X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
মুক্তাগাছার বিনোদবাড়ি মানকোনে গণহত্যা

একদিনে শিশুসহ ২৫৩ জনকে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী

আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ
২৭ মার্চ ২০২৩, ০১:০০আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৩, ০১:০০

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে রাজাকার-আলবদরের সহায়তায় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার বিনোদবাড়ি মানকোন গ্রামে একদিনে নারী-শিশুসহ ২৫৩ জনকে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী। হত্যার পর অগ্নিসংযোগ করে গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। একাত্তরে এটিই ছিল একদিনে মুক্তাগাছায় সবচেয়ে বড় গণহত্যার ঘটনা। 

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, সেদিন একসঙ্গে ২৫৩ জনকে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী। বিনোদবাড়ি মানকোন গ্রামের এসব বধ্যভূমি ইতোমধ্যে চিহ্নিত করে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে শহীদদের নাম-সংবলিত সাইনবোর্ড।

সেদিনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী মানকোন গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব নূর বানু বেওয়া। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, হারিয়েছেন স্বামীকে। নিষ্ঠুরতার কথা মনে হলে এখনও কেঁপে ওঠেন। কাঁদেন নীরবে, চোখের পানি মোছেন শাড়ির আঁচলে। দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে এভাবে বেঁচে আছেন।

নূর বানু বেওয়া বলেন, ‘রাজাকার-আলবদরের সহায়তায় এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল হানাদার বাহিনী। বেঁচে থাকতে যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার-আলবদরের বিচার দেখার ইচ্ছে ছিল। জীবদ্দশায় তাদের বিচার দেখে যেতে পারছি। আমার আশা পূরণ হয়েছে।’

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলেছেন, দিনটি ছিল ২ আগস্ট, সোমবার, ১৯৭১ সাল। বিনোদবাড়ি মানকোন গ্রামের নিম্নাঞ্চলের চারদিক ছিল পানিতে থই থই। মাঠভর্তি আউশ ধান ও পাটের আবাদ। মুক্তাগাছা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বড়গ্রাম ইউনিয়নে বিনোদবাড়ি মানকোন গ্রামের অবস্থান। মুক্তাগাছা-জামালপুর সড়কের চেচুয়ার পথে ‘দড়িকৃষ্ণপুর’ মানকোন গ্রামেরই একটি পাড়া। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত তিন মাসের ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নূর বানু। এরই মধ্যে গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানি আর্মি আসছে। তখন স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ঘরে আশ্রয় নেন নূর। স্থানীয় রাজাকার জবেদ আলী মুন্সি দুই পাকিস্তানি আর্মিকে নিয়ে নূর বানুর বাড়িতে আসে। কিছুক্ষণ পর নূর বানুর স্বামী রহমত আলী ও দেবর মোতালেবকে ডেকে বাড়ির উঠানে নিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। ওই সময় পাশের ঘরের সামনে কোরআন শরিফ হাতে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল নূর বানুর ভাশুর। তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। স্বামী, ভাশুর ও দেববের লাশ উঠানে পড়ে থাকতে দেখে শিশুপুত্র ও দুই মেয়েকে নিয়ে ঘরে লুকিয়ে ছিলেন নূর। পরে একে একে বাড়ির নারীদের টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে গুলি করা হয়।

নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী মানকোন গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব নূর বানু

একপর্যায়ে সবগুলো ঘরে তল্লাশি চালানো হয়। নূর বানুও ধরা পড়েন। তবে তার দুই মেয়ে লুকিয়েছিল ঘরের আরেক কোণে। কোলের শিশুসন্তানকে বিছানায় শুইয়ে নূরকে বাইরে আসতে বলে জবেদ। কিন্তু শিশুকে কোলে নিয়েই বাইরে আসেন। বাড়ির অন্য নারীদের সঙ্গে নূর বানুকে দুই ঘরের মাঝখানে এক কাতারে দাঁড় করানো হয়। সবাই তখন হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। নূর বানু ছিলেন সবার সামনে। হানাদার বাহিনী যখন গুলি ছুড়েছে তখন নিচু হয়ে ঘরে ঢুকে যান নূর। তবু পিঠে গুলি লাগে। এ অবস্থায় ঘরের পেছনের বেড়া ভেঙে তিন সন্তানকে নিয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে যান। রাতে বাড়ি ফিরে এত লাশ দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন। সেদিন এই বাড়ির ১৮ জন শহীদ হন। প্রতিবেশী কমলা বেগম ও সুরুজের বাবা রাতভর লাশগুলো পাহারা দেন। পরদিন জানাজা ছাড়াই ১৮টি লাশ গণকবর দেওয়া হয়।

জাতীয় সংসদের জাপা দলীয় সাবেক স্পিকার ও মুসলিম লীগের সাবেক নেতা মরহুম শামসুল হুদা চৌধুরীর বিনোদবাড়ি গ্রামের বাড়িটি ছিল একাত্তরে অনেকের জন্য নিরাপদস্থল। ‘বলের বাড়ি’ নামে পরিচিত এই বাড়িতে তখন থাকতেন শামসুল হুদার ভাই আলী আকবর। পাকিস্তানি আর্মি আসছে খবর পেয়ে এলাকার নারী-শিশুরা আশ্রয় নেন এই বাড়িতে। 

বিনোদবাড়ি মানকোন গ্রামের আতিকুর রহমান (৬৫) ও মনসুর আলী (৭০) জানান, এই বাড়িতে নারী-শিশুদের আশ্রয় নেওয়ার কথা হানাদার বাহিনীকে বলে দেয় রাজাকার হাক্কু ও আমজাত। পরে বাড়ির ভেতর থেকে নারী-শিশুদের বাইরে এনে এক কাতারে দাঁড় করায় হানাদাররা। এর মধ্যে মন্ডল পরিবারের নবীজান, মেয়ে জুলেখা, মালেকা, ফেরদৌসী, রহিতন, বোন খালেতন ও তার মেয়ে হামিদাসহ সাত সদস্য ছিল। সেদিন এই বাড়িতে তিন শিশুসহ ১৭ নারীকে হত্যা করে হানাদাররা।

ওই দিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া মুনসুর আলী (৭৫) জানান, বলবাড়িতে হত্যাকাণ্ডের পর নারী-শিশুদের গাছের ডালে ও ঘরের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল হানাদার বাহিনী। পরে ১৭ জনকে গণকবর দেওয়া হয়।

মানকোন গ্রামের হাজর মন্ডল বাড়ির ষাটোর্ধ্ব জবান আলী জানান, সেদিন পালাতে গিয়ে রাজাকার ও এক পাকিস্তানি আর্মির সামনে পড়ে যান জবান, রহমত, খালেক ও মতোলাসহ চার জন। জবানের সঙ্গী তিন মুসলিম লীগ কর্মী পাকিস্তানি আর্মির কাছাকাছি চলে গেলে একা হয়ে পড়েন জবান। রাজাকার জবেদ মুন্সি জবানকে চিনিয়ে দেয়। এ সময় পাকিস্তানি আর্মির কাছ থেকে তিন দফা বন্দুক কেড়ে নেন জবান। কিন্তু গুলি চালাতে না পারায় ফের কেড়ে নেয়। একপর্যায়ে গুলি চালালে জবান মাটিতে পড়ে যান। মৃত ভেবে জবানকে ফেলে যায়। পাকিস্তানি আর্মি চলে গেলে ঘাটুরিয়া মামার বাড়িতে পৌঁছে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে যান গুলিবিদ্ধ জবান। 

এই গ্রামের হাফিজা খাতুন (৬৭) জানান, পাকিস্তানি আর্মির ভয়ে অনেকের সঙ্গে স্বামী কুমেদ আলী আশ্রয় নেন স্থানীয় বাইয়া বিলে। আর্মিরা সেখানে গিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে। খবর পেয়ে পরদিন বাইয়া বিলের লাশের স্তূপ থেকে স্বামীর লাশ নিয়ে বাড়িতে আসেন হাফিজা। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও এই পরিবারের কেউ খোঁজ নেয়নি বলে অভিযোগ হাফিজার। 

মানকোন গ্রামের এসব বধ্যভূমি ইতোমধ্যে চিহ্নিত করে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে শহীদদের নাম-সংবলিত সাইনবোর্ড

একই দিন কাতলসার গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে ২৮ জনকে ধরে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। এর মধ্যে এক বাড়ির সদস্য ছিলেন সাত জন। 

কাতলসার শহীদ স্মৃতি রেজি. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ওমর আলী (৬৭) জানান, রাজাকার করিম মুন্সির সহায়তায় সেদিন ২৮ জনকে ধরে নিয়ে স্থানীয় কৈয়ার বিলপাড়ে বসিয়ে রাখে হানাদার বাহিনী। তাদের পাহারায় ছিল রাজাকার করিম মুন্সি ও আরেক রাজাকার। পরে কাতলসার গ্রামের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ২৮ জনকে এক কাতারে দাঁড়াতে বলা হয়। এরই মধ্যে গুলি চালায় হানাদাররা। গুলির আগে লাইনে থাকা শহীদ মন্নেছ আলী অনুরোধ করে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে যাদের গায়ে গুলি লাগেনি তারা বেঁচে যান। পরে কৈয়ার বিলপাড়ে ১৪ জনের লাশ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সাত জনকে কাতলসার শহীদ স্মৃতি রেজি. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ও বাকি সাত জনকে বিলপাড়ে গণকবর দেওয়া হয়। ওই দিন গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান মাহমুদ, সোহরাব, সিদ্দিক ও ওয়াহেদসহ ১৪ জন।

বিনোদবাড়ি মানকোন গ্রামের জীতেন্দ্র প্রসাদ ঠাকুর বাড়িতে আক্রমণের মধ্য দিয়ে এসব হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল হানাদাররা। ওই বাড়ির অরুণ চন্দ্র দাস (৭২) ও কায়া রানি দে (৭০) জানান, গ্রামে ঢুকে গুলি ও অগ্নিসংযোগ শুরু করেছিল হানাদাররা। পরে বাড়ির সদস্যদের ধরে নিয়ে ঘরের সামনে জড়ো করে। শেষে রাজাকাররা বেছে বেছে কয়েকজনকে ছেড়ে দেয়। এরপর ঠাকুর বাড়ির যতীন্দ্র কুমার রায়, দিলীপ কুমার ঠাকুর, নারায়ণ কুমার দে ও জীতেন্দ্র প্রসাদ ঠাকুরকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

মানকোন গ্রামের কাশেম আলী (৭২) জানান, তার বাবা আজগর আলী ও ভাই ওসমানকে হাল চাষ করা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেছিল হানাদাররা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য তাজ উদ্দিন (৭১) জানান, স্থানীয় রাজাকার নঈম উদ্দিন, জবেদ আলী মুন্সি, করিম ফকির, আতিকুর রহমান, আব্দুস সালাম ও নজর আলী ফকিরের সহায়তায় মানকোন গ্রামে সকাল ৭টার দিকে ঢুকেছিল হানাদার বাহিনী। ১০০-১৫০ পাকিস্তানি আর্মি বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। চলে নির্বিচারে গণহত্যা। মানকোন থেকে সকালে শুরু হওয়া এই বর্বরতা চলে দড়িকৃষ্ণপুর, বনবাড়িয়া, কাতলসার, মীর্জাকান্দা, কৈয়ার বিলপাড় ও বাইয়া বিলের প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এ সময় ২৫৩ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। 

বলের বাড়িতে নারী-শিশুসহ ১৮ জনকে হত্যা করেছিল হানাদার বাহিনী

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম (৭০) বলেন, ‘সেদিন ২৫৩ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাবেক এমপি মৃত কেরামত আলী তালুকদারের পরামর্শে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। মুক্তাগাছা থানার রাজাকার-আলবদর কমান্ডার চাঁন ও সুরুজ এসব হত্যা এবং অগ্নিসংযোগে পাকিস্তানি আর্মিদের সহায়তা করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর আগেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় চাঁন ও সুরুজ দুই ভাই। রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল মুক্তাগাছা থানা সদরের বড় মসজিদ সংলগ্ন মাড়োয়াড়ি পট্টিতে। সেখান থেকে এসব এলাকায় অপকর্ম চালিয়েছে তারা।’

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক বিমল পাল বলেন, ‘বিনোদবাড়ি মানকোন গ্রামের শহীদদের তালিকা তৈরির সঙ্গে বধ্যভূমি চিহ্নিত করণের কাজ চলছে।’

/এএম/
সম্পর্কিত
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও মানস ঘোষমুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবাদ সংগ্রহ
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা