দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ কিংবা প্রার্থী দেওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত দেয়নি বিএনপি। এক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে দলটি। এই ‘কৌশলী অবস্থানে’ ভোটের মাঠে নেমেছেন বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনে প্রকাশ্যে ভোটের মাঠে দেখা গেছে তাদের। প্রার্থীদের প্রচার-গণসংযোগে গত দুদিন নগরী ছিল সরগরম। প্রচার শেষে সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কে হতে যাচ্ছেন। এখন চলছে সে হিসাব-নিকাশ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচনগুলোতে দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ কাউকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে না। যার যার মতো করে স্বতন্ত্রভাবে দলের নেতারা নির্বাচন করতে পারবেন। যেকোনও প্রার্থীর পক্ষে দলের নেতারা প্রচারণা চালাতে পারবেন। এ অবস্থায় কুমিল্লা সিটিতে দলের দুই নেতা প্রার্থী হয়েছেন।
এই উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও তাদের দলের সাবেক দুই নেতা মনিরুল হক সাক্কু ও নিজাম উদ্দিন কায়সার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ২০২২ সালে সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় বিএনপি থেকে বহিষ্কার হন তারা। ইতোমধ্যে দুই প্রার্থীর হয়ে মাঠে নেমেছেন মহানগর, আদর্শ সদর ও সদর দক্ষিণের বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চার জন। গত শুক্রবার সকালে প্রার্থীদের মাঝে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে প্রচারণা শুরু করেছেন তারা। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে মো. মনিরুল হক সাক্কু (টেবিলঘড়ি), নিজাম উদ্দিন (ঘোড়া), নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম (হাতি) ও তাহসীন বাহার বাস প্রতীক পেয়েছেন। আগামী ৯ মার্চ ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে।
চার প্রার্থীর পরিচয় ও মাঠের অবস্থান
মনিরুল হক সাক্কু ছিলেন কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, নিজাম উদ্দিন ছিলেন মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি, তাহসীন বাহার কুমিল্লা মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। এর মধ্যে সাক্কু দুবারের সাবেক মেয়র, নিজাম উদ্দিন গতবারের বিএনপির প্রার্থী ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের শ্যালক, তাহসীন বাহার মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কুমিল্লা-৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন ও সেনানিবাস) আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের মেয়ে এবং মাহমুদ তানিম নতুন প্রার্থী হলেও দলের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে সিটি নির্বাচনে বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নৌকার প্রার্থী প্রয়াত আফজল খানকে হারিয়ে জয়ী হন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় তখন সাক্কুকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য দলে ফিরিয়ে নেয় বিএনপি। ২০১৭ সালে সাক্কু ধানের শীষ প্রতীকে আফজল খানের মেয়ে নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে আবারও মেয়র হন। ২০২২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ৩৪৩ ভোটে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের কাছে পরাজিত হন। এই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী নিজাম উদ্দিন পান ২৯ হাজার ৯৯ ভোট।
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহারের সঙ্গে সখ্যের কারণে প্রথম ও দ্বিতীয়বার মেয়র হন সাক্কু। ২০২২ সালের নির্বাচনে বাহারের আশীর্বাদ নিয়ে মেয়র হন রিফাত। এবার দলের একক প্রার্থী হিসেবে তাহসীন বাহারের নাম চূড়ান্ত করেছে মহানগর আওয়ামী লীগ। বাহার এবার দলের নেতাকর্মী নিয়ে তার মেয়ের জন্য কাজ করছেন। অপরদিকে সাক্কুর জন্য বিএনপির কিছু নেতাকর্মী এবং নিজামের জন্য বিএনপির বড় একটি অংশ মাঠে কাজ করছেন। ফলে সাক্কু ও নিজামের জন্য বিএনপির ভোট ভাগাভাগি হবে। কারণ ইয়াছিন ও সাক্কুর নেতৃত্বে নগরীতে বিএনপির দুটি গ্রুপ রয়েছে।
সাক্কুর প্রচারণায় যারা
শুক্রবার ও শনিবার মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন দক্ষিণ জেলা যুবদলের সাবেক নেতা আনোয়ার হোসেন, আবুল হোসেন ও মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতা নুরে আলম প্রমুখ। তাদের সঙ্গে ছিলেন মহানগর ও ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা। তবে বিএনপির বর্তমান কমিটির কাউকে দেখা যায়নি প্রচারণায়।
সাক্কুকে ছেড়ে নিজামের পক্ষে বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মী
এবার সাক্কুকে ছেড়ে নিজাম উদ্দিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন স্থানীয় বিএনপির বেশিরভাগ নেতাকর্মী। ইয়াছিনের শ্যালক হওয়ায় নিজামের প্রচারণায় নেতাকর্মীদের পাল্লা ভারী দেখা গেছে। শনিবার মিছিল শেষে তার গণসংযোগে বক্তব্য দিয়েছেন ইয়াছিনের ছেলে ইফতেখার রশিদ অপু। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন সদর দক্ষিণের বিএনপির সাবেক সভাপতি এসএ বারী সেলিম, মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক আতাউর রহমান ছুটি, শহীদুল্লাহ রতন, দলের সাবেক কাউন্সিলর বিল্লাল হোসেন, ভিপি মো. দুলাল, আব্দুল জলিল, আব্দুর রহমান, সদস্য জামাল হোসেন, রিয়াজ খান রাজু, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক রেজাউল কাইয়ুম, সদস্য শফিউল আলম রায়হান, মহানগর কৃষক দলের সদস্য ইকরাম হোসেন, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সচিব আমির হোসেনসহ ওয়ার্ড, মহানগর ও সদর দক্ষিণের নেতাকর্মীরা।
নিজামের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণ
দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, সাক্কু দুবার মেয়র থাকলেও দলের কোনও কর্মসূচিতে ছিলেন না। মামলা-হামলা ও নানা ধরনের রাজনৈতিক হয়রানির সময়ে নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন না। বরং স্থানীয় সরকারদলীয় এমপির সঙ্গে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখে দলের নেতাকর্মীদের দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। অপরদিকে নিজাম বিএনপির রাজনীতি করতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয়ে কারাভোগ করেছেন। বিপদে-আপদে দলের নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছেন। এজন্য নেতাকর্মীরা নিজামের পক্ষ নিয়েছেন। এবারের নির্বাচন কুমিল্লায় বিএনপির শক্তির পরীক্ষার নির্বাচন। যে কারণে দলবেঁধে নিজামের জন্য কাজ করছেন তারা।
সর্বশেষ শনিবার নগরীতে প্রচারণার সময় ইয়াছিনের ছেলে ইফতেখার রশিদ অপু মিছিলে স্লোগান দিয়েছেন, ‘খালেদা জিয়ার মার্কা, ঘোড়া মার্কা। তারেক রহমানের মার্কা, ঘোড়া মার্কা, বিএনপি মার্কা, ঘোড়া মার্কা। হাজী ইয়াছিনের মার্কা, ঘোড়া মার্কা ও নিজাম উদ্দিনের মার্কা, ঘোড়া মার্কা।’
যে কারণে ভোটের মাঠে বিএনপি নেতারা
নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, দল ক্ষমতায় নেই বহু বছর। দীর্ঘ এই সময়ে নেতাকর্মীরা জিম্মিদশায় পড়েছেন। নেতৃত্ব না থাকায় পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় তাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে। গত সিটি নির্বাচনেও উল্লেখযোগ্য কোনও নেতাকর্মী মাঠে নামতে পারেননি। দীর্ঘদিন বঞ্চনায় হাঁপিয়ে উঠেছেন। একপ্রকার দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাই নিরুপায় হয়ে ভোটের মাঠে নেমেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একাধিক সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, হাজী ইয়াছিন ও নিজাম উদ্দিন তাদের দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের পরাজয় হলে নেতাকর্মীদের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এজন্য ইয়াছিনের অঘোষিত প্রার্থী নিজামকে জেতাতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন তারা। গত নির্বাচনে এই প্রার্থী বিএনপি নেতাকর্মীদের তেমন সমর্থন না পেলেও ৩০ হাজার ভোট পেয়েছেন। এবার দলের নেতাকর্মীরা তার জন্য কাজ করায় জেতার ব্যাপারে আশাবাদী।
যা বলছেন ভোটাররা
এবার বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা শেষ পর্যন্ত যার পক্ষে থাকবে, তার পক্ষেই যাবে নির্বাচনি ফল। কারণ আওয়ামী লীগের দুই নেতা প্রার্থী হওয়ায় ভোট ভাগাভাগি হবে। আবার বিএনপির সাবেক দুই নেতা প্রার্থী হলেও দলের নেতারা সাক্কুকে বাদ দিয়ে নিজামের জন্য কাজ করায় এগিয়ে থাকবেন নিজাম।
যা জানালেন বিএনপির দায়িত্বশীলরা
বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (কুমিল্লা বিভাগ) মোস্তাক মিয়া বলেন, ‘মনিরুল হক সাক্কু ও নিজাম উদ্দিন দল থেকে বহিষ্কৃত। ওই বহিষ্কারাদেশ এখনও প্রত্যাহার হয়নি। উপনির্বাচনে তাদের পক্ষে দলের কেউ প্রকাশ্যে প্রচারণায় নামলে কেন্দ্রের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব ইউসুফ মোল্লা টিপু বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে যায়নি। যারা গেছে তারা বহিষ্কৃত। যারা তাদের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন, সবাই ব্যক্তিগতভাবে করছেন। এর সঙ্গে দলের সম্পর্ক নেই।’
ভোটে অংশ নেওয়ার বিষয়ে যা বললেন সাক্কু ও নিজাম
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির বাইরে গিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমাকে দল বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের সঙ্গে আমার নির্বাচনের কোনও যোগসূত্র নেই। কুমিল্লার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি। এখানে দলের কোনও প্রশ্ন নেই। এবারের নির্বাচন কুমিল্লার মানুষের জিম্মিদশা থেকে মুক্তির নির্বাচন। তাই দলমত নির্বিশেষে মাঠে নেমে পড়েছে। এবার দলের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আমার পক্ষে কাজ করছেন। নিজ নিজ দায়িত্বে সবাই নিজের জন্যই কাজ করছেন। তারা একটা সুন্দর নগরী গড়ে তোলার পক্ষ নিয়েছেন।’
মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘আমি ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। মানুষ আমাকে চায়, তাই নির্বাচনে এসেছি। নির্বাচন করছি। বিএনপির নেতাকর্মীদের সমর্থন আছে। তবে নেতাকর্মীদের একটি অংশ আমার সঙ্গে নেই, এটা সত্য। সবাই কি আর এক জায়গায় থাকবে? মানুষের যাকে ইচ্ছে তাকে ভোট দেবে।’
তাহসীন বাহারের প্রচারণা
এদিকে প্রতীক পাওয়ার পর থেকে তাহসীন বাহার মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রচারণায় অংশ নেন। এ সময় তিনি পরিকল্পিত স্মার্ট নগরী গড়তে বাস প্রতীকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ করেন ভোটারদের। তিনি বলেন, ‘আমার জন্য দলের নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।’
মাহমুদ তানিমের প্রচারণা
আওয়ামী লীগের প্রয়াত সাবেক নেতাদের কবর জিয়ারত করে প্রচারণা শুরু করেছি জানিয়ে নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম বলেন, ‘আমার জন্য দলের অনেক নেতাকর্মী কাজ করছেন। সামনে আরও অনেকে আমার প্রচারণায় অংশ নেবেন। কয়েক দিনের মধ্যে কেন্দ্র কমিটি করবো। আশা করছি মানুষ আমাকে ভোট দেবে।’
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এই সিটির মেয়র আরফানুল হক রিফাত। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, ওই পদে আগামী ৯ মার্চ ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে। সিটি করপোরেশনে ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৪২ হাজার ৪৫৮। তাদের মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি।