ে। এটা কোন ধারায় অপরাধ, সেটাও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনেরই ভালো জানার কথা। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(১) ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন  করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করলে তার অনধিক ৩ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একজন সম্মানিত নারীকে ‘চরিত্রহীন’ বলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দুটি অপরাধ করেছেন। একজন নারীর প্রতি যৌন হয়রানিমূলক শব্দ প্রয়োগ এবং একজন মানুষকে অপদস্থ করা। আমি চাই দুটি আইনেই তার বিরুদ্ধে মামলা করা হোক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের আশঙ্কায় আমরা উদ্বিগ্ন। কিন্তু ব্যারিস্টার মইনুলের মতো লাগামহীন মানুষের জন্যই এ ধরনের আইন দরকার। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনের সঠিক প্রয়োগ চাই।

মাসুদা ভাট্টিকে গাল দেওয়ার প্রতিবাদে নারী সাংবাদিকরা বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এটা নিছক নারী ইস্যু নয়। মানুষের মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে আমাদের সবাইকে প্রতিবাদ জানাতে হবে। গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকবে। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি থাকবে, প্রশ্ন থাকবে, উত্তর থাকবে। কিন্তু গালি থাকবে না, ব্যক্তির চরিত্র হনন থাকবে না, নারীর অমর্যাদা থাকবে না।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ