অক্সিজেন সংকটে নীলফামারী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে শিশুদের বিশেষ পরিচর্যা কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। সেখানে নেই পর্যাপ্ত শয্যা, চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। এ অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ শিশু রোগীদের প্রাণহানির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এই হাসপাতালে নবজাতকদের জন্য স্পেশাল কেয়ার অব নিউবর্ন (স্ক্যানু) ইউনিট ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি চালু হয়। সেখানে একজন নবজাতকের জন্য অক্সিজেন থাকার কথা ১০ থেকে ১২ লিটার। এর বিপরীতে রয়েছে মাত্র ২ লিটার। ফলে শ্বাসকষ্টজনিত সিভিয়ার সমস্যায় নবজাতকদের হরহামেশা পাঠানো হচ্ছে রংপুরে। ওই ইউনিটে প্রতিদিন ২০-২৫টি নবজাতক চিকিৎসা নিতে আসে। জেলায় রেডিও থেরাপি বা অপরিপক্ব শিশুর চিকিৎসার একমাত্র নির্ভরযোগ্য সেবাকেন্দ্র এটি।
জেলা সদরের রামনগর ইউনিয়নের বাহালীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ভুক্তভোগী আয়েশা খাতুন (২৪) নামে এক প্রসূতির বাবা আশরাফ আলী বলেন, ‘গত ২২ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টায় স্থানীয় একটি ক্লিনিকে আমার মেয়ের সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। এরপর শ্বাসকষ্টজনিত রোগে নবজাতককে ওই রাতেই নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শিশুটিকে ভর্তির পর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে অক্সিজেন সংকটের কারণে শিশুটির অবস্থার অবনতি হলে ২৩ আগস্ট সন্ধ্যায় রংপুরে পাঠানো হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আব্দুল আউয়াল ওই রাতেই শিশুটির সমস্যা জানতে পেরে আমাকে বলেন, “নার্সদের আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলেন।” কিন্তু উল্টো নার্সরা আমাকে ফোন দিতে বলেন। সেখানে সেবা না পেয়ে আমার নাতিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিতে হয়। আমার মেয়ে নীলফামারীর ক্লিনিকে আর নাতি রইল রংপুরে। এসব দেখার কেউ নেই।’
অভিযোগ পাওয়া গেছে, নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে শিশুদের ওই ইউনিটে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সেখানে নবজাতকরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না। অক্সিজেন, ওষুধ ও বেড সংকটের কারণে এক থেকে ২৮ দিনের নবজাতককেও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
হাসপাতালের ওই ইউনিটের দায়িত্বরত সিনিয়র স্টাফ নার্স জোছনা বর্মণ ও কোহিনুর আকতার কণা বলেন, ‘এই ইউনিটে চাহিদার তুলনায় অক্সিজেন ও চিকিৎসক না থাকায় শিশুটিকে রংপুরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ আরেক চিকিৎসক বলেন, ‘বিশেষ পরিচর্যা কেন্দ্রে সিজারিয়ান নবজাতক ও স্বাভাবিক প্রসবের শিশুদেরও বিভিন্ন কারণে দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। প্রতিটি হাসপাতালে শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ওয়ার্ডে কর্তব্যরত একজন নার্স বলেন, ‘মেডিক্যাল অফিসার না থাকায় শিশুদের চিকিৎসা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। একটি শিশুর কখন কী হয় বলা যায় না। সেটি লক্ষণ দেখে বুঝতে হয়। গত মঙ্গলবার এই ইউনিটে একজন নবজাতকে রাতে দ্রুত রংপুরে পাঠাতে হয়। মায়ের অনুপস্থিতিতে সব ধরনের সেবা আমাদের নিশ্চিত করতে হয়। তাই এখানে একজন চিকিৎসক সব সময় থাকা প্রয়োজন।’
হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও সুপারভাইজার আনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘ওই ইউনিটটি চালাতে ১০-১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দরকার। তিন জন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা, চার জন নার্স, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী লাগে। এর মধ্যে কর্মরত আছেন শুধু চার জন নার্স। বাকি পদগুলো শূন্য।’
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. গোলাম রসুল রাখি বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই এ সমস্যা বিরাজ করছে। জনবল সংকট, শয্যা সংখ্যা, শৌচাগার, ফিডিং কর্নার, বসার জায়গা ও ইনডোরে ডাক্তার নেই, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সদরের কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের শাহপাড়ার বাসিন্দা ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ফুলবালা (২৪) বলেন, ‘আমার একদিন বয়সের সন্তান জন্মের পর থেকে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হয়। হাসপাতালে বিছানা না পেয়ে বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এখানে রোগী নিয়ে থাকার মতো একটুও পরিবেশ নেই। আর নার্সদের যে ব্যবহার তা বলাই যায় না।’
একই ইউনিয়নের সুটিপাড়া গ্রামের পাঁচ দিনের নবজাতক নিয়ে আসা সাদিয়া বেগম বলেন, ‘এক বিছানায় দুটি রোগী নিয়ে থাকা খুবই কষ্ট। এটি শিশুদের জন্য বড় যন্ত্রণার। এতে উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি। সরকারি হাসপাতালে শিশুর সেবাই বড় সেবা।’
নীলফামারীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আবু আল হাজ্জাজ বলেন, ‘নবজাতকদের অক্সিজেন ও চিকিৎসক সংকটের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করি, আড়াইশো শয্যার সাততলা ভবনটি চালু হলে এর দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।’
উল্লেখ্য, তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী ও সদর আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর ‘নিউনেটাল’ নামে এই ইউনিটটি নতুনভাবে চালু করেন ২০১৩ সালে। এটি এই হাসপাতালে আগে ছিল না।