X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নুর: এ যুগের ‘কালিয়া’?

আহসান কবির
২৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:২৬আপডেট : ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৩:৪৬

আহসান কবির

‘৯’ সংখ্যাটা এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভিপি নুরুল হক নুরের জন্য ‘কমন’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন নবম বারের মতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন, ঠিক তেমনি নুরের ওপর হামলাও হয়েছে ‘নয় বার’! এরমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই পাঁচবার মার খেয়েছেন নুর। ভবিষ্যতের ব্যাপারটা এখনও বলা যাচ্ছে না। ফেসবুকে বরিশাল অঞ্চলের কিছু মানুষ রাগে ক্ষোভে দুঃখে এই মারের নাম দিয়েছেন ‘বিলাইছ্যাচা’! (নুরের বাড়িও সম্ভবত পটুয়াখালীর দিকে) নুরের ওপর নবম বারের হামলার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে—মারার সময় পরিবেশ তৈরি করে নিতে প্রথমে আলো নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। এরপর প্রমাণ গায়েব করতে ডাকসু ভবনকে ঘিরে সব সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব করে দেওয়া হয়েছে (এখনও এই বিষয়টি অভিযোগ আকারে বলা হচ্ছে)।

বাংলা ও হিন্দি ছবির অনেক কমন ডায়ালগের মধ্যে একটা এমন–‘মারো,আমাকে আরও মারো, মারতে মারতে আমাকে মেরে ফেলো!’ নায়ক ও নায়িকার প্রেম জানাজানি হয়ে গেলে বাবা বা ভাই কিংবা সিনেমার ভিলেন যখন মারতে থাকে, তখন নায়ক বা নায়িকার জবাব এমনই হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরের অবস্থা এখন এমনই। কাউকে যদি মারতে ইচ্ছে হয় এবং হাতের সামনে কাউকে না পেলে সম্ভবত নুরকে মেরে হাতের জ্বালা জুড়ানো যাবে। কারণ নয় বার মার খাওয়ার পরেও এজন্য কেউ শাস্তি পেয়েছেন, এমনটা শোনা যায়নি। যদিও এই প্রথম নুরকে মারার অপরাধে দুজন গ্রেফতার হয়েছেন, রিমান্ডও মঞ্জুর করেছেন আদালত।

১৯৯০ সালে সাদ্দামের ইরাক কুয়েত আক্রমণ করে দখল করে নিলে সাদ্দামের (দীর্ঘদিন ধরে ইরাক শাসন করা এই ভদ্রলোক পরে আমেরিকার আগ্রাসনের শিকার হন এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার বিচার কার্যকর করা হয়) নাম হয়ে যায়—‘মার সাদ্দাম’। কোথাও কোথাও মজা করে এখনও বলা হয়—‘মার বদি’। মজার ব্যাপার নুরকে নবম বার মারের সময় ‘সাদ্দাম’ নামে একজন কলকাঠি নেড়েছেন, এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। ত্রিশ জনকে লোহার রড, বাঁশ দিয়ে মারা হলেও একজনকে ডাকসু ভবনের ছাদ ফেলে দেওয়া হয়। নুরকে মারার আগে ডাকসু ভবনে নুরের রুমটা অন্ধকার করে নেওয়া হয়েছিল। সম্ভবত আলো-আঁধারিতে চাইনিজ রেস্টুরেন্টের খাবার, মদের বারের পরিবেশ ও মারপিটটা ভালো জমে।

ঘটনাটা ছোট্ট করে বলে ফেলা যায়। ভিপি নুর ১৭ ও ২২ ডিসেম্বর অষ্টম ও নবম বারের মতো আক্রান্ত হন। সারা ভারত এখন নরেন্দ্র দামোদর মোদি সরকারের পাস করা নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। মোদির এই নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে ডাকসু ভিপি নুর। দুই-দুইবার আক্রান্তও হয়েছেন। দুই বারই তাকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চে’র ব্যানারে কয়েকজন ছাত্র পিটিয়ে আহত করেছেন। প্রায় সব পত্রিকা, অনলাইন ও টেলিভিশনের খবর অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ব্যানারে কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী এই হামলায় অংশ নিয়েছিল। বিশেষ করে ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জীব চন্দ্র দাসের নেতৃত্বে কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী লাঠি, লোহার রড ও বাঁশ দিয়ে নুর ও তার সঙ্গে থাকা ছাত্র সংরক্ষণ অধিকার পরিষদের কর্মীদের ওপর হামলা চালান। আবারও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় সেই ডায়ালগ—‘মার সাদ্দাম’! কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর আহতদের দুজনকে রাখা হয়েছিল আইসিইউতে।এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা ও খুন অনেক হয়েছে। তবে ডাকসু ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া ও সিসিটিভির ফুটেজ গায়েব করে ফেলার ঘটনা অভিনব। সম্ভবত এবারই প্রথম। হামলার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, নুরের সঙ্গে বহিরাগতরা ছিল আর বরাবরের মতো বলা হয়েছে, নুরের সঙ্গে শিবিরকর্মীরাও ছিলেন! মাত্র কয়েকদিন আগে ভিন্নমত প্রকাশের কারণে শিবিরকর্মী আখ্যা দিয়ে বুয়েটে আবরারকে হত্যা করা হয়েছিল এবং যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, তারা সবাই ছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। আবরার হত্যার পর জানা যায় তার পিতাসহ পরিবারের সবাই দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের সমর্থক।

আবারও নুর এর ঘটনায় ফেরা যাক।হামলার কারণে যা যা ‘ঘটমান’ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে তা এমন–

এক. যে কাউকে হত্যা বা মারপিট করার আগেই ‘শিবির’ নামটা জুড়ে দিলেই হবে। সম্ভবত শিবির নাম দিয়ে মারার এখতিয়ার শুধুমাত্র ছাত্রলীগকর্মীদের! তবে এই অধিকার ছাত্রলীগ নামধারী কিছু কর্মীদের কে বা কারা দিয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি! আবরারের কথা বাদ দিলেও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের শিকার বিশ্বজিৎ কিন্তু শিবিরের কেউ ছিলেন না।

দুই. আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার ক্লাবগুলোয় শুদ্ধি অভিযানের পর জানা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের নামে যে ক্লাব, সেখানেও ক্যাসিনো ছিল। সেখানে জুয়াও খেলা হতো নিয়মিত। মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের একজন কোচ একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে দুঃখের সঙ্গে বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামের ক্লাবে ক্যাসিনো চালু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরে রাজাকারদের যে তালিকা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করা হয়, সেখানে ভাতাপ্রাপ্ত ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামও পাওয়া যায়, দেশব্যাপী ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ফলে সেই তালিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ ও স্থগিত করা হয়।

শেষমেষ নুরদের মারপিট করার জন্য আলোচনায় আসে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সম্মানিত ও অভিজাততম শ্রেণির মানুষ। তালিকার নামে, ক্লাবের নামে কিংবা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করার জন্য তাদের নাম ব্যবহার যারা করছে বা ভবিষ্যতেও করবে, তাদের কঠোর বিচার হওয়া উচিত।

তিন. ‘মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আ ক ম জামালউদ্দীন এবং সদস্য সচিব আসিকুর রহমান খান (সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ছেলে) যারা হামলায় জড়িত ছিল, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুনকে কয়েক মাস আগেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে জানা গেছে। যদিও নুরকে মারপিট করার সর্বশেষ ঘটনায় আল মামুন ও আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিন্তু দেশের একাধিক বিশিষ্টজনেরা ‘মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ’ এমন নাম ব্যবহার করে এই অপকর্ম করার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

চার. সাধারণ মানুষ যদি সরকারি ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন কর্মীর কারণে একথা বিশ্বাস করে যে, ‘ক্ষমতাসীনদের সহযোগী হওয়ার কারণে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে কোনও অপকর্ম করে পার পাওয়া যায়, কোনও রকম বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না’–তাহলে বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি একদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্যই বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে।

সবশেষে বাংলা ছবির ‘বাস্তবতা’র একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। সম্ভবত ছবির নাম ‘কালিয়া’ এবং অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা অভিনেতা জসীম। জসীমের একটা বিখ্যাত ডায়ালগ ছিল—‘আমি কালু। খুব সাধারণ একজন কালু। ওরা আমাকে মারতে মারতে কালিয়া বানিয়েছে। প্রতিশোধের আগুন বুকে নিয়ে আমি এখন কালিয়া হয়ে জীবন কাটাচ্ছি!’ বাংলা ছবির ‘ফর্মুলা’ আক্রান্ত এমন গল্পে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক ছবি নির্মিত হয়েছে। ছবির আর বাস্তবতা হয় তো এক নয়।

তবু মার খেতে খেতে নুরুল হক নুর এখন ডাকসুর ভিপি। ‘কালিয়া’র মতো নুরকে যারা ‘নুর’ বানিয়েছে, ফর্মুলা অনুযায়ী নুর একদিন তাদের বিপক্ষে দাঁড়াবে। এরপর বাংলা ছবির বাস্তবতা অনুযায়ী প্রতিশোধের চূড়ান্ত মুহূর্তে আলো নিভিয়ে দিয়ে আমাদের অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর ফেলে দেওয়া হবে ছাদ থেকে।

সেদিন আইসিইউতে সিট পাওয়া যাবে তো?
লেখক: রম্য লেখক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ