X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘পৃথিবীটা পাখি, গাছ, মানুষ সবার...’

অঞ্জন রায়
১১ জুন ২০২০, ১২:২৪আপডেট : ১১ জুন ২০২০, ১২:২৫

অঞ্জন রায় আমাদের বাসাটি তিন তলায়। দেয়ালজোড়া জানালাটি বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় সবচেয়ে আগ্রহী করেছিল আমাদের। সেই বড় জানালার পাশেই আছে একটুকরো মাটি, ফুট দেড়েক গভীর। লম্বায় প্রায় বারো ফুট, প্রস্থে ফুট চারেক। করোনাকালের আগে থেকেই বারান্দাটির পাশের একটা ডিভান আমার পাঁচ দশ মিনিটের ফুরসতের ঠিকানা ছিল। এই মার্চ থেকে সব যখন উল্টেপাল্টে গেলো–সময়ের ঘড়ির সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেলো দেহঘড়ি।
উচ্চমাত্রার ব্লাড সুগার আর ঝামেলাযুক্ত লিভারের কারণে কার্যতই গৃহবন্দিকাল। মাঝে কেনা বইয়ের স্তূপ আর ইউটিউবে ডিলান, লালন, কবীর সুমন, কিশোরী মোহন আমনকার। কখনও অফমুড ফেরাতে গোপালভাঁড় বা খটমটে ডকুমেন্টারি। চলছে এভাবেই। সারারাত জেগে ফজরের আজান শেষে আলো আসে–ঘুমোতে যাই। এমনই দিনযাপন।
এমন সময়েই দেখলাম তাকে প্রথম। আগে দুদিন সেই পাবনা শহরে শোনা কৈশোরের গন্ধমাখা ডাক–তারপর তিনি হঠাৎ একদিন এসে বসলেন বারান্দায়। সেখানে বোনা করলা আর বরবটির লতানো পাতায় তিনি তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে বেড়ালেন। দেখলাম–অবিশ্বাস নিয়ে। এই শহরের তিনতলার গ্রিল টপকে একজন টুনটুনির আগমন, তাকিয়ে থাকতে থাকতে অস্পষ্ট হয়ে গেলেন তিনি, প্রথমে বুঝিনি। একটু পর বুঝলাম–ড্রাই আই নামের অসুখে আক্রান্ত দুচোখে জল জমেছে। এটাই কি ভলোবাসা শৈশবের প্রতিনিধির প্রতি, নাকি প্রকৃতির বিজয় নিশান চোখে জল এনে দিচ্ছে?
সেই বারান্দার পাশেই একটা ঝাঁকালো কামরাঙা গাছ। সেখানে আরও বড় বিস্মিত হওয়ার পালা। এখনও ফলগুলো নিতান্ত শিশু, কিন্তু তাদের নিয়মিত খোঁজখবর নিতে প্রায় প্রতিদিনই উপস্থিত হন চার পাঁচজন টিয়ে পাখি। তারা ঝাঁক বেঁধে আসেন, আধাঘণ্টা মতোন প্রবল কলতান শেষে ফিরে যান। আমি রোজ বিকালে তাদের অপেক্ষা করি। আসেন শালিকেরা, বুলবুলি আর অজস্র চড়ুই পাখি। কোথায় যেন আশি দশকের পাবনা শহরের শব্দের মন্তাজ।
রাতেও আরেক সুখ–পাশের এক অসমাপ্ত বহুতলের পিলারে আসেন একজোড়া পেঁচা দম্পতি। তাদের কিছুক্ষণের নীরবতার পর যুগলবন্দি চিৎকার। সেই চিৎকার যেন জানান দেয় এই শহরটা আমাদের ছিল–তোমরা বহিরাগত দুর্বৃত্তের মতো দখল করে নিয়ে, আমাদের বাস্তুহারা করেছো। তারা চিৎকার শুরু করলে আমি প্রতিরাতেই বলি–আপনারা আমাদের ক্ষমা করবেন, আমরা সত্যিই দখলদারের মতোই দখল করেছি আপনাদের বসতি। সেই গাছগুলো কেটেছি ইচ্ছামতোন–যার কোটরে আপনারা থাকতেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
করোনাকাল ভয় নিয়ে এসেছে, এসেছে অবিশ্বাস নিয়ে। সামাজিক দূরত্ব শব্দটার মাঝে আছে অবিশ্বাসের মৌল উপাদান। যে স্বজনের হাত ধরে হেঁটেছি, তিনি সামনে এলেও অবিশ্বাস। এমনকি পরিবারের কেউ হাঁচি দিলেও বুক কাঁপে। আমরা মানবকুল এখন ঘরবন্দি। খুব দরকার আর নিজের স্বার্থ না থাকলে ঘরে থাকা সুবোধ বালক।  ইমিউনিটির খোঁজে কাঁচা হলুদ থেকে তুলসী পাতা চিবিয়ে সবুজ চায়ে খুঁজি বেঁচে থাকার এক টুকরো সাহস। মুখোশে মুখ ঢেকে, স্যানিটাইজারের মাঝেই এখন জীবন।
আর সেই সময়েই প্রকৃতির সন্তানেরা ফিরে এসেছেন। এসেছেন জানান দিতে আমাদের নিচতার। কিন্তু সত্যিই কি আমরা লজ্জা পাচ্ছি? একবারও ভাবছি প্রায় শতকের বেশি অংশ এই গ্রহজুড়ে ঘটে চলা পাপের আমরাও ভাগিদার। না। আমি নিশ্চিত এমন আমরা ভাবছি না। উল্টো ভাবছি– একটা ওষুধ বা ভ্যাকসিন এলেই তো মুক্তি। ততদিন একটু সামলে চলি। এই তো সব আগের মতো হয়ে গেলো বলে।
হবে নিশ্চয়, এবং এটাও নিশ্চিত আমাদের শিক্ষা হবে না। আমরা গাছ কেটে আর পুকুর বুজিয়ে দালান তুলবো, দস্যু করপোরেটরা সিএসআর-এর ভিক্ষা দিয়ে দখল করবে জল জঙ্গল। আর ক্ষমতাধরেরা আবারও কার্বন ছড়ানোর প্রতিযোগিতা করবেন। বুলেট আর অস্ত্র বানানোর বাজেটের কাছে লিলিপুট হয়ে থাকবে স্বাস্থ্য বাজেট। আবারও সিরিয়াতে বোমা ফাটবে, কিম সাহেব আর ট্রাম্প সাহেব শক্তির হাডুডু খেলবেন। ইথিওপিয়ায় শিশু মরবে, ভারতের কৃষক আত্মহত্যা করবেন অনটনে। বারান্দায় বেড়াতে আসা টুনটুনি লাশ হবেন, কামরাঙা গাছ ছেড়ে পালাবেন টিয়ে। সেই পেঁচা দম্পতি হারিয়ে যাবেন।
এই মহামারি শেষে আমরা কতটা শিক্ষা নেবো? নিশ্চই এই ভাইরাস মানবকুলকে একদম ধ্বংস করে দেবে এমন নয়, তবে এটা সত্যি–আমরা যে মানবকুল প্রাণ আর প্রকৃতি হত্যা করে নিজেদের সক্ষমতার বাহবা নিয়েছি, বন্যপ্রাণীদের আবাস দখল করেছি, মহাসাগরের পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেদের শক্তির প্রমাণ করেছি, পাহাড় ভেঙে খুঁজেছি খনিজ সম্পদ, বাস্তচ্যুত করেছি প্রকৃতির সন্তানদের, বাঘ থেকে দোয়েল–আমাদের বুলেটে হয়ে উঠতে চলেছে বিপন্ন। সেই আমরা এই ভাইরাসের ভয়ে ঢুকে পড়েছি ঘরে, আর আমাদের পথঘাটে লকডাউনকালে ফিরে এসেছিলে প্রকৃতির সন্তানেরা।

আমাদের কি শিক্ষা হবে? যখন দেখলাম পুঁজির স্বর্গরাজ্য আমেরিকায় ভেঙে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা, ইউরোপজুড়ে লাশের মিছিল, এশিয়া, মধ্য এশিয়াসহ গ্রহজুড়ে ঘরবন্দি মানুষ। পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মনে কাজ হারানোর ভয়। আমাদের করোনাঝড় শেষে কি মনে থাকবে সারিবদ্ধ শেষকৃত্যের অপেক্ষায় থাকা কফিনগুলোর কথা? নাকি আমরা আবারও ব্যস্ত হবো শক্তির পরীক্ষা দিতে?

ভেবে দেখুন—গত কয়েক দশকে মানুষ খুন করতে অস্ত্র বানাতে এই গ্রহে যত টাকা ব্যয় হয়েছে–তার তুলনায় কতটা কম খরচ হয়েছে চিকিৎসা আর স্বাস্থ্য গবেষণা খাতে? আমাজনের প্রাণীদের গায়ে আমরা জিপিএস ট্র্যাকার বসিয়েছি–অথচ নিউইয়র্ক শহরে মহামারি মোকাবিলায় হাসপাতালের পাশে তাঁবুতে চিকিৎসা দিতে হয়েছে।

জানি, এই মহামারি শেষে একটা উজ্জ্বল সকাল আসবে–লকডাউন শেষে আবারও পথে নামবে মানুষ। জানি না, সেই মানুষের দলে আমি নিজে থাকবো? নাকি কোনও একটা হাসপাতাল বা বাসায় এক টুকরো অক্সিজেন না পেয়ে মৃত্যু শব্দটাকে স্পর্শ করবো।

গত কয়েকমাসে অনেক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ছবি ছাপা হয়েছে–অরণ্যের বিপন্নে প্রাণীরা বেরিয়ে এসেছিল তাদের ক্রমশ বিপন্ন করে চলা মানুষদের বানানো পথে, শহরে। যে প্রকৃতিকে আমরা দুপায়ে দলে চলেছি শতকের পর শতক। সেই প্রকৃতিতে এদের অধিকারটুকুও তো আমার আপনার সমান।

এই বিপন্নকালেও স্বপ্ন দেখি–করোনাঝড় শেষে কারও একার নয়, পৃথিবীটা যেন সবার হয়। মানুষ আর প্রকৃতি যেন পাশাপাশিই থাকে। আর কোনও ডলফিনের লাশ থাকবে না সৈকতে–আপনার আমার বারান্দায় সকালে শীষ দেবে দোয়েল বা টুনটুনি। প্রকৃতি মুক্ত হবে মানুষের আগ্রাসী থাবা থেকে। আসুন সবাই স্বপ্নটা অন্তত দেখি, আর সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া যায়–এখনও তো মানুষের স্বপ্ন দেখা বন্ধ করার পথ কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি।
লেখাটির শিরোনামের ঋণ–প্রণম্য কবীর সুমনের ‘যাও গান’ গানটির একটি লাইনের কাছে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
[email protected]

 

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ