X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুকে ‘হা-হা রিঅ্যাক্টে’ সংঘাত, নিহত ৩ জনের স্বজনদের আহাজারি

রায়হানুল ইসলাম আকন্দ, গাজীপুর
১৬ মার্চ ২০২২, ২৩:০৩আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২২, ২৩:০৯

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলায় ফেসবুক পোস্টে কমেন্টের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে মারা যাওয়া তিন জনের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। উপার্জনক্ষম এই তিন যুবককে হারিয়ে কাঁদছেন স্বজনরা। কাপাসিয়া উপজেলার সনমানিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণগাঁও গ্রামে শনিবার রাত ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এতে তিন জন নিহত ও চার জন আহত হন।

চর আলীনগর গ্রামের এক যুবকের স্ত্রীর ফেসবুকের ছবিতে ‘হা-হা রিঅ্যাক্ট’ দেওয়াকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন নিহতদের স্বজন, এলাকাবাসী ও পুলিশ। ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবিতে সোমবার এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে স্থানীয়রা। এরই মধ্যে এ ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক ও তার স্ত্রীসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

নিহতরা হলেন উপজেলার সনমানিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণগাঁও গ্রামের হিরণ মিয়ার ছেলে রবিন মিয়া (২০), আলম মিয়ার ছেলে ফারুক মিয়া (২৫) ও মৃত আলম হোসেনের ছেলে নাঈম হোসেন।

মিনতি করেও রবিনকে ছুরিকাঘাত থেকে বাঁচাতে পারেননি বড় ভাই মোজাম্মেল

তিন ভাই ও তিন বোনের সংসারে রবিন ছিলেন বাবাহারা। বড় ভাই মোজাম্মেল ও রুহুল আমীন রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। রবিন স্থানীয় আড়াল বাজারে বাচ্চু মিয়ার কাপড়ের দোকানে তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি করতেন। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। ভালোভাবে চলছিল তাদের সংসার।

মোজাম্মেল হক বলেন, ‘হামলাকারীদের ছুরিকাঘাত থেকে ভাইকে বাঁচাতে বারবার মিনতি করেছি। এরপরও ছুরিকাঘাত করেছে তারা। ছুরিকাঘাতের কয়েক ঘণ্টার মাথায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিন মারা যায়।’

ফারুকের স্ত্রী-সন্তানের কী হবে?

সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ফারুক মিয়া। তাকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলেন স্ত্রী-সন্তান। তাদের কী হবে, এই ভেবে কাঁদছেন বাবা আলম মিয়া।

প্রতিবেশী মারুফ হোসেন জানান, ফারুক ছিলেন বাবা-মায়ের বড় ছেলে। রাজমিস্ত্রির কাজ করে স্ত্রী, দুই বছরের এক কন্যাসন্তানের ভরণপোষণ চালাতেন। বাবা আলম মিয়া এলাকায় চা দোকান চালান। যা আয় হয় তা দিয়ে সংসারে জোগান দিতেন। কিন্তু এখন বাবাকেই সংসারের ঘানি টানতে হবে। ফারুকের ছোট ভাই রিফাত স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। এখন ফারুকের স্ত্রী-সন্তানের সংসার চালাতে হবে বাবাকে।

একাই সংসারের ঘানি টানবে জাহিদ

নাঈমের বড় ভাই জাহিদ। তিন ভাইয়ের মধ্যে নাঈম ছিলেন সবার ছোট। জাহিদের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন মেজো ভাই নাহিদ। নাঈম স্থানীয় আড়াল বাজারে একটি কাপড়ের দোকানে তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি করতেন। তাদের বাবা মারা গেছেন প্রায় নয় বছর আগে।

আরও পড়ুন: ফেসবুকে কমেন্টের জেরে ছুরিকাঘাত, প্রাণ গেলো ৩ যুবকের

জাহিদ হোসেন জানান, তিন ভাই ছাড়াও মা, তিন বোন এবং এক বোনের দুই সন্তানসহ নয় জনের সংসার তাদের। বাবা হারা সংসারে জীবিকা নির্বাহের জন্য ভাইদের কেউ পড়াশোনায় মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। এক বোনকে বিয়ে দেওয়ার পর স্বামী চলে যান। তার দুটি সন্তান এবং অপর দুই বোনের পড়াশোনার খরচও চালাতে হয়। বোন দুটি এলাকার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। নয় সদস্যের সংসারে তিন ভাইয়ের উপার্জনে চলতো। নাঈম মারা যাওয়ায় উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেলো। এখন দুঃখে-কষ্টে জাহিদকে সংসারের ঘানি টানতে হবে।

উপার্জনক্ষম এই তিন যুবককে হারিয়ে কাঁদছেন স্বজনরা

সনমানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জাহাঙ্গীর আলম বলেন,  কাপাসিয়ার চর আলীনগর গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে জাহিদ হোসেনের স্ত্রী মারিয়ার ফেসবুকের ছবিতে ‘হা-হা রিঅ্যাক্ট’ দেয় নাঈম। এ নিয়ে মনোহরদী উপজেলার দৌলতপুর এলাকার ইয়াসিনের সহযোগীদের সঙ্গে নাঈমের মারামারির ঘটনা ঘটে। জাহিদ ও তার সহকর্মীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় জাহিদের স্ত্রী মারিয়াও সঙ্গে ছিল।

ইয়াসিন ছোট ঘটনাটি সংঘাতের দিকে নিয়ে গেছে

নাঈমের বড় ভাই জাহিদ হোসেন বলেন, ‘মনোহরদী উপজেলার হারুন অর রশীদের ছেলে ইয়াসিন ফেসবুক কমেন্টের ছোট ঘটনাটি বড় করে ফেলেছে। সে জাহিদের বন্ধু। কমেন্টের বিষয় নিয়ে মূলত জাহিদ ও তার স্ত্রীকে উত্তেজিত করেছে ইয়াসিন। সেই সঙ্গে নাঈমকে বলেছিল, এজন্য জাহিদ মারধর করবে। তখন নাঈমও পাল্টা মারধরের কথা বলেছিল। এভাবে ঘটনাটি সংঘাতে রূপ নেয়। এরপর ইয়াসিন মোবাইল ফোনে কল দিয়ে নাঈমকে ডেকে নিয়ে গেলে সংঘর্ষ লেগে যায়। ঘটনার পর থেকে ইয়াসিন পলাতক। এ ঘটনায় জড়িতদের সাত জনই মনোহরদী উপজেলার বাসিন্দা।’

বিস্মিত এলাকাবাসী

দক্ষিণগাঁও গ্রামের গৃহবধূ নুসরাত জাহান বলেন, ছোট একটি বিষয় নিয়ে তিন জনের প্রাণ ঝরে গেলো। ফেসবুক পোস্টে কমেন্টের জেরে এত বড় একটা ঘটনা ঘটবে কেউ কল্পনাও করেনি। এ নিয়ে বিস্মিত এলাকাবাসী। নিহতদের স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা জানা নেই আমাদের।

শ্রীপুরের মাওনা পিয়ার আলী কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও লেখক মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ফেসবুক পোস্টে কমেন্টের জেরে এমন ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের উদাহরণ। মানবতাবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা সমাজ থেকে উঠে যাচ্ছে। নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে এসব ঘটনা ঘটছে। পরিবার ও সমাজ থেকে একদল যুবক বিচ্ছিন্ন হয়ে অপরাধে জড়াচ্ছে। এসব যুবককে বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রকেও এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।’

শত শত মানুষের সামনে ঘটেছিল এই ঘটনা

ঘটনার দিন রাতে দক্ষিণগাঁও গ্রামে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। মানুষের চিৎকার শুনে মাহফিলের লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। সবার সামনে এ ঘটনা ঘটলেও কেউ এগিয়ে আসেননি বলে নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ। ঘটনার অনেক পরে পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাস্থলে গেছেন। এরই মধ্যে তিন জনের মৃত্যু হয়।

জানাজা ও দাফন

কাপাসিয়া উপজেলার দক্ষিণগাঁও মরিয়ম ভিলেজের শেখ রাসেল স্টেডিয়ামে রবিবার রাতে নিহতদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাদের দাফন করা হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. মামুন জানান, গ্রামের লোকজন ছাড়াও আশপাশের হাজারো মানুষ জানাজায় অংশ নেন। নিহতদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। গ্রামের মানুষ সুষ্ঠু এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে সোমবার দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে।

আরও পড়ুন: ফেসবুকে মন্তব্যের জেরে তিন জন নিহতের ঘটনায় গ্রেফতার ৬

কাপসিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আমানত হোসেন খান নিহতদের স্বজনদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানান। সেই সঙ্গে তাদের আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। এরই মধ্যে আসামিদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আদালতে তাদের বিচার হবে।

যা বলছে পুলিশ

কাপাসিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমীরুল ইসলাম বলেন, ফেসবুক পোস্টে কমেন্টের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় নিহত ফারুকের বাবা আলম মিয়া রবিবার চিহ্নিত ১০ জন ও অজ্ঞাত চার জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত যুবক ও তার স্ত্রীসহ ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত কেউই ছাড় পাবে না।

এ ঘটনায় আহতরা হলেন মির্জানগরের ইসমাইলের ছেলে হৃদয় ও মামুরদি গ্রামের আমজাদ হোসেনের ছেলে ফাহিম, প্রতিপক্ষের চর আলীনগর গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে জাহিদ ও তার স্ত্রী মারিয়া।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন মনোহরদী উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের রফিক মিয়ার ছেলে ফয়সাল (১৬), কুচেরচর গ্রামের মোস্তফার ছেলে বেলায়েত হোসেন (২৩) ও সিরাজুল ইসলামের ছেলে শেখ শাহেদ (১৬), কাপাসিয়া উপজলার চরসনমনিয়া গ্রামের রিপন মিয়ার ছেলে মারুফ হোসেন (১৫), চর আলীনগর গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে জাহিদ (২৪) ও তার স্ত্রী মারিয়া (২০)।

কালীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জাহিদ ও তার স্ত্রী মারিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

/এএম/
সম্পর্কিত
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
বৈশাখী মেলায় গানের আয়োজন, কমিটির সঙ্গে দর্শকদের সংঘর্ষে নিহত ১
চারতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে মাদ্রাসাছাত্রীর মৃত্যু
সর্বশেষ খবর
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!