X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী আনিস আহমেদের ‘ফোর্টি স্টেপস’: লৌকিক ও অলৌকিকের পর্দা

পারভেজ হোসেন
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৪৮আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২২:২৯

পারভেজ হোসেন ইংরেজি ভাষায় লেখা কাজী আনিস আহমেদের ‘ফোর্টি স্টেপস’ নভেলাটি প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকার মিনেসোটা রিভিউয়ে ২০০০ সালে। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে বইটি আমাদের হাতে আসে ২০০৬ সালের বই মেলায়। মাত্র ৬৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে আপাত-সরল কোনো গল্প নেই। তরতর করে পড়ে ফেলারও উপায় নেই। নভেলাটির আখ্যানের জটিল আবহের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনাই ঘটে, অনেক গল্প তৈরি হয়-যার অনেকগুলোই আবার রটনাও বটে। নানা রঙে রঙিন হয়ে সেই সব গল্প, সেই সব রটনা মানুষের মুখে মুখে রসুইঘর থেকে শুরু করে ইটভাটার চিমনির ধোঁয়ার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে গোটা জামশেদপুরে।
গল্পগুলোর বয়ান নভেলাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র শিকদার, ডসন, ইয়াকুব মোল্লা, নূরজাহান-এদের ঘিরে তৈরি হয় কিংবা এদের অন্তর্জগতে গড়ে ওঠা কোলাজের মতো পরস্পর পরস্পরের মধ্যে এমনভাবে জড়াজড়ি করে থাকে যে সেই জট খুলে পাঠককে তা আলাদা করে নিয়েই এই রচনার ঘটনাপরম্পরায় হাজির হতে হয়।

একজন পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে ওই সব ঘটনাপরম্পরায় উপস্থিত হওয়ার পর আপনা থেকেই এর আপন আপন মূল্যায়ন প্রত্যেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলেই আমার ধারণা। সেই লক্ষ্যে আপনাকে আহবান জানাই, আমরা সঙ্গে আসুন জামশেদপুরে ঢুকে গিয়ে দেখি ‘চল্লিশ কদম’-এর কে কোথায় আছে। কোথায় কী ঘটছে।

ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পরের সময়কার ভারতের একটা গ্রাম জামশেদপুর। যে গ্রামের ছিল একদা এক গৌরবময় অতীত। লোকপরম্পরায় জানা যায় মোগল যুগে কিংবা তারও আগে থেকে একটা চমৎকার শহর হিসেবে গড়ে উঠেছিল জামশেদপুর। কিন্তু ইংরেজ আমলে এসে মলিন হতে শুরু করে এর ঐতিহ্য। যার আর কোনো উন্নতি হয়নি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যকালে ইংরেজরা তাদের উপনিবেশ গুটিয়ে চলে গেলেও ভারতজুড়ে রেখে যায় দুইশ বছরের তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের ছায়া। সেই ছায়ার মধ্যে তখনো এক দল থেকে গেছে-যারা এ দেশের জল-হাওয়ায় একেবারে মিশে গিয়ে ধর্ম প্রচারের কাজে, শিক্ষার কাজে, মানুষের উপকারের কাজে লেগে রয়েছে। অন্য এক দল, যারা দেশটাকে অধ্যয়ন করছে, দুই সংস্কৃতির মধ্যে একটা বোঝাপড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে-এমনটাই দাবি তাদের। দ্বিতীয় দলের তেমনই ছয়জন ব্রিটিশ, যারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত জামশেদপুরে এসেছে, এর পুরোনো ইতিহাস এবং হালহকিকত অধ্যয়ন করতে। জামশেদপুর সম্পর্কে তাদের ধারণা ভ‚ত্বকের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে সভ্যতার পরম্পরা যা মাটি খুঁড়ে বের করতে হবে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক দলের কনিষ্ঠতম একজন,যার নাম ডসন। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক নন। তিনি এ দেশেরই ললিতকলা বিদ্যাপিঠে পড়াশোনা করা একজন চিত্রকর। চিত্রকর হয়েও এই দলে তার যুক্ত হতে পারার কারণ তিনি বহুকাল ধরে ভারতে ছিলেন এবং এ দেশের বিভিন্ন জায়গা তার ভালো করে চেনা।

ডসনের বাবা ছিলেন ব্রিটেন থেকে ভারতে আসা একজন প্রশাসনিক আমলা। তিনিও এ দেশ ছেড়ে চলে যাননি। এ দেশের জল-হাওয়ায় পুড়ে পুড়ে এমন তামাটে হয়েছিল তার গায়ের রং যে সোনালি চুল না হলে মানুষটাকে ‘দিশি আদমি’ বলেই চালিয়ে দেয়া যেত।

এই জামশেদপুরে এসেই ডসন সাহেব দেখা পেলেন পুরোনো বন্ধু চিকিৎসক শিকদার সাহেবের। শিকদার মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েও প্রথাগত ডাক্তারি শিক্ষা শেষ করেননি। চিকিৎসক হওয়ার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। কিন্তু জামশেদপুরের সবেধন হেকিম এবং ওষুধ ব্যবসায়ী তার বাবার মৃত্যুর পর গ্রামে ফিরে পৈতৃক ব্যবসা এবং প্রসববিদ্যাশৈলীর সঙ্গে অন্যান্য রোগের জনপ্রিয় চিকিৎসক হয়ে ওঠেন তিনি। যদিও প্রথম দিকে ফার্স্ট এইড আর গর্ভনিরোধ ছাড়া কোনো চিকিৎসা করতেন না শিকদার। বাবা ছেলেকে শহরে পাঠিয়েছিলেন দাঁতের চিকিৎসক হতে কিন্তু মেডিকেলের লেখাপড়ায় মন ছিল না শিকদারের। তিনি ললিতকলা একাডেমির চত্বরে গিয়ে আড্ডা দিতেন। সেখান থেকেই পরিচয় হয়েছিল শিল্পী ডসনের সঙ্গে। তারপর দোস্তি। তারপর দীর্ঘদিন তাদের বোহিমিয়ান জীবন। ডসন যে শিকদারের জিগরি দোস্ত হয়ে উঠেছিলেন শুধু তাই নয়, এক অর্থে শিকদারের গুরুও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শিকদারকে অন্তত দুটি বিষয়ে তালিম দেয়ার ভার ডসন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। একটি হলো শিকদারকে শহর চেনানো, অন্যটি তাঁকে শিল্পকর্মের বোধে উদ্দীপ্ত করা। ধীরে ধীরে বন্ধু ডসনের আঁকা ল্যান্ডস্কেপের ভক্ত হয়ে ওঠেন শিকদার। কারণ ডসনের ল্যান্ডস্কেপগুলো তাকে মনে করিয়ে দিত জামশেদপুরের কথা-গ্রীষ্মের খরায় ফাটা মাটি আর নির্মেঘ নীল আকাশ, শীতের নিবিড় ঘনধূসর কুয়াশা ফুঁড়ে বের হয়ে আসা লন্ঠনের আলো, বর্ষায় গুটিসুটি মেরে জড়ো হওয়া ন্যাংটো ছেলেমেয়ে, খানাখন্দের কাদাজলে পরে থাকা কাক, ভাঙা ডালপালা, কাঁচা ফল-এই সব।

কাজী আনিস আহমেদ ডসন আর শিকদারের এই জীবন বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। আব্বাজানের মৃত্যুতে শিকদারকে চলে আসতে হয় জামশেদপুরে। প্রাচীন এই গ্রামে শিল্প-সংস্কৃতির কোনো আবহাওয়াই নেই। এই নিয়ে তার জেদের সীমা ছিল না। ক্রমে চিকিৎসার কাজে এলাকার মানুষদের সঙ্গে দৈনন্দিন একঘেয়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন শিকদার।

আর্ট কলেজ ছেড়ে দেবার পর ডসনকেও শহরে বেশ একটা দুঃসময় পার করতে হয়েছে। ছবি আঁকায় বড্ড বেশি প্রতীচীবাদী বলে সমালোচকেরা তাকে আদ্যশ্রাদ্ধ করত। গ্যালারিগুলোও সাহায্য করেনি তাকে। তারা নিয়মিত ডসনের ছবি দেখাত না। ওই অবস্থায় ডসন হতাশ হয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। সেখানেও একই অবস্থা। সেই বিরূপতার মধ্যে, অসহায়ত্বের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটা দলে চাকরি জুটিয়ে তিনি আবার চলে আসেন ভারতে। কাজ নিয়ে দলের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে একেবারে জামশেদপুরে।  

বন্ধুকে পেয়ে এবং জামশেদপুরে একটা মস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ঘটতে যাচ্ছে দেখে শিকদার সাহেব খুবই উত্তেজনা বোধ করলেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই চলে এল এক মহাবিপর্যয়। ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাদের অনুসন্ধান চালাবার আগে এক ছুটির দিনে গেল একটা মসজিদ দেখতে। তাদের অনুসন্ধিৎসু চোখ জবরদস্ত মসজিদটির সাদা মিনার, গম্বুজ এবং এর গায়ে খোদাই করা উজ্জ্বল-নীল পদ্মরাগ মণিরত্নে চাঁদ-তারা দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তাদের এই দেখাদেখিতে ফ্যাসাদ বাধে তখনই যখন প্রত্নতাত্ত্বিকের গভীর দৃষ্টি গিয়ে নিবদ্ধ হয় সংস্কার করা সৌধটির পেছনের জরাজীর্ণ পাঁচটি পুরোনো থামে, যেগুলোতে কখনোই সংস্কারকার্য হয়নি বলেই মনে হয় তাদের। থামগুলো ভেঙে পড়েছে এবং ওগুলোর লাল বেলেপাথরের গায়ে নর্তকীদের মূর্তির ভগ্নাংশের অবশেষ উঁকি দিচ্ছে। ভালো করে পর্যবেক্ষণের পর তাদের মনে আর কোনো সন্দেহই রইল না যে কোনো এক কালের একটি মন্দিরকে সংস্কার করে গড়া হয়েছে এই মসজিদ।

প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ব্যাপারটা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনাতেই চেপে রাখতে চাইল। কিন্তু এমন একটা বিষয় বেশি দিন চাপা থাকল না। কী করে থাকবে? জামশেদপুরের মানুষের এই এক বৈশিষ্ট্য, কোনো একটা কাহন পেলেই হয়। তাকে সাতকাহন বানিয়ে তবে ছাড়ে! বিষয়টা এলাকার মানুষের মুখে মুখে রটে, ইটভাটার চিমনির ধোঁয়ার সঙ্গে, নানা ভাষ্যে, নানা রঙে রঙিন হয়ে অন্তরালে বসবাসকারী রমণীর রসুইঘর থেকে ছড়াতে থাকল।

গুঞ্জন এমন আঁকার ধারণ করল যে স্থানীয় জনসম্প্রদায়ের মধ্যে এই নিয়ে শুরু হয়ে গেল তুমুল হাঙ্গামা। বেধে গেল রক্তারক্তির দাঙ্গা। সেই দাঙ্গায় জামশেদপুরের দুই হিন্দু খুন হলো। একজন মুসলমান মুচির প্রাণ গেল। ধর্ষিত হলো জনাকয়েক মুসলমান তরুণী।

অবস্থা দেখে পরিকল্পনা ফেলে জীবন নিয়ে পালাল ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। পালাতে পারলেন না শুধু ডসন। কারণ তিনি অসম্ভব পেটের অসুখে ভুগছিলেন। অসুখটা এলাকায় মহামারির আকার নিতে যাচ্ছিল প্রায়। শিকদারের আশ্রয়ে থেকে অসুখ ভালো হলেও জামশেদপুর ছেড়ে ডসন আর ফিরে গেলেন না। চারুকলার চর্চা বাদ দিয়ে কারিগরি চর্চায় আত্মনিয়োগের পর একটা আসবাবের দোকান খুলে বসলেন তিনি।

শিকদার যখন এখানে আসেন তখন তার নব যৌবন। পিতার ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েও জামশেদপুরে নিজেকে পুরোপুরি গুছিয়ে নিতে পারননি। তাতে কী? তার সংস্কৃতি তার রুচি তার শিক্ষা ছিল তারিফযোগ্য। আর এ কারণেই এক অসামান্যা সুন্দরী তরুণী নূরজাহানকে তিনি ঘরে তুলতে পেরেছিলেন।

নূরজাহানের বাবা মিস্টার জহিরও এ এলাকার লোক নন। উত্তরের কোনো এক মেয়েদের স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়েই জামশেদপুরের মতো এক অজানা অচেনা অখ্যাত এলাকায় এসে ঠাঁই নিয়েছিলেন। সেই থেকে রূপবতী নূরজাহান পর্দানশীল। কিন্তু যত পর্দাই করুক জামশেদপুরের মেয়েদের কাছে তার মনমোহিনী রূপের কথা, তার চালচলন-ভাবভঙ্গিতে যে জাদু আছে এমন কথা কিন্তু গুঞ্জরিত হতে থাকল। ফলে চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসা যেন আর থামে না। অত সব প্রস্তাবের মধ্যে শেষ পর্যন্ত জিত হলো শিকদারেরই।

বিয়ের পর এক রাতে শিকদার তাঁর বউকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি ইংরেজি পড়তে পারো?’

‘অভিধানের সাহায্যে মোটামুটি একটা আন্দাজ করে নিতে পারি’, বললেন নূরজাহান।

‘তোমাকে যদি ইংরেজি শেখাই তো কেমন লাগবে?’

‘হ্যাঁ। শেখাই যায়। কেনই-বা নয়?’

কিন্তু শিকদার সাহেবকে আর ইংরেজি শেখানোর দায়িত্ব নিতে হলো না। এই দায়িত্ব নিয়ে গেলেন তার বন্ধু ডসন। ডসন তখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। এমন সময় জরুরিভাবে শিকদারকে কিছুদিনের জন্যে শহরে যেতে হলো। এই অবসরে নূরজাহানের ইংরেজি শেখার কাজ ভালোভাবেই এগোতে থাকল। ডসনও জানতে থাকলেন বাংলার খুঁটিনাটি। ধীরে ধীরে পরস্পরকে তারা সেই ভাষাই শেখালেন, যা তারা সবচেয়ে ভালো জানেন।

শহর থেকে ফিরে আসার পর এ কয় দিনের মধ্যে ইংরেজিতে স্ত্রীর দ্রুত উন্নতি লাভ লক্ষ করে খুশি হলেন শিকদার সাহেব। কিন্তু ছাত্রী আর মাস্টারের মধ্যে একটা প্রেমময় দৃষ্টি বিনিময় তার নজরে পড়তেই চিন্তিত হলেন। নিজেকে প্রশ্ন করলেন, একজন আধুনিক মানুষ জহির সাহেবের ঘরের পর্দানশীল মেয়েটির পর্দা নেয়াটা কি তাহলে ছিল একটা ভান? গ্রামের মেলায় চুল খুলে চরকায় চড়া যে নূরজাহানকে দেখে তার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, এই-ই কি সেই মেয়ে? নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া শুরু হয়ে গেল শিকদারের। তার মতো একজন প্রগতিশীল মানুষ এ রকম একটা বিষয় নিয়ে বন্ধুকে বাড়ি থেকে চলে যেতেই-বা বলেন কী করে? আবার মনের মধ্যে ব্যাপারটাকে সহজভাবেও নিতে পারছেন না। নানা রকম এলোমেলো পথ খুঁজতে খুঁজতে কঠিন একটা মনঃপীড়ায় ভুগতে লাগলেন শিকদার। শেষটায় ইয়াকুব মোল্লাই বাঁচালেন তাঁকে।

জামশেদপুরের ইয়াকুব মোল্লা জমিজিরাতের কারবারি হলেও ইংরেজি শিক্ষা তার ছিল না। শিকদারকে তিনি বহুদিন ধরেই তার ব্যবসার দিকে ভেড়াতে চেয়েও জুত করে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু লেগে ছিলেন। চিকিৎসার নাম করে প্রায়ই তার যাতায়াত বাড়তে থাকলে একসময় এই চতুর মানুষটি শিকদারের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে শুরু করেন। সেই সুবাদেই ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে একদিন সকালে এসে মোল্লা ঘোষণা দিলেন, ডসনের জন্যে একটা বাড়ি আর ভৃত্যের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন তিনি। কাজেই ডসনকে আর শিকদারের বাড়িতে থেকে অসুবিধা পোহাতে হবে না। মোল্লার এই ক‚টনৈতিক চালে শিকদার সাহেব খুব কৃতজ্ঞ বোধ করলেন। হাঁপ ছেড়েও বুঝি বাঁচলেন-মোল্লা ঠিক সময়েই সবকিছু সামলেছেন। কিন্তু বাইরের লোক দিয়ে বাড়ির মেহমানকে এভাবে বিদেয় করাটা নূরজাহান ভালোভাবে নিলেন না। তিনি স্বামীর সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিলেন-

শিকদার বললেন, ‘আমি মোল্লাকে কিছু করতে বলিনি। সে-ই নিজে থেকে ডসনকে সরিয়ে নিয়ে গেছে।’

‘নিজে থেকে গেছে? আর কে তাঁকে নিয়ে যেতে দিয়েছিল? কী লজ্জা! কী লজ্জা!’

‘কেন আংরেজের সঙ্গে বাড়িতে একা একা সময় কাটানোর মধ্যে কোনো লজ্জা নেই?’

‘আমরা মোটেই একা একা থাকিনি। ওই দাইবুড়ি এখানে থাকত।’

‘এক অন্ধ দাইবুড়ি! দেখভাল করার জন্য ভালোই এক সঙ্গিনী জুটিয়েছিলে তুমি!’

‘আমাকে ধিক্কার দিচ্ছ কেন? তুমিই তো ওই বেকুব আংরেজকে আমাদের বাড়িতে এনে তুলেছিলে!’

‘কিন্তু আমি তো তাকে তোমায় দোলনায় চড়িয়ে দোল দিতে বলিনি!’

‘এহেন হিংসুটে তুমি, উফ, তবে দোহাই তোমার এটুকু খেয়াল রেখো যে, আদব-কায়দা ঠিক ঠিক যেন গোল্লায় না যায়!’

এভাবে তর্ক আরও বেড়ে গেলে বউয়ের সঙ্গে আর কথায় পেরে ওঠেন না শিকদার।

ইতিমধ্যে নূরজাহান টের পেলেন তিনি পোয়াতি হয়ে উঠেছেন। দুজনেই ঠিক করে নিলেন উটকো বিষয় নিয়ে তর্কে জড়িয়ে জীবনের এমন সুখের দিনগুলোকে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। শিকদার এই আনন্দের বার্তা জানান দিতে ডসন আর মোল্লাকে দাওয়াত দিলেন। চমৎকার সব খাবার পরিবেশন করলেও বেগম শিকদার তার রসুইঘর থেকে কিন্তু মেহমানদের সামনে বের হলেন না।

এক ঘোর বৃষ্টির রাতে প্রসববেদনায় কাতরাতে থাকেন বেগম শিকদার। অন্ধ দাইবুড়ি ছাড়া কেউ নেই। শিকদার তাকে নিয়েই প্রসূতির প্রসব সম্পন্ন করাতে চাইলেন। শেষ রাতের দিকে একটি সোনালি চুলের মেয়ে জন্ম দিলেন নূরজাহান।

পরদিন সকালে গোটা জামশেদপুরে পরস্পরবিরোধী সব খবর ছড়িয়ে পড়ল-

‘বাচ্চাটা কি মরাই জন্মেছিল? নাকি জন্মাবার পরেই মারা গেল?’

‘মরা জন্মাবে কী করে? দাইবুড়ি তো বলে সে নাকি বাচ্চার কান্না শুনেছিল।’

‘ওই কুচুটে বুড়ির তো চোখ দুটো কবেই গিয়েছিল। এখন হয়তো কানও গেছে।’

‘আর বাচ্চার কবরটা? দেখোনি ওদের উঠোনে তালগাছের তলায় জমিটা কেমন ঢিবির মতো উঁচু হয়ে আছে?’

‘বাচ্চাকে ওরা তো কবর দেবেই, তবে প্রশ্ন হলো-কখন, মরার আগে, না পরে?’

‘এমন ভীষণ কথা ভুলেও ভেবো না। খামোখা ওরা অমন ভীষণ কাজ করতেই বা যাবে কেন?’

লোকে কথা কাটাকাটি করল, জল্পনাকল্পনা করল, কিন্তু সত্যি যে কী ঘটেছিল তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কেউই দিতে পারল না।

জামশেদপুরের সব কাহনেরই দুটো ভাষ্য থাকে। একটা ছড়ায় মুখে মুখে, আরেকটা বয়ে নিয়ে যায় চিমনির ধোঁয়া। যে মেয়েরা রসুইঘরে খানা পাকায় তারা এমন সব তথ্য জানে যা তাদের সবজান্তা স্বামীদের কল্পনারও অতীত।

‘ওই কবরটা কি নেহাতই লোকের ধারণাকে ভুল পথে চালানোর জন্য? ... আর ডসনেরই বা শহরে এমন কী কাজ পড়ল? ... আর ওই যে, কে একজন না দেখেছে, সে তার কোলে করে ছোট্ট একটা পুঁটলি নিয়ে যাচ্ছে শহরের দিকে! ... শিকদার আর মোল্লারই-বা অমন কী তাড়া পড়েছিল চটপট বাচ্চাটাকে গোড় দেয়ার জন্য? যদি কোনো বাড়িতে আচমকা কোনো অঘটন ঘটে যায়, তবে জামশেদপুরে তো লোকজনকে যে কোনো সময় ডাকা যায়। তাহলে কেন মোল্লা আর শিকদার হাত লাগানোর জন্য কাউকে ডাকেনি? এত রাখঢাক গুরগুরই-বা কেন?’-মানুষের মনের মধ্য থেকে একটা খটকা কিছুতেই যায় না। যাবে কী করে? কাউকে জানান না দিয়ে ভোর হওয়ার আগেই তো শিকদার সাহেব ইয়াকুব মোল্লার সাহায্যে মরা বাচ্চাটাকে কবর দিয়েছিলেন।

এত কিছুর মধ্যেও ডসনের সঙ্গে শিকদারের সদ্ভাবে কিন্তু কোনো ভাটা পড়েনি। তা না হলে জামশেদপুরের লোকেদের মনে বিচ্ছিরি রকমের কিছু সন্দেহ জেঁকে বসতে হয়তো সময় নিত না। 

কিছু দিনের মধ্যে গাঁওয়ের লোকেরা জেনে যায় যে, শহরে একটা মেয়েলোক পুষেছিলেন ডসন। সেই মেয়েলোকের ঘরে একটা বাচ্চা হয়েছে। ওটাই এখন লোকজনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু-

‘কোনো আংরেজই এমন কোনো কাণ্ড করে বসতে পারে।’

‘বলছি কী তোমাকে? শহরের মাগিগুলোর নীতিটীতির কোনো বালাই নেই।’

‘আল্লাহর দোয়া, জামশেদপুরে অমনতর কোনো মেয়েছেলে থাকে না।’

প্রতি সপ্তাহে গাড়ি চালিয়ে নিয়ম করে সেখানে যান ডসন। দিনে দিনে সেই বাচ্চাটি এখন পরমাসুন্দরী হয়ে উঠেছে। তার পেছনে দেদারসে পয়সা ঢালতে কোনো কার্পণ্য নেই ডসনের।

এদিকে শিকদার সাহেবের আর কোনো ছেলেপুলে জন্মাল না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাও দিনে দিনে কেমন হিমশীতল হয়ে উঠেছে। গ্রামজোড়া মেয়েলোকের ধারণা, ছেলেমেয়ে না থাকলে সব সংসারই বিগড়ে যায়। পুরোনো রটনা নতুন করে রটতে থাকে, ছেলেপুলে হবে কী করে, মরাবাচ্চা বিয়ানোর পর থেকে শিকদার আর বেগম শিকদার এক বিছানায় শুলে তো হবে!

চিকিৎসার আড়ালে মোল্লার সঙ্গে জমিজিরাতের বাণিজ্যে ছিমছাম সুপুরুষ শিকদারের রমরমা দিন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বের হলে মনে হয় বুঝি খাঁ সাহেব বেরোলেন। জামশেদপুরের জনগণ তাকে সম্মান দেয়, ইজ্জত করে। শিক্ষিত মানুষটার জনপ্রিয়তাও অপরিসীম। এত সব সত্তে¡ও তার সংসারখানা একেবারে ফাঁকা। বংশে বাতি ধরার যে কেউ নেই!

উনষাট বছরের শিকদারের মাথায় এখন মস্ত টাক। নাকের ডগায় ঝুলছে সাদা গোঁফ। এখনো নিজেকে ব্যস্ত রাখেন দাওয়াখানায়। মোল্লাকে নিয়ে একটা মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানেও সময় দিতে হয় তাঁকে।

যৌবনে যিনি ছিলেন গোটা জামশেদপুরের ডাকসাইটে সুন্দরী, সেই নূরজাহানের চুল এখনো কুচকুচে কালো, গায়ের চামড়ায় ভাঁজ পড়েনি তবে থুতনির তলায় ভাঁজের আদল ফুটে উঠেছে, কপালে অস্পষ্ট বলিরেখার ছাপ-যা তার বয়সটাকে আর লুকাতে পারছে না। বিবাহিত জীবনেরও তো চব্বিশটা বছর পার হয়েছে। বাড়িতে চাকর-বাকরের অভাব নেই, তবু রসুইঘরেই সময় কেটে যায় তার। খাবার সময় হলে দস্তরখানা বিছিয়ে অপেক্ষায় থাকেন স্বামীর।

কদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না শিকদারের। বুকের পুরোনো ব্যথাটা মাঝে মাঝেই জ্বালিয়ে মারে। ইদানীং কিছুটা স্মৃতিকাতরও হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘ এই জীবনের নানা স্তর থেকে কত কিছুই না এসে হানা দিচ্ছে।

‘চল্লিশ কদম’ নভেলাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা যেদিন ঘটে (কিংবা বলা যায় যেভাবে শেষ হলো ‘চল্লিশ কদম’-এর আখ্যান) সেদিনের বিকেলবেলা।

শিকদার সাহেব হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন। বড় সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে ডসনের বাড়ির সামনে চলে এসেছেন তিনি। জানেন, আজ মঙ্গলবার এবং ডসন বাড়িতে নেই। প্রতি মঙ্গলবারে গাড়ি চালিয়ে শহরে মেয়ের কাছে যান ডসন। সকালেই আবার ফিরে আসেন। শরীরটা খারাপ লাগছে বলে ইয়াকুব মোল্লাও মসজিদে আসেননি আজ। ডসনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে হঠাৎই শিকদারের মনে হলো ওর চাইতে সমাজে নিশ্চয়ই তার দাম বেশি, কেননা এত প্রতিভা, এত গুণ, এত পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও ডসন তো নিছকই একজন আসবাব নির্মাতা। এই ভাবনা তার অন্তরে বড়ই সন্তুষ্টি এনে দেয়।

এরপর ধানখেতের মধ্যে নেমে আলপথ ধরে ইয়াকুব মোল্লার বাড়ির দিকে হাঁটতে গিয়ে বুকের মধ্যে একটা বন্য দাপাদাপি অনুভব করেন শিকদার। একপর্যায়ে কাদামাটির ওপর লুটিয়ে পড়েন তিনি। গ্রামের লোকেরা এখানে তাকে মৃত অবস্থায়ই পায়।

‘চল্লিশ কদম’ নভেলাটি কিন্তু আরম্ভ হয়েছে আখ্যান সমাপ্তির এই জায়গা থেকেই। নভেলার শুরুটা এ রকম-শিকদার সাহেব মাটির ছয়ফিট তলায় শুয়ে আছেন। মারা যে গেছেন সে বিষয়ে তিনি খুব নিশ্চিত নন। কিন্তু যারা তাঁকে কবর দিয়েছেন তাঁরা তো নিশ্চিত হয়েই দিয়েছেন। শিকদারের মনে পড়ে তিনি মোল্লার খোঁজে ধানখেতের আলপথ ধরেছিলেন। তারপর কখন যে কী ঘটে গেল! এখন এই কবরে শুয়ে শুয়ে মুনকার-নাকিরের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তাঁর। আবার মনে হলো, তিনি তো নিশ্চিত নন তাঁর দাফন সত্যিই হয়েছে কিনা? এমনও তো হতে পারে, বিবিসাহেবা তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে মুহূর্তে জাগিয়ে দেবেন আর সব শুনে বলবেন যে, তিনি সারারাত ধরে একটা বদ খোয়াব দেখছিলেন। সত্যি কি কারও খোয়াবের মধ্যে অনুভূতির এমন জীবন্তরূপ বা চিন্তার এমন স্বচ্ছ প্রাঞ্জলতা সম্ভব? আর সত্যিই যদি তিনি ইন্তেকাল করে থাকেন তবে সেটা নিশ্চিত হওয়ার একটাই উপায় আছে-পায়ের আওয়াজ গোনা। যাঁরা তাঁকে গোড় দিয়েছেন তাঁদের শেষ ব্যক্তিটির শেষ চল্লিশটি কদম গোনা। কারণ দাফনে অংশ নিয়ে ফিরে যাওয়া শেষ মানুষটির চল্লিশ কদম শেষ হলেই তাঁর সারাজীবনের কর্মের হিসাব নেয়ার জন্য এসে দাঁড়াবেন দুই ফেরেশতা,মুনকার আর নাকির। কোরান-হাদিস ঘেঁটে মোল্লা তো তাঁকে এমনটাই বলেছিলেন।

শহর থেকে ফিরে বন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে কবরখানায় সবার শেষেই এসেছেন ডসন। দাফনের কাজ শেষ করে সবাই ফিরে যাচ্ছেন। তাঁদের একেবারে পেছনে ধীরে ধীরে হাঁটছেন বিদেশি মানুষটি। কবরে শুয়ে এই শেষ ব্যক্তিটির খড়মের চেনা আওয়াজ পাচ্ছেন শিকদার। কান খাড়া করে নিজের মৃত্যুকে নিশ্চিত করার জন্য সেই পদশব্দ গুনে যাচ্ছেন তিনি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ