‘আমাদের সমাজে পুরুষকে হিরো হিসেবে দেখতে পছন্দ করে সবাই। এই ভূমিকায় নারীকে দেখতে চান না কেউ। অথচ নারীকেন্দ্রিক গল্পে অনেক কাজ বিখ্যাত হয়েছে’- অভিনয় জগতে নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে কথাগুলো বলেছেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন।
১০ম ঢাকা লিট ফেস্টের তৃতীয় দিনের আয়োজনে ‘ধরা বাঁধার বাইরে’ শীর্ষক সেশনে অংশ নেন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-খ্যাত এই অভিনেত্রী। এতে অভিনেত্রী বন্যা মির্জার সঞ্চালনায় আরও উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা আফজাল হোসেন।
শনিবার (৭ জানুয়ারি) বিকাল সাড়ে চারটার দিকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে শুরু হয় এই সেশন। আফজাল হোসেনের আসতে কিছুটা বিলম্ব হওয়ায় বাঁধন-বন্যা মিলেই আলোচনার শুরু হয়। কিন্তু খানিক পরেই হাজির হন আফজাল হোসেন।
একই মঞ্চে বাঁধনকে দেখে তার অভিনীত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সিনেমাটির প্রশংসা করেন আফজাল হোসেন। সেই সঙ্গে দেশের বর্তমান এবং অতীতের সিনেমা-নাটকের তুলনা করেন। তার মতে, ‘‘আমরা ধরা বাঁধার ভেতরেই আছি। একটা সময় ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’র মতো ছবি হয়েছে। এরপর আমাদের তরী ভিড়েছে ‘বাবা কেন চাকর’-এ। নাটকের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এরকম।’’
আফজাল হোসেনের এমন হতাশার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাঁধন বলেন, ‘পুরো পৃথিবীতেই নারী প্রধান গল্প তেমন চিন্তা করা হয় না। হলেও তার পরিচিত প্রযোজক বা তাকে দিয়ে লাভ হবে এমন কেউ করেন। আর আমাদের এদিকে পরিস্থিতি তো আরও ভয়ংকর। এ অঞ্চলে নায়িকা বলতে বোঝানো হয় অল্প বয়সী একটা মেয়ে, যে সিনেমার অলংকার হবে। কিন্তু অন্যান্য বয়সেও যে নারীরা অন্যতম চরিত্রে কাজ করতে পারেন, তা ভাবেন না কেউ।’
এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন জরুরি মনে করেন বাঁধন। এক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলেও জানান তিনি।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব প্রসঙ্গে বন্যা মির্জা বলেন, ‘আমরা পুরুষের চোখ দিয়ে সব কিছু দেখি। কিন্তু সমাজেরও তো চোখ আছে। নারীদেরও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। যেমন একটা গ্রামের ছবি আঁকতে বললে এখনও সবাই একটা কুঁড়েঘরের ছবি আঁকেন। কিন্তু সেই ঘর তো নেই এখন। ঘরের পাশে কলাগাছ, এরকম তো হয় না। কিন্তু এটা বদলে নতুন কিছু আমরা ভাবিনি।’
নিজের একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আফজাল হোসেন বলেন, ‘ববিতার সঙ্গে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছিলাম আমি। তো একটা দৃশ্যের শুটিং হয় এয়ারপোর্টে। আমি তখন একেবারে নতুন। অনেক মানুষ এলো ববিতাকে দেখার জন্য। তাকে নিয়েই সবার মাতামাতি, আমাকে কেউ খেয়ালই করছিল না।
একজন খেয়াল করে জানতে চান, এই ছেলেটা কে? পাশের আরেকজন বলে নতুন হিরো। তখন সে বলে ওঠে, নতুন হিরো নাকি কামলা! আমার চেহারা গঠন তখন কথিত নায়কের মতো ছিলো না বলে তার এমন মন্তব্য। সুতরাং ব্যাপারটা হলো আসলে দৃষ্টিভঙ্গির।’
সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারণা ভাঙতে এখন ভারি মেকআপ করেন না বাঁধন। তার ভাষ্য, ‘সমাজ আমাদের মাথায় বীজ বপন করে দেয়, মেয়েদের বয়স বলা যাবে না, বাচ্চা হয়েছে বলা যাবে না, বিয়ের কথাও বলা যাবে না। ইদানীং আবার আমাকে অনেকে বলেন, তুমি কালো হয়ে গেছো। কারণ আমার যে স্কিন টোন, সেটাতেই এখন মেকআপ করি বা মেকআপ ছাড়াই বাইরে আসি। কারণ এটাই আমি বাঁধন। একটা সময় পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করছি ফর্সা থাকার। এর পেছনে মিডিয়াও অনেক প্রভাব বিস্তার করেছে। বিজ্ঞাপন, নাটকে মেয়েদের যেভাবে দেখানো হয়। আমি সেই জায়গা থেকে উতরে এসেছি। কিন্তু এ অবস্থানে আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আসলে প্রত্যেকটা মানুষ তার মতো সুন্দর।’
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ৫ জানুয়ারি শুরু হয় দেশি বিদেশি কবি, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, লেখকদের মিলনমেলা ঢাকা লিট ফেস্ট ২০২৩। এবার ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আয়োজন। মহামারির কারণে দীর্ঘ তিন বছর বন্ধ ছিল এই উৎসব।
চার দিনের এই উৎসবে ১৭৫টির বেশি সেশনে অংশ নিচ্ছেন পাঁচটি মহাদেশের ৫০০-এরও বেশি বক্তা, শিল্পী ও চিন্তাবিদ। পাশাপাশি চারদিন ব্যাপী এই আয়োজন শুধু বড়দের জন্যই না, থাকছে শিশুদের জন্যও নানা আয়োজন। শিশুদের বিজ্ঞান চর্চা, বিনোদন, জ্ঞান চর্চা’র কথা মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে ঢাকা লিট ফেস্টের অনুষ্ঠানগুলো।
অনলাইন রেজিস্ট্রেশন ও সরাসরি টিকিটের লোকেশন জানতে লগইন করতে হবে www.dhakalitfest.com ওয়েবসাইটে। এবারের আয়োজনে প্রবেশের জন্য প্রয়োজন হবে টিকিটের। ২০০ এবং ৫০০ টাকায় টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইনে এবং সশরীরে টিকিট কেনা যাবে। এছাড়া বাংলা একাডেমির মূল প্রবেশমুখে থাকছে স্পট রেজিস্ট্রেশনের সুবিধা। ১২ বছরের কম বয়সী ও শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিরা বিনামূল্যে প্রবেশ করতে পারবেন।