X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুবিধা

প্রভাষ আমিন
০২ মার্চ ২০২০, ১৬:৩৬আপডেট : ০২ মার্চ ২০২০, ১৬:৪৭

প্রভাষ আমিন একটা সময়ে বাংলাদেশ ছিল অন্ধকারে। অন্ধকার মানে দিনের বড় একটা সময় বিদ্যুৎ থাকতো না। লোডশেডিং তখন ছিল নিত্যদিনের দুর্ভোগ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার নজর দেয় বিদ্যুতের দিকে। শুরু হয় অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা। যেকোনও মূল্যে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানই ছিল প্রথম লক্ষ্য। সরকারও চড়া মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। সে লক্ষ্যে সাধারণ মানুষ সানন্দে সায় দিয়েছে। অন্ধকারের দুঃসহ অভিজ্ঞতা থেকে মুক্তি পেয়ে আলোকিত বাংলাদেশের আনন্দটা তারা পেয়েছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশের মানুষ আলোয় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন আর কিছুতেই তাকে অন্ধকার সময়ে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। আলো ভালো। কিন্তু ভালোরও তো একটা সীমা আছে। বিদ্যুৎ মূল্যবান। কিন্তু সেটা তো সামর্থ্যের মধ্যে থাকতে হবে। বছর বছর বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তো ঝলমলে আলোকেও অন্ধকারের চেয়েও বেশি কালো মনে হবে। কারণ আলোটা যে কিনতে হয় চড়া দামে।
বাংলাদেশে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর একটা দারুণ পদ্ধতি আছে। সরকার চাইলেই দাম বাড়াতে পারে না। উৎপাদকদের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হলে তারা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসিতে আবেদন করে। সে আবেদনের ব্যাপারে বিইআরসি গণশুনানির আয়োজন করে। শুনানির ৯০ দিনের মধ্যে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত জানায়। কী চমৎকার গণতান্ত্রিক, জনসম্পৃক্ত ব্যবস্থা। শুনতেও ভালো লাগে। আর গণশুনানিতে পক্ষ-বিপক্ষের প্রবল উপস্থিতি, যুক্তি-তর্ক দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। যারা দেশে গণতন্ত্র নেই বলে গলা ফাটান, তারা বিইআরসির শুনানিতে গিয়ে দেখতে পারেন। তবে মজাটা হলো, বিইআরসি দুই পক্ষের কথাই শোনে, কিন্তু জনগণের কথা আমলে নেয় না। বিপক্ষে যত যুক্তিই থাক, শেষ পর্যন্ত বিইআরসি দাম বাড়ানোর পক্ষেই অবস্থান নেয়। এ যেন সেই ‘সিংহ আর মেষশাবকের গল্প’। ‘মেষশাবক যতই উজানে থাকুক, পানি ঘোলা করার দায় নিয়ে তাকে সিংহের খাদ্য হতেই হবে’। সরকার দাম বাড়াবে এটা হলো শেষ কথা। তাহলে আর অত কমিশন, অত শুনানির দরকার কী। কষ্ট করে হাতটা পেছনে নিয়ে খাওয়ার চেয়ে সরাসরি খাওয়াই ভালো। বরং বিইআরসি বন্ধ করে দিলে খরচ কিছু কমবে, তাতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরেকটু কম বাড়ালেও চলবে।

আমি জানি, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে হাজারটা যুক্তি আছে। সব আমরা জানিও না, বুঝিও না। দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার সময় বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল দয়াপরবশ হয়ে সব যুক্তি বলেননি। তিনি জানিয়েছেন, ‘আমদানি করা কয়লার ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য করা হয়েছে, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের ওপর ১০ পয়সা করে ডিমান্ড চার্জ আরোপ করা হয়েছে, অপচয় ব্যয় বেড়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বেড়েছে, এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে, পল্লি বিদ্যুৎ সমিতিগুলোকে তুলনামূলক কমমূল্যে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণ জনগণের কাছে কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।’ সব অকাট্য যুক্তি। প্রতিবারই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় উৎপাদন খরচ সমন্বয়ের কথা বলা হয়। আমি জানি পুরো খরচ সমন্বয় করতে হলে বিদ্যুতের দাম আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশ ছোঁবে। তাই বলে কি বারবার সমন্বয়ের নামে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে? সরকার তো ব্যবসায়ী নয় যে, তাকে লাভক্ষতির হিসাব করতে হবে।

আরও কত অপ্রয়োজনীয় লোকসানি প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন চলছে। সেখানে বিদ্যুতের ওপর বারবার চাপ দিতে হবে কেন? জনস্বার্থে সরকার অনেককিছুর ওপর ভর্তুকি দেয়। বিদ্যুৎ খাতেও তা দিতে হবে। জনগণের সরকারকে জনগণের কথাই ভাবতে হবে সবার আগে।

তার চেয়ে বড় কথা হলো, দাম না বাড়িয়েও উৎপাদন খরচ সমন্বয়ের আরও অনেক উপায় আছে। বিদ্যুৎ খাতে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি, সঠিক নীতি গ্রহণ না করা, অপচয়, সিস্টেম লসের নামে দিনের পর দিন চুরি হচ্ছে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, বিদ্যুৎ খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে দাম না বাড়িয়েও সরকারের ব্যয় বা ক্ষতি কমানো সম্ভব।

২০০৯ সালে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন যেকোনও মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ ছিল, তা সরকার এগ্রেসিভ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল নানানভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা ছিল। সে চেষ্টা সফলও হয়েছে। কিন্তু ১০ বছর পর এসে আজ  পুরো বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। কোয়ান্টিটি হয়েছে, এবার চাই কোয়ালিটি। এখন চাই পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ। চাই সঠিক নীতির বাস্তবায়ন। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দেবেন, আর দাম বাড়িয়ে তার বোঝা চাপিয়ে দেবেন জনগণের কাঁধে; এটা হতে পারে না। ২০০৯ সালে যে ইমার্জেন্সি ছিল, ২০২০ সালে তো একই দোহাই চলবে না। বিএনপি আমলের খাম্বার গল্প আমরা এখনও শুনি। তেমন কোনও গল্প যেন ভবিষ্যতে শুনতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে এখনই।

বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১ মার্চ থেকে, পানির দাম বাড়ছে ১ এপ্রিল থেকে। গতবছরের জুলাইয়ে বেড়েছে গ্যাসের দাম। গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ মিলে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের মানুষের ওপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এই বাড়তি চাপে তাদের হাঁসফাঁস অবস্থা। আয় বাড়ছে না, কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যয়। সরকার তো চট করে দাম বাড়িয়ে তার ব্যয় সমন্বয় করে ফেলে। সাধারণ মানুষ কীভাবে ব্যয় সমন্বয় করবে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিদ্যুৎ ও পানির সামান্য মূল্যবৃদ্ধিতে জনগণের ভোগান্তি হবে না। সামান্য মূল্যবৃদ্ধিতে ভোগান্তি হবে কী হবে না, সেটা আসলে ক্ষমতার উঁচু মহলে বসে বোঝা সম্ভব নয়।’ সামান্য মূল্যবৃদ্ধির কথা শুনে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার কথা মনে পড়লো। ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, ‘মুজিববর্ষে আমরা শতভাগ বিদ্যুতের ব্যবহার নিশ্চিত করতে চাই। প্রতিটি ঘরে আমরা বিদ্যুতের আলো জ্বালাতে চাই। সামনে গরমের সিজন। লোকজন যেন কষ্ট না পায়, তাই আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে চাই। আর সরবরাহ নিশ্চিত করতেই দাম বাড়ানো হয়েছে। একটু কষ্ট হলেও জনগণ এর সুবিধা পাবে।’ বিদ্যুতের দাম বাড়ানোরও একটা সুবিধা আছে, কষ্ট করলে জনগণ সেই সুবিধা পাবে; শুনে বেশ আশ্বস্ত হলাম, ভালো লাগছে। কিন্তু ওবায়দুল কাদের নিশ্চয়ই জানেন বিদ্যুৎ মানেই শুধু লাইট জ্বালানো আর ফ্যান চালানো নয়। যদি তাই হতো, তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর অভিঘাতটা এড়াতে পারতো সাধারণ মানুষ। ফ্যান একটু কম চালিয়ে, লাইট একটু কম জ্বালিয়ে সমন্বয় করতে পারতো। কিন্তু আমাদের সবকিছুর সঙ্গেই বিদ্যুতের গভীর সম্পর্ক। বিদ্যুতের দাম বাড়ার ধারাবাহিক প্রভাব বাজারে পর্যন্ত পড়বে। উৎপাদনে খরচ বাড়বে, পরিবহনে খরচ বাড়বে, সংরক্ষণে খরচ বাড়বে। অর্থনীতির কথা যদি বলেন, উৎপাদন খরচ বাড়লে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। রফতানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিদ্যুতের সর্বগ্রাসী প্রভাবের কারণেই ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়, ‘সামান্য মূল্যবৃদ্ধি’র অভিঘাতটা আর সামান্য থাকে না। ভালো-মন্দটা নিশ্চয়ই সরকার আমার চেয়ে ভালো বুঝবে। তবে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোটিপতি মালিকের কথা ভেবে দাম বাড়াবে, নাকি গরিব মানুষের কথা ভেবে দাম বাড়াবে না; সেটা তার বিবেচ্য। আমি আগেই বলেছি, গত ১০ বছরে ১০ বার দাম বাড়ানোর পরও বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ এখনও বেশি। তাছাড়া সরকারের আয় কমে যাচ্ছে, ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তাই আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য আনতেই হয়তো বিদ্যুতে নজর। কারণ এটা সহজ। আপনি কর আদায় বাড়াতে পারবেন না। কিন্তু বিদ্যুতের বাড়তি দাম আদায় করতে পারবেন। কারণ বিদ্যুতের দাম সামান্য বাড়ালেও সরকারের অনেক লাভ হয়। তবে বিদ্যুৎ খাতের পাশাপাশি সব ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে গরিবের ওপর বাড়তি বিলের বোঝা না চাপিয়েও সরকার নিজেদের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য আনতে পারতো। সেটা অনেক কঠিন। দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট থেকে টাকা নেওয়া অনেক সহজ।

আমরা প্রতিবাদ করতে পারবো, নিন্দা জানাতে পারবো। কিন্তু বিদ্যুতের বাড়তি দাম না দিয়ে তো আর পারবো না। তাই আমি এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুবিধা পাওয়ার আশায় আছি।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ