X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আসামে মাদ্রাসা কেন বন্ধ করছে বিজেপি?

আনিস আলমগীর
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:২৯আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:৩১

আনিস আলমগীর আসামের বিজেপি দলীয় রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা কিছুদিন আগে মাদ্রাসাগুলোর শুক্রবারের সাপ্তাহিক ছুটির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। এখন বলছেন, সরকারি মাদ্রাসাগুলো আগামী ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ করে দিয়ে সরকারি মাদ্রাসা এবং সংস্কৃত টোলগুলোকে স্কুলে রূপান্তর করবেন। আসামের সরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা ৪২৩টি, আর টোলের সংখ্যা ৯৭টি। মাদ্রাসাগুলোতে হাজার হাজার ছাত্র লেখাপড়া করে, কিন্তু টোলগুলোতে ছাত্র নেই বললেই চলে। কারণ বর্তমান যুগে হিন্দু ছাত্রদের সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার আগ্রহ নেই। এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, বেসরকারি মাদ্রাসার ওপরও খড়্‌গ চাপছে।
আসামের এই শিক্ষামন্ত্রী আসামে নাগরিকপঞ্জির বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এখন যখন দেখছেন তালিকা থেকে বাদ পড়া, মানে নাগরিকত্বহীন ১৯ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ৬ লাখ মুসলমান, তখন পুনরায় নাগরিকপঞ্জি করার দাবি তুলেছেন। প্রথম নাগরিকপঞ্জি হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। এখন সুপ্রিম কোর্ট বলছে, আর কোনও নাগরিকপঞ্জির প্রয়োজন নেই।

ব্রিটিশ সরকার কলকাতায় হিন্দু কলেজ (যা এখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছর আগে আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিল (এখন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়)। সব সময় আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন ইংরেজ। তাদের শিক্ষার কারিকুলাম ছিল আধুনিক। আসামের মাদ্রাসাগুলোকেও স্বাধীনতার পর আরও আধুনিক করা হয়েছে, যে কারণে এই মাদ্রাসাগুলোতে হিন্দু শিক্ষার্থীরাও লেখাপড়া করে।

টোলগুলো বন্ধ করার একটা যুক্তি থাকতে পারে, কারণ টোলগুলো যুগ উপযোগিতা হারিয়েছে। এই শিক্ষাকে সংস্কার করে যুগোপযোগী করার কোনও উদ্যোগ হিন্দু সংস্কারকরা নেননি, তারা ছিলেন ধর্ম সংস্কারে ব্যস্ত। শ্রীচৈতন্যদেব না হলে হিন্দুধর্মই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় বিলীন হয়ে যেতো। তার ভক্তি আন্দোলন হিন্দু সমাজকে রক্ষা করেছিল। চৈতন্যদেবের সংস্কার আন্দোলনে কোনও ভেদাভেদ ছিল না—যিনি উত্তম তিনি ব্রাহ্মণ।

ইউরোপে খ্রিষ্টধর্মের প্রসারের চাপে তার আগের প্যাগান ধর্ম বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু ভারতে ইসলাম ধর্মের বিস্তারের ফলে হিন্দুধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়নি। কারণ ভারতবর্ষে ইসলামি শাসকরা তলোয়ার নিয়ে কাউকে ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করেনি। স্বামী বিবেকানন্দ তার মাদ্রাজের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘ভারতে মুসলিম বিজয় পিছিয়ে পড়া ও দরিদ্র বর্গের কাছে মুক্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল। এ কারণে আমাদের দেশবাসী এক-পঞ্চমাংশ মুসলমান হয়ে গেছেন। তলোয়ারের বলে এমনটা হয়নি। এর পেছনে কেবল অস্ত্র আর অগ্নিসংযোগের ভূমিকা মনে করা নিতান্ত বাতুলতা মাত্র।’ তিনি অন্য এক জায়গায় বলেছেন, ‘জমিদার ও পুরোহিতদের দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভের জন্য তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।’

যাক, আসাম অনাবাদি জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা ছিল। ব্রিটিশরা বাঙালিদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসাম আবাদ করেছিল। মৌলভি সাইয়্যিদ স্যার মুহাম্মদ সাদুল্লা এবং গোপীনাথ বোর্দোলাই যখন আসামের প্রিমিয়ার ছিলেন, তখন থেকে ‘বাঙাল খেদাও’ আন্দোলন শুরু করে অসমিয়রা। গণভোটের মাধ্যমে যদি সিলেট আসামের সঙ্গে থেকে যেতো তবে আসামে অসমিয়রা মাইনরিটি হয়ে যেতো আর বাঙালিরা তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ হতো। এই ভয় অসমিয়দের এখনও পিছু ছাড়ছে না।

সিলেটের গণভোটের সময় গোপীনাথ বোর্দোলাই আসামের প্রিমিয়ার ছিলেন। আর তলে তলে তিনি ‘কুড়াল’ মার্কা জিতে যাক তাই কামনা করেছিলেন এবং গোপনে সহায়তা করেছিলেন। গণভোটে পাকিস্তানের মার্কা ছিল কুড়াল আর ভারতের মার্কা ছিল কুঁড়েঘর। ভারতের একমাত্র রাজ্য আসাম যেখানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার চেয়ে সেখানে দাঙ্গা হয় বাঙাল আর অসমিয়দের মধ্যে।

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, নাগরিকপঞ্জি সারা দুনিয়ায়, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে বিরাট এক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ভারতের ১৩০ কোটি লোকের বাজারের লোভ সংবরণ করে তা তারা প্রকাশ করেছেন। ভারতের প্রগতিশীল মানুষ মনে করেছিল এতে ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর চৈতন্য ফিরে পাবে। কিন্তু আসাম সরকারের মাদ্রাসা বন্ধের সিদ্ধান্তে মনে হচ্ছে বিজেপি তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ রয়েছেন। তারা লোক দেখানো ৯৭টি সরকারিভাবে চালানো টোল বন্ধ করেছেন, অথচ এসব টোলে শিক্ষার্থী নেই, ছাত্র-ছাত্রীর চেয়ে শিক্ষক বেশি।

সংস্কৃত ভাষা প্রায় অচল হয়ে গেছে। বিশ্বের কোথাও এই ভাষা কোনও কাজে আসে না। অথচ আরবি ভাষা বিশ্বের বেশকিছু সমৃদ্ধ দেশসহ ২৫টি দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা। বলার দিক থেকে বিশ্বের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম এবং ৪২০ মিলিয়ন লোকের মুখের ভাষা। দুটিকে এক নজরে দেখা তো ঠিক নয়। আর ভারতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে হাজার  হাজার মাদ্রাসা রয়েছে। দেওবন্দ, শাহারানপুর, নদোয়াসহ ভারতের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা/ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে শত শত বিদেশি ছাত্র লেখাপড়া করতে যায়। নতুন দিল্লি সংলগ্ন জামিয়া নগরে শান্তিনিকেতনের আদলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হোসেন ১৯২৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

প্রচলিত আছে, কোরআন নাজিল হয়েছে মক্কায়, কোরআনকে সুর করে পড়তে শিখিয়েছে মিসরীয়রা আর কোরআনকে গবেষণা করে মগজে ধারণ করেছে ভারতীয়রা। শত শত বছর ধরে যার চর্চা হয়ে আসছে এই উপমহাদেশে, এই হিমন্ত বিশ্বশর্মা তাকে ধ্বংস করার হীন প্রচেষ্টায় আছে, ধরে নিতে হবে।  ভারতীয়রা ভারত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অন্যত্র কোনোখানে যায়নি। ভারতীয়দের কাছে ভারতই তাদের বিশ্ব। গ্রিক পুরাণে আছে ইউরোপের পশ্চিম প্রান্তে নাকি একটি ফলক ছিল তাতে লেখা ছিল, এরপরে বিশ্ব শেষ। ভারতীয়রা অবশ্য সেই রকম কোনও ফলক লেখা ছিল বলে কোথাও দেখেনি।

দলে দলে ম্লেচ্ছরা মানে অহিন্দু বা বৈদেশিক জাতি ভারতে এসেছে, কিন্তু কেউই স্থায়ীভাবে বসবাস করেনি। অবশ্য তাদের মধ্যে মুসলমানেরা ভারত ছেড়ে যায়নি, তারা স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করেছিল। তারা ভারতকে অনেক কিছু দিয়েছে, আবার ভারত থেকে অনেক কিছু নিয়েছে। ভারত যদি বিভক্ত না হতো, তবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর ভারত মিলিয়ে মুসলমানদের সংখ্যা হতো এখন প্রায় ৭০ কোটি; সংখ্যায় ১০০ কোটি হিন্দুর কাছাকাছি। সম্ভবত  মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী প্রমুখ ভারত বিভক্ত হলে মুসলমানেরা অসহায় হয়ে পড়বেন বলেই ভারত বিভক্তি চাননি। ভারতীয় মুসলমানেরা পাকিস্তান চাইলে তো তারা তখনই পাকিস্তানে যেতেন, মোদি-অমিত শাহের প্রতিনিয়ত তাদের পাকিস্তান পাঠানোর হুমকির দরকার হতো না।

ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলমান জনগোষ্ঠী এখন ভারতে বাস করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংখ্যার সংখ্যালঘু ভারতেই আছে। সেখানে হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে বলে প্রায় ২০-২৫ কোটি ভারতীয় মুসলমান উদ্বিগ্ন হচ্ছে সত্য কিন্তু অসহায় বোধ করার মতো সংখ্যা নয় এটি। তার প্রমাণও বিজেপি সরকার পাচ্ছে। ভারত বিভক্তির পর ভারতীয় মুসলমানেরা নির্বাক ছিল, বিজেপির কারণে তারা এখন আর নির্বাক নেই। মিছিল-মিটিংয়ে তারা মুখর হয়ে উঠেছে। তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে অসাম্প্রদায়িক হিন্দু, শিখ ও অন্য ধর্মাবলম্বীরা। গত ডিসেম্বর থেকে দিল্লির শাহীনবাগে অব্যাহতভাবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে জমায়েত চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে এই সর্ব ধর্মীয় সম্প্রীতির চিত্র ফুটে উঠছে।

সারা ভারতের মানুষ এনআরসি, এনসিএ’র বিরুদ্ধে লড়ছে। বিজেপির বোঝা উচিত মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করতে চাইলে, মাদ্রাসা শিক্ষা ধ্বংস করতে চাইলে, জামিয়া এবং আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রসিদ্ধ মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ চালালে, ভারতের বিবেকবান সব নাগরিক এর বিরুদ্ধে সংহতি প্রকাশ করবে। সুতরাং মাদ্রাসা বন্ধের উদ্যোগ থেকেও তাদের বিরত থাকা উচিত।

এখন হিন্দু মৌলবাদীরা প্রশ্ন তুলতে পারে, এসব তো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের মাথাব্যথা কেন? মাথাব্যথার কারণটা বলে দিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক করণ থাপর। তিনি হিন্দুস্তান টাইমসে তার সাম্প্রতিক কলামে লিখেছেন, ‘আপনি যদি গরুর মাংস বিক্রির জন্য গণপিটুনির আতঙ্কে থাকা একজন ভারতীয় মুসলিম হন, হিন্দু নারীর প্রেমে পড়ায় ‘লাভ-জিহাদে’ অভিযুক্ত হন অথবা নাগরিকত্ব হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন, তাহলে সহজেই সীমান্ত পার হয়ে ওপারে (বাংলাদেশে) চলে যেতে প্রলুব্ধ হতে পারেন।’ আমরা আতঙ্কিত যে কারণে তা হলো—১২ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে যেখানে আমরা হিমশিম খাচ্ছি, ভারত থেকে আসা বাড়তি মুসলমান আপ্যায়নের সামর্থ্য আমাদের নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
‘ডে আফটার টুমরো’ নয়, টুডে
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ