X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জিরো টলারেন্সের ‘জিরো’ এখনও যথেষ্ট মজবুত নয়

সৈয়দা আখতার জাহান
০৩ মার্চ ২০২০, ১৪:৪৩আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২০, ১৪:৫৫

সৈয়দা আখতার জাহান সম্প্রতি আমেরিকার প্রথম সারির ম্যাগাজিন সিও ওয়ার্ল্ড-এ ‘দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল দেশ বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তবে কেমন আছে এ দেশের সাধারণ মানুষ? উত্তরটা নির্ভর করছে, চারপাশটাকে দুরবিনে দেখবেন... নাকি বাইফোকাল লেন্সে দেখবেন...। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আছে। দলটির ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার। সরকারে এসে আওয়ামী লীগ একে একে মাদক, জুয়া, ধর্ষণের মতো বিষয়ে আলাদা আলাদা করে জিরো টলারেন্স ঘোষণাও করে। কিন্তু গত ছয় মাসে আপনি যদি নিত্যপণ্যের বাজারমূল্য দেখেন, লক্ষ করবেন তা ক্রমশ চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। পণ্যমূল্য নাভিশ্বাস তুলে দিলেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার।
প্রতিনিয়ত এক অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কথা ঘুরেফিরে টিভি টকশো কিংবা গণমাধ্যমে উঠে আসছে। টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা দলটি তবে কেন সিন্ডিকেট খুঁজে পাচ্ছেন না? সত্যি বলতে, আজকাল কালোবাজারিরা কিনে নিয়েছে সব আলোর বাজার। সরকারের জিরো টলারেন্সের ঘোষণা ভাবছে জিরো এখনও যথেষ্ট মজবুত নয়। দুর্নীতি নিয়ে ভাবা হচ্ছে কেবল দিনের বেলায় কিংবা টকশোর টেবিলে, ব্যবসায়ীদের (রাজনীতিক) রাত তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার টেবিলের টালি খাতায় লাভ-ক্ষতির হিসেবে বহাল তবিয়তেই থাকছে। পৃথিবীতে টাকা এমন এক জড় পদার্থ, যার হাত বদল হয়, কিন্তু চরিত্র বদল হয় না। টাকা অর্থমূল্য ধারণ করে কিনা জানি না, তবে ক্ষমতা ধারণ করে বলেই ‘টাকা, টাকা-ই’। তাই হয়তো প্রায়শ দেখি, সার্থক মানুষদের আরও চাই-মুখ!

আজকাল গণমাধ্যম আমাদের সাময়িক উত্তেজনা দিলেও নষ্ট করছে চিরস্থায়ী শান্তি। গণমাধ্যমে প্রচারিত কিংবা প্রকাশিত সংবাদে সিন্ডিকেট হয়ে উঠেছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। যেমন আপাতদৃষ্টিতে সত্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তবু সত্য কথাটির রয়েছে নানা অর্থ। Truth-এরও আছে নানা অর্থ। Fact ও Truth এক নয়। Absolute truth, whole truth, relative truth, partial truth ইত্যাদি কথা চালু আছে। বাংলায় আছে পরম সত্য, আংশিক সত্য, আপেক্ষিক সত্য, পূর্ণ সত্য ইত্যাদি কথা। সবকিছু ছাপিয়ে alternative truth বা বিকল্প সত্যের দখলে আজ  পৃথিবী। বাটলার থিওরি অনুযায়ী, মানসিকতা তৈরিতে সিংহভাগ ভূমিকা রাখে আমাদের সমাজ, আশপাশের প্রচলিত নিয়ম-নীতি। চারপাশটা ভরে যাচ্ছে পেশাদার প্রতারকে। তাই ব্যবস্থা বদলে গেলেই যে অবস্থা বদলাবে, এমনটা নয়। কেননা, জুতা পায়ে পিচ্ছিল পথও নিরাপদ নয়। আমরা বোধহয় রাগ করতেও ভুলে যাচ্ছি, কেননা রাগ হচ্ছে দ্বিতীয় পর্যায়ের অনুভূতি। প্রথমে পর্যায়ের ভয় কিংবা হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারছি না যে। দুঃখ বাঙালিকে দৃঢ় করে না, বরং দ্রবীভূত করে।

ফরাসি সমালোচক ও সাংবাদিক আলফোনেস কার ব্যক্তিচরিত্রের তিনটি রূপের কথা বলেছেন।

প্রথমত, সত্যিকারার্থে ব্যক্তির একটা চরিত্র আছে। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তির নিজের কাছে নিজের একটা চরিত্র আছে। তৃতীয়ত, ওই ব্যক্তির একটা চরিত্র আছে অন্য সবার কাছে। তেমনি রাষ্ট্রেরও রয়েছে নানা রূপ। রাষ্ট্র কী এমন প্রশ্ন করা হলে উত্তরদাতাদের উত্তর একরকম হবে না। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান সবার উত্তর হবে আলাদা। কারণ, রাষ্ট্র নিয়ে সবার অভিজ্ঞতা সমান নয়। অনেকের কাছে রাষ্ট্র সন্ত্রাসী-নির্যাতনকারী-প্রতারক-নিপীড়ক। আবার ক্ষমতাসীনদের কাছে সেই একই রাষ্ট্র ভাসছে উন্নয়নের জোয়ারে। বরাবরই ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রকে ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে, রাষ্ট্র থেকে নিচ্ছে হাজারো রকম সুবিধা। যদিও জনগণকে সবসময়ই বোঝানো হয় তাদের কল্যাণেই রাষ্ট্র। ক্ষমতাসীনদের উন্নয়নের তালিকা দেখে চোখ কপালে উঠলেও গণমাধ্যমের কল্যাণে চোখ আস্তে ধীরে ফিরে যায় নিজের জায়গায়। এ দেশের মানুষের প্রতিবাদও নেই, প্রশ্নও নেই। এ দেশে কে আছে প্রশ্ন করার মতো যে জবাবদিহি থাকবে। সবাই বিশ্বাস করেন, আগে টিকে থাকতে হবে তারপরে প্রতিবাদ করতে হবে।

আমাদের মধ্যে বিভেদ আছে, বৈচিত্র্য নেই। আমরা বলি ভালো অথবা মন্দ, কিন্তু অন্যরকম বলি না কখনও। কেননা, মতভেদ হলেই আমাদের মনোভেদ হয়ে যায়। মত প্রকাশের অধিকার যেমন থাকা দরকার, মত পরিবর্তনের অধিকারও থাকা দরকার। ‘বুমেরাং ইফেক্ট’ বলে একটা টার্ম আছে। খুব সহজ করে বললে বুমেরাং মানে দাঁড়ায় আত্মঘাতী। ধরুন, আপনি কোনও বিষয়ে কোনও ব্যক্তির মতামত কিংবা মনোভাবকে প্রভাবিত করতে চান। সেক্ষেত্রে আপনি যদি বেশি বেশি ভালো ভালো বলেন কিংবা প্রশংসা করতে থাকেন তখন ব্যক্তিটির সেই বিষয়ের প্রতি চূড়ান্ত বিতৃষ্ণা জন্ম নিতে পারে। আগের যেটুকু আন্তরিকতা ছিল তাও চিরদিনের মতো ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়। আপনি প্রভাবিত করার বদলে যেটা করলেন সেটা ব্যর্থ হলো। আমরা দ্বিমত আছে এমন ব্যাপারে কথা বলতে গেলেই অন্যদের ওপর নিজের ধারণা ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি। কোনও বিষয়ে নিজে থেকে বেশি বেশি ভালো তথ্য দিয়ে ব্যক্তির মনোভাবকে নিজের পক্ষের মতের দিতে অনুগামী করতে চায়। ক্ষেত্রবিশেষ ফল পাওয়া গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাপ্ত ফলাফলের সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের সম্পর্ক ঋণাত্মক হতে পারে।

সময় আমাদের মেকি সম্মান আর খাঁটি দারিদ্র্য উপহার দিয়েছে। বিকল্প সস্তা বের করে নেওয়া জাতি আমরা। আধুনিক সভ্যতা না পৌঁছাতে পারলেও, আধুনিক অসভ্যতা রাস্তা বের করে ঠিকই পৌঁছে গেছে সর্বত্র। বিষের ভালো দিক হলো বেদনাকে বিনাশ করে, কিন্তু জীবনটাকেও তো নাশ করে। কেবল মনে হয় ‘আঁধার দেখেছি, রয়েছে আরও বড় অন্ধকার’। সাধারণ অসুখীরা বরং বেঁচে থাকাকে প্রতিনিয়ত অভিসম্পাত করে। অসুখী জীবনে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে মানুষ একসময় অভ্যস্ত হয়ে যায়। যদিও নির্বাক হওয়ার সময় এখনও আসেনি। তবু খাবার গ্রহণ ছাড়া মুখ খুলতে মানুষ একসময় ভুলে যাবে। এমন প্রতিকূল সময়ে প্রতিবাদ করা বৃথা, ন্যায়বিচার আশা করা বোকামি। আগামীতে ভালো থাকার সম্ভাব্যতা থেকে হতাশার ইশারা দেখা যাচ্ছে। অস্বস্তি ক্রমান্বয়ে বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। তাই সাধারণ মানুষ এখন আর সমৃদ্ধি চায় না, সম্মান আর নিরাপত্তা চায়।

কেমন আছেন এ দেশের সাধারণ মানুষ? উত্তরটা হলো, সরকার রেখেছে যেমন।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
হাসিনা-তাভিসিন আন্তরিক বৈঠক, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ৫ দলিল স্বাক্ষর
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
দেশের জন্য কাজ করতে আ.লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ