X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জিনোম সিকোয়েন্সিং, করোনাভাইরাস ও প্রাসঙ্গিক কথা

ড. হোসেন উদ্দিন শেখর
১১ মে ২০২০, ১৫:২২আপডেট : ২২ জুন ২০২০, ১৫:৪৩

ড. হোসেন উদ্দিন শেখর জিনোম শব্দটি  প্রথম ব্যবহার করেন জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হ্যান্স ভিঙ্কলের (Hans Winkler) প্রায় একশ’ বছর আগে, সেই ১৯২০ সালে। জার্মান,  জিন (Gene) আর গ্রিক ওম (ome) শব্দের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল জিনোম শব্দটির। একটি জীব (organism)-এর জিনোম বলতে তার সম্পূর্ণ বংশগতির তথ্য, যা কিনা তার DNA (অথবা কিছু ভাইরাসের জন্যে (RNA)-তে ধারণ করা থাকে, তাকে বোঝায়। এই জিনোমে থাকবে তথ্যবাহী জিন (Gene) ও তথ্যবিহীন অংশ (non-coding sequence)। বলা বাহুল্য, তথ্যবিহীন অংশও কিন্তু ডিএনএ তৈরিকারী বর্ণমালা A, T, G ও C দিয়ে তৈরি। DNA-এর বর্ণমালা এই চারটিই।  A, T-এর সঙ্গে আর G, C-এর সঙ্গে বন্ধনীর মাধ্যম এ যুক্ত হয়ে বেস পেয়ার (base  pair) তৈরি করে। তবে RNA -এর বর্ণমালা A, U, G এবং C। RNA-তে T-এর পরিবর্তে U বর্ণমালাটি ব্যবহৃত হয়। জিনগুলো সজ্জিত থাকে ক্রমোসোমে। তারা পাশাপাশি থাকতে পারে বা তথ্যবিহীন অংশ দিয়ে পৃথক হয়ে দূরে দূরেও থাকতে পারে। জিন নির্ধারণ করে জীবের বৈশিষ্ট্য। যেমন চুলের রং, চোখের রং প্রভৃতি। জিনোম সাধারণত একটি জীবের মৃত্যু পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে! জিনোমের আকৃতি বেস পেয়ার হিসেবে মাপা হয়, আর তা বিভিন্ন জীবের জন্যে বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। যেমন, মানুষের জিনোম সাইজ হলো ৩ বিলিয়ন বেস পেয়ার এবং তা প্রতিটি জীবিত কোষের নিউক্লিয়াসে সংরক্ষিত থাকে। জাপানিজ ফুল প্যারিস জাপোনিকা স্পোর্টস, যার জিনোম সাইজ মানুষের জিনোম সাইজের প্রায় ৫০ গুণ বড়, অর্থাৎ ১৪৯ বিলিয়ন বেস পেয়ার। মেরুদণ্ডসম্পন্ন প্রাণীকুলের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ জেনোমের অধিকারী প্রাণীটির নাম লেওপার্ড লাংফিশ, যা পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকায় পাওয়া যায় আর তার জিনোম সাইজ হলো ১৩৩ বেস পেয়ার। জিনোমকে যদি A, T, G, C বর্ণমালা দিয়ে প্রকাশ করা হয় তাহলে সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স  (whole  genome  sequence) হলো পাশাপাশি রাখা অসংখ্য বর্ণমালা। ২৯ জানুয়ারি ২০২০, ফ্রান্সের পাস্তুর ইনস্টিটিউট করোনাভাইরাস ২০১৯ -nCOV-এর সম্পূর্ণ  জিনোম সিকোয়েন্স করে। এবং ইউরোপে তারাই এই কাজটি প্রথম করার দাবিদার। করোনার জিনোম সিকোয়েন্স করে জানা যায় যে এটি একটি এক সূত্রক পজিটিভ RNA , যা কিনা ৩০০০ (তিন হাজার ) বেস পেয়ার আর সেখানে মোট জিনের সংখ্যা মাত্র ১৫ টি। এরমধ্যে আছে S-জিন, যা কিনা S-প্রোটিনকে কোড করে থাকে। উল্লেখ্য মানুষের জিনের সংখ্যা ৩০ হাজার। এটা বোঝা সত্যি কঠিন কীভাবে ১৫টি জিনসম্পন্ন জীবাণু করোনা এই অতিকায় জিন ভাণ্ডারসম্পন্ন মানুষকে বিনাশ করে দিচ্ছে!

জিনোম সিকোয়েন্সিং করে যে লাভগুলো হতে পারে তা যদি সহজভাবে বলি তা অনেকটা নিম্নরূপ: ১) রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং করে রোগ নির্ণয়কারী kit  তৈরি সম্ভব, ২) প্রতিষেধক ড্রাগ ও ভ্যাকসিন তৈরি সম্ভব, ৩) জীবাণুর সেরোটাইপ  (serotype ) করা সম্ভব, ৪) জীবাণুর উৎস সম্পর্কে তথ্য জানা সম্ভব, ৫) জিনোম অ্যাসোসিয়েশন স্টাডি করে ব্যক্তির জন্যে নির্দিষ্ট ওষুধ (customized medicine) দেওয়া সম্ভব, ৬) স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির জিনোম সিকোয়েন্সিং করে জানা সম্ভব কোন বয়সে তিনি কোনও কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন, জেনে নেওয়া যায় কোন জেনেটিক ভেরিয়েশনের কারণে কখন তার ক্যানসার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ সৃষ্টি হতে পারে। ওপরের কারণগুলো ছাড়াও আরও কারণ আছে যা সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সিং করে জানা সম্ভব। যখন জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয় তখন কিন্তু পুরো জিনোমকে একসঙ্গে সিকোয়েন্সিং করা হয় না। বরং জিনোমকে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে যে DNA খণ্ডগুলো হয় সেগুলোকে সিকোয়েন্সিং করে পরে তাদের সঠিকভাবে পর্যায়ক্রমে জোড়া দিয়ে গোটা সিকোয়েন্সটি পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে এই বিশাল বহরের তথ্য এনালাইসিস করার জন্য বায়োইনফরম্যাটিকসের সাহায্য নিয়ে নির্ভুলভাবে জোড়া লাগানোর কাজটি সম্পন্ন করা যায়।

ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করার  কৌশলের এখন তৃতীয় প্রজন্ম চলছে। প্রথম প্রজন্মে সিকোয়েন্সিং  করা হতো Sanger ও Gilbert সিকোয়েন্সিং প্রণালীতে। ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে Pyrosequencing নামে দ্বিতীয় জেনারেশন সিকোয়েন্সিং শুরু হয় আর বর্তমান তৃতীয় প্রজন্মে Illumina (কোম্পানির দেওয়া বাণিজ্যিক নাম ), shotgun প্রভৃতি প্রণালীর সাহায্যে ডিএনএ/জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়ে থাকে। তবে নতুন নতুন আরও কার্যকর, স্বল্প সময় ও স্বল্প ব্যয়সাপেক্ষ অত্যাধুনিক সিকোয়েন্সিং মেথডস বাজারে আসার প্রহর গুনছে। আধুনিক এই জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রণালীগুলোকে বলা হয় Next  Generation  Sequencing (NGS) methods।

একটি সার্থক জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের পর সচরাচর সেই সিকোয়েন্সটিকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশের জন্যে সংগ্রহশালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৮ সাল থেকে GISAID (Global  Initiative on sharing  all influenza  data) ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সিকোয়েন্স ডাটা সংরক্ষণ করা শুরু করে। এবং পরবর্তীতে তারা SARS-COV-2-এর সিকোয়েন্স ডাটাও সংরক্ষণ শুরু করেছে। এপ্রিল ০১, ২০২০  পর্যন্ত পৃথিবীতে ৩ হাজারের অধিক SARS-COV-2 -এর জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে এবং তা  GISAID-এ জমা পড়েছে । ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোগীর নমুনা থেকে ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করেছে। ইদানীং বাংলাদেশও প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করার। তুলনামূলক জিনোম এনালাইসিস (comparative  genome analysis) থেকে জানা যায় যে SARS-COV-2 , বিটা করোনা (Betacorona  virus) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ভাইরাস। Rhinolopus গোত্রের বাদুড়ে এই ভাইরাসের বসবাস। তাছাড়া Palm Civet নামের ক্ষুদ্রকায় মাংসাশী প্রাণীতেও এর অস্তিত্ব বর্তমান। উল্লেখ্য, বাদুড় অনেক ধরনের বিটা করোনাভাইরাসের পোষক (Host) হিসেবে কাজ করে। এরমধ্যে RaTG13 ভাইরাস ও SARS-COV-2-এর মধ্যে জিনোম সিকোয়েন্সের ৯৬% মিল আছে । ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২০, আমরা জানতে পারি যে বনরুই (Pangolin)-তে এক ধরনের ভাইরাস আছে, যা SARS-CoV-2-এর জিনোম সিকোয়েন্সের অনেক কাছাকাছি। বনরুইতে পাওয়া ভাইরাসের ৯৯% মিল রয়েছে করোনাভাইরাসের ‘S -Protein’  কোডিং সিকোয়েন্সের সঙ্গে। এখানে উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের ক্রাউন গঠনের জন্যে এই স্পাইক বা S-প্রোটিনগুলো দায়ী। এই S- প্রোটিন দিয়ে করোনাভাইরাস মানুষের ACE  2 (Angiotensin Converting Enzyme-2) রিসেপ্টর (এক প্রকার ধারক)-এ সংযোজিত হয়ে এন্ডোসাইটোসিস (endocytosis) অথবা ব্যাপন (diffusion) প্রক্রিয়ায় মানব কোষে প্রবেশ করে। তাই বনরুইতে পাওয়া ভাইরাসটিও যে মানুষকে আক্রান্ত করতে পারবে তা বলা বাহুল্য। জিনোম সিকোয়েন্সিং তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা অনুমান করা যায় যে SARS-nCOV-2 ন্যূনতম দুটি ভাইরাসের সমন্বয়ে গঠিত একটি নতুন ভাইরাস । এই দুটি ভাইরাসের একটি RaTG13 বা তার নিকট গোত্রের কেউ, আরেকটি হচ্ছে বনরুইতে পাওয়া করোনাভাইরাস। এই প্রকারে সৃষ্ট SARS-nCOV-2 নতুন পোষকের (host) সন্ধানে মানুষকে বেছে নিয়েছে। তবে এটি বলা যায় যে এই প্রকারের ভাইরাস তৈরির সময় হয়তো সৃষ্টিকারী দুটি ভাইরাসই একসঙ্গে একটি পোষক (host)-এ সংক্রামিত হয়ে SARS-nCOV-2-এর জন্ম দিয়েছে। এরপরেও অন্তত দুটি প্রশ্ন রয়েই যায়: ১) এই পোষকটি কে, যাতে SARS-nCOV-2 জন্ম লাভ করেছিল, এটা কি বনরুই, বাদুড় না অন্য কেউ?, ২) এই ভাইরাল রিকম্বিনেশন প্রক্রিয়ার অনুঘটক ও নিয়ামকেরই বা কী পরিচয়?  

লেখক: অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, গ্রাজুয়েট বায়োকেমিস্টস অ্যাসোসিয়েশন (GBA)।

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
থাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
পশ্চিমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চীনকে যা করতে হবে
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী মিডফিল্ডারকে নিয়ে দুঃসংবাদ
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
টেবিলে রাখা ‘সুইসাইড নোট’, ফ্ল্যাট থেকে দম্পতির মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ