X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ‘কোথাও কেউ নেই’

নুরুজ্জামান খান
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:১৮আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৭:২০

নুরুজ্জামান খান দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ মনে করে সংস্কৃতি মানে হলো শুধু নাচ-গান করা। কিন্তু সংস্কৃতি যে একটা জাতির পরিচয়, সেটার শুরু হয় ভাষা থেকে– সেই কথাটা অনেকেই সহজে বলেন না। খেলাধুলা থেকে শুরু করে পোশাক, খাওয়া দাওয়া সবই সংস্কৃতির অংশ এবং একটি দেশের সংস্কৃতির যদি কোনও শক্ত পরিচয় না থাকে তাহলে জাতির অবস্থা হয় ‘পথশিশু’র মতো। কী করবে, কী করবে না তার কোনও দিগ্বিদিক থাকে না। আবার শুধু পরিচয় দিয়েই কোনও কাজ হয় না যদি তাতে চর্চা না থাকে। চর্চা করতে হলে জানতে হয় এবং প্রতিদিনের সাথে নিয়ম করে পালন করতে হয়। যেমন, চর্চার মাধ্যমে ভাষার দক্ষতা অর্জন উল্লেখ করা যেতে পারে।  
যাইহোক, হিরো আলম, টিকটক অপু-মামুন এবং হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ দিয়ে আসলে আমাদের সংস্কৃতির সময়, পটভূমি এবং সেই আলোকে কী ধরনের শিক্ষার চর্চা করা হয় সেটা নিয়ে লেখাই আমার মূল উদ্দেশ্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৭ কোটির বেশি মানুষের এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পণ্ডিত মহল মিডিয়া বা গণমাধ্যম নিয়ে তেমন বিচার বিশ্লেষণ না হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ বুঝে উঠতে পারে না সংস্কৃতিতে তাদের অবস্থান কোথায়।
এখন প্রশ্ন হলো কেন সমাজের চিন্তাশীল মানুষদের সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তা করতে হয় এবং সময় নিয়ে তা সাধারণ মানুষকে জানাতে হয়? অথবা কেনই বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে জ্ঞান গরিমায় উন্নত হতে হয় অথবা কেনই বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পেছনে বিশাল অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়? এক কথায় যদি বলতে হয় মানুষের মন আছে বলেই আমরা মানবিক আর মানবিকতার কারণেই মানুষ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। শরীরকে সুস্থ রাখার জন্যে যেমন সুষম খাবার প্রয়োজন, ঠিক তেমনি মনকে বাঁচিয়ে রাখতে দরকার সংস্কৃতির বিকাশ। সংস্কৃতির বিকাশের অন্যতম উপায় হলো নিজের কথা জানা এবং বিভিন্ন উপায়ে, যেমন- গল্প-সাহিত্য, নাচ-গান, চলচ্চিত্র, চিত্র অঙ্কন, নাটক, খেলাধুলা, খাবার ইত্যাদি মাধ্যম দিয়ে তা প্রকাশ করা। যখন এই নিজের কথা প্রকাশ করা স্বাধীন থাকবে না তখনই মানুষ ধার করা শুরু করবে। কারণ, এই পদ্ধতি সহজ হওয়ার কারণে জ্ঞান বুদ্ধি ছাড়াও বাহবা পাওয়া যায় কিন্তু সমস্যা হয় তাদের দেখে অন্যরা সেই একই পথে এগোয়।        
আজকে হিরো আলমের জায়গায় যদি জিরো সাহেদ থাকতো তাহলে আমি তার উদাহরণ দিয়েই কথা বলতাম। প্রশ্ন হলো, হিরো আলম আসলে কে? কেন আমাদের একটা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী হিরো আলমকে ফলো করে? সাথে সম্পূরক আরেকটি প্রশ্ন, কেনই বা আমাদের কিছু মেইনস্ট্রিম বা কিছু প্রধান মিডিয়া হাউজগুলো হিরো আলমকে সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রচার করে?
আমার মতে, হিরো আলম আমাদের সমাজের সংস্কৃতির শক্তিশালী একটা প্রতিবিম্ব। এতটাই শক্তিশালী, অনেকেই তার সাথে নিজের জীবন অথবা জীবনের কোনও না কোনও অংশ খুব সহজেই মিলাতে পারে। সেটা কীভাবে তার একটা ব্যাখ্যার দরকার আছে। আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যে যেইভাবে যেকোনও জায়গায় ব্যবসা করুক না কেন– ব্যবসায়ের শুরুটা অনেকের হিরো আলমের মতো। কিছু টাকা নিয়ে নিজ উদ্যমে কিছু একটা শুরু করা। অর্থ রোজগারের দিক থেকে নিম্নবিত্ত বেশিরভাগ মানুষ আয় রোজগার করে হিরো আলমের মতো জায়গা থেকে, যেখানে সমাজের তেমন একটা সাহায্য পাওয়া যায় না বললেই চলে। যেমন, প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স এবং মূলধন ইত্যাদি।
এমন অবস্থায় যে কেউ শুধু রোজগার করে বেঁচে থাকার চেষ্টাই করবে। তার যেহেতু প্রশিক্ষণ নেই, তাই সে জানবে না সৎ ব্যবসা কী! বরং টাকা আয়ের জন্যে জীবন দিয়ে দেবে আর এই টাকা আয়ের নেশায় আমরা আমাদের মানবিক গুণাবলিগুলো হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে ‘পশু’তে রূপান্তরিত হই। প্রশ্ন হলো, মানবিক গুণাবলি টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপায় কী? মানসিকভাবে সবল থাকা। আমাদের মতো দেশে মানসিকভাবে সবল থাকা কোনও কোনও ক্ষেত্রে অবাস্তব। কারণ, ব্যবসা অনেকেই করেন কোনও শিক্ষা ছাড়া। তাই, অনেক ব্যবসায় নেই কোনও সুদূরপ্রসারী চিন্তা। দুই নম্বরি করতে করতে আমরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ি। প্রশ্ন হলো, জেনে শুনে আপনি প্রতিদিন কত মিথ্যা আর মানুষ ঠকাতে পারবেন?
পারা যায় না বলেই আমাদের গলার আওয়াজ উঁচু করে কথা বলতে হয়। হিরো আলম  এরকম সমাজ ব্যবস্থা থেকে উঠে আসা কিন্তু সংস্কৃতির সাথে নিজ জ্ঞানে যা পেরেছে তাই ধারণ করেছে (বিশেষ করে বাণিজ্যিক ধারার বাংলা ছবির স্টাইল), তার সাথে জীবনযুদ্ধে লেগে থাকার কারণে মানসিক দৃঢ়তা হয়ে ওঠে প্রাণশক্তি। এই সবল মনোভাব নিয়েই সে জাতীয় নির্বাচন বা ইলেকশন জেতারও চেষ্টা করে। কারণ, সে দেশের ঘুণে ধরা সংস্কৃতি চিনে ফেলেছে। সমাজে ক্ষমতাবানরা কীভাবে কথা বলে এবং তাদের শিক্ষা এবং বোঝার জ্ঞান কতটুকু সে সেটা ভালোই জানে। জানে বলেই সে লোক দেখাতে কি কি করতে হয় তা জানে এবং তা দিয়ে সাধারণের কাছে জনপ্রিয়।
মজার ব্যাপার হলো, আমাদের সমাজকে যদি সংস্কৃতির দিক থেকে পর্যালোচনা করি তাহলে কিন্তু এই বাংলার সংস্কৃতিকে নিচু করে দেখার কোন অবকাশ নেই; বরং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই যে এই বাংলার মানুষ সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন ছিল তা আমাদের দেশের যাত্রা, পুতুল নাচ, নাটক, লালনের গান, কবিতা, চলচ্চিত্র এবং এক দশক আগেও রিকশার পিছনে হাতে আঁকা ছবিসহ বিভিন্ন রকমের হাজার ধরনের উদাহরণ পুরো দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং এদের প্রত্যেকটি মাধ্যমই এত শক্তিশালী ছিল যে, তা দিয়ে বিশ্বের বুকে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা শুধু সময়ের বিষয় ছিল।  
হিরো আলম, টিকটক অথবা লাইকির লোকজনদের অন্যরকম লাগে। কারণ, রাষ্ট্রের ব্যর্থতা তাদের আমাদের সংস্কৃতি হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করিনি। অপরদিকে, ডিজে নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক হাসাহাসি আছে কিন্তু ইউটিউবে যদি লস্ট ফ্রিকোয়েন্সিস (lost frequencies) দিয়ে সার্চ দেন তাহলে ২৬ বছরের ফিলিক্স (Felix De Laet) নামের বেলজিয়ান এক ডিজের খোঁজ পাবেন, যাকে দেখলে গোল চশমা চোখে সাধারণ মানের একটা ছেলেই মনে হবে। কিন্তু এই লকডাউনে তাকে দেখা যায় রাজকীয় অতিথি বানিয়ে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের ঐতিহ্য রাজকীয় প্রসাদে সনাতন ঐতিহ্যবাহী মিউজিসিয়ানরা (আমাদের দেশের সেনা প্যারেডদের মতো) তাকে রাজকীয় সুরে বরণ করে নেয়। তারপর সে প্রাসাদের সবচেয়ে উঁচু মিনারে, যেখানে বেলজিয়াম পতাকা রয়েছে, সেখানে ডিজে পারফর্ম করে। তার মানে ডিজে হলেও সমস্যা নেই যদি সে সমাজের জন্যে পজিটিভ কিছু করতে পারে। কিন্তু পজিটিভ কিছু করার আগে সমাজকে তো আগে তাকে তৈরি করতে হবে এবং যথাযথ মর্যাদা দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আর এভাবেই মেধাবী দিয়ে সংস্কৃতির বিকাশ হয়।
এ প্রসঙ্গ দিয়ে বাংলাদেশটা একটু দেখি। প্রায়ই শোনা যায় নতুন প্রজন্ম গোল্লায় যাচ্ছে এসব টিকটক আর লাইকির স্টারদের পাগলের মতো অনুসরণ করার জন্যে। দেখুন ভাই, গোল্লায় নতুন প্রজন্ম যাওয়ার আগে অনেক আগে আমরাও গিয়েছিলাম। হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের চরিত্র বাকের ভাইকে বাঁচানোর জন্যে যুবকরা রাস্তায় মিছিল করেছে। অভিনেতা থেকে শুরু করে লেখকের বাড়িতে হামলা করেছে। শুনে অবাক লাগছে? খুব যে সেই দিনের কথা তাও কিন্তু না। সেই ‘৯০ দশকের প্রথম দিকে যদি আমরা শিক্ষিত সমাজ এগুলো করতে পারি, তাহলে তারা কেন পারবে না?
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের যুদ্ধ ছিল ভালোকে সাপোর্ট করা আর এখন তাদের পালস বা স্পন্দন আমরা ধরতে পারি না। কারণ, তাদের আমরা সঠিক শিক্ষা না দিয়ে অবহেলা করে আসছি। ‘আলিফ লায়লার’ সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে আমরা এবং আশপাশের অনেক মানুষকে বিদ্যুতের জন্যে দোয়া করতে দেখেছি। এই প্রজন্মের সাথে ‘নেটফ্লিক্স’ (Netflix)-কে তুলনা করা যেতে পারে। পছন্দের সিরিজের নতুন সিজন দেখার জন্যে আমরা এখন যেভাবে অপেক্ষা করি, সেই সময় ঠিক একই অবস্থা ছিল।  
এর মানে বোঝাতে চাচ্ছি, গণমাধ্যম শক্তিশালী বলেই গণ বা সবার হয়ে উঠে আর সেই মাধ্যম দিয়ে কে বা না চায় সবার ভালোবাসা পেতে। মানুষ তো ভালোবাসা পাওয়া এবং দেওয়ার গল্পের জন্যেই বেঁচে থাকে। হিরো আলম, টিকটক অপু মামুনরা যদি কিছু করে ভালোবাসা পেতে চায় সেটাকে অন্যায় হিসাবে দেখা ঠিক হবে না বরং রাষ্ট্র এবং আমরা যারা শিক্ষকের আসনে ‘ভং’ ধরে বসে আছি তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। কারণ, আমাদের নেই কোনও হুমায়ূন আহমেদ তৈরি করার পরিকল্পনা অথবা সমাজের কোমলমতি বাচ্চাদের পরিচয় করিয়ে দিতে পারছি না আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি।


লেখক: চলচ্চিত্রকার, পিএইচডি গবেষক এবং শিক্ষক, হাঙ্গেরিয়ান ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
বেয়ারস্টো-শশাঙ্কে হেসেখেলে ২৬২ রান করে জিতলো পাঞ্জাব
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ