‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’– কালজয়ী গানটি তার লেখা। লিরিক দেখে বোঝা যায় এর কাব্যগুণ। তিনি মূলত কবিই। কাছের সুরকার-শিল্পীদের অনুরোধে কবিতার ফাঁকে গান লিখেছেন। তবে বরাবরই সচেতন ছিলেন যেন লিরিক তার কবিতাকে ছাপিয়ে না যায়। গানের জনপ্রিয়তা যেন গ্রাস না করে কবিসত্তাকে। তাই তো বাংলাদেশ বেতারের বড় কর্মকর্তা হয়েও কবি জাহিদুল হকের গানের সংখ্যা মাত্র শ’খানেক। অথচ তার সমসাময়িক অনেকেই গান লিখেছেন হাজার হাজার।
যদিও পেছনে ফিরে এসব ভেবে কবির কোনও আক্ষেপ নেই। বরং এখনও নিজের পুরনো সিদ্ধান্তে অবিচল। তিনি বলছেন, ‘এসব নিয়ে আমার আফসোস নেই, বরং অহংকার আছে।’ এখনও কোনও গানে কাব্যের ছোঁয়া চোখে পড়লে মনে করেন এটা তারই চেষ্টার ফসল। যে বীজ তিনি বুনেছিলেন চার দশক আগেই। কবি ও গীতিকবি জাহিদুল হকের জীবনের গল্প রইলো এই আয়োজনে।
কবিতা থেকে গানে
গান লিখতে চাইনি একেবারেই। সামান্য যে ক’টি গান রচনা করেছি, সেগুলোর অন্যতম কৃতিত্ব সুরকার কমল দাশগুপ্ত, আব্দুল আহাদ এবং খন্দকার নূরুল আলমের। তারাই আমাকে কবিতা থেকে গানে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তারা প্রায়ই বলতেন, ‘কী মিষ্টি তোমার কবিতা, তুমি আমাদের জন্য গান লেখো না কেন? আমাদের এক-দুটো গান লিখে দিলে কী হয়!’ আমি বলতাম, গানের বাণীর যে অবস্থা, গীতিকারদের যে অবস্থা– এমন পরিবেশে গান লেখার আগ্রহ পেতাম না। একরকম নাক সিটকানো বিষয় আমার মধ্যে কাজ করতো। তবুও তারা থামেননি। বিভিন্ন সময়ে আমাকে চাপ দিয়ে বলতেন, ‘ঠিক আছে, তুমি তোমার মতো করেই লিখো। সমস্যা তো নেই। কিন্তু লিখো।’
তখন ভাবলাম, আসলেই তো আমার মতো করে লিখতে পারি। আমার গানের লিরিক কবিতার দিকে ঝুঁকিয়ে দিতে পারি। এই ভেবে লেখার চেষ্টা করেছি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
প্রথম সৃষ্টি
আমার লেখা প্রথম গান সুর করেন কমল দাশগুপ্ত। যদিও শিরোনাম আমার আর মনে নেই। এটি গেয়েছেন সম্ভবত আঞ্জুমান আরা বেগম। সেই গান আর পৃথিবীতে নেই। কারণ রেকর্ডটি মুছে গেছে। তবে কবি ভাবনা থেকে বেরিয়ে আমার মূল গানটি সুরস্রষ্টা শেখ সাদী খানের সঙ্গে করেছি। এটি হলো ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’। কবিতাটি আমার খাতায় লেখা ছিল। আরও বড় লেখা ছিল। এখানে তো দুটো স্তবক। খাতায় আরও দুই-তিন স্তবক ছিল। কবিতাটি দেখে মনে হলো, আরে এটা দিয়েই তো একটা গান হতে পারে। শুধু মিটারগুলো ঠিক করে নিলেই হয়। তাই করলাম।
‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ গানটি সৃষ্টির পেছনে আরেকটি গল্প আছে। একদিন সকালবেলা শেখ সাদী খান এসে বললেন, ‘আপনার লেখা একটা গান চাই। আমার জন্য তো বটেই, বিশেষ করে একজন নতুন শিল্পীর জন্য। তিনি মূলত নজরুলগীতির শিল্পী। আমাদের সিলেট বেতার কেন্দ্রের। নাম সুবীর নন্দী। তার খুব ইচ্ছা, আপনার লেখা একটি গান গাওয়ার।’
সাদীর কাছে জানতে চাইলাম, ‘আমি কি সেই শিল্পীর কণ্ঠে একটা গান শুনতে পারি?’ সাদী বললেন, ‘হ্যাঁ, সুবীর ঢাকায় এসেছে। কালই আমি নিয়ে আসবো।’ তিনি নিয়ে এলেন। শাহবাগে বেতারের অফিসে। আমার রুমে। স্টুডিও থেকে হারমোনিয়াম এনে দিলাম। একটি নজরুল আর আধুনিক গান শোনালেন তরুণ সুবীর। পরে আরেকটি নজরুল শোনাতে বললাম। শোনালেন। ভারী মিষ্টি কণ্ঠ। মুগ্ধ হলাম। এটা ১৯৭৭ সালের কথা। গান শুনেই বললাম, আমি গান দেবো।
তারপরই আমার খাতার ওই কবিতা থেকে প্রথম দুটি স্তবক ধরে গানটি সাজালাম। মাসখানেক লাগলো গানটি তৈরিতে। খুব খুঁতখুঁতে ছিলাম এসব বিষয়ে। লিখি ঠিকই, কিন্তু পছন্দ হয় না। সুর করলে পছন্দ হয় না। রেকর্ডিং পছন্দ হয় না। এই গানটি করেছি বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের জন্য। গানটির প্রথম সুর শোনালো সাদী, পছন্দ হলো না। আবার করলো, পছন্দ হলো। সাদী অসম্ভব প্রতিভাবান, এতে সন্দেহ নাই। তারপর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে গানটি রেকর্ড হলো ১৯৭৮ সালে। তখন রেডিওর স্টুডিওতে অনেক চাপ ছিল। প্রচুর কাজ হতো। শিডিউল পাওয়া কঠিন ছিল। সেই হিসেবে গানটি লেখা থেকে রেকর্ড পর্যন্ত একবছর সময় লাগলো।
|
রেডিও থেকে সিনেমায়
১৯৭১ সাল থেকে আমি রেডিওতে কর্মরত। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ গানটি রেডিওর জন্যই তৈরি হলো। এটি সিনেমায় যাওয়ার পেছনে একটা গল্প আছে। নায়ক বুলবুল আহমেদ তখন প্রায়ই রেডিওতে আসতেন। দারুণ কণ্ঠ ছিল তার। আবৃত্তি করতেন। আমার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। তিনি এমন একটি অনুষ্ঠানে এসে আমাকে বললেন, “জাহিদ আমি তো একটা সিনেমা করছি। নাম ‘মহানায়ক’। ছবিটার জন্য এই গানটা দরকার।”
আমি একটু অবাক হলাম। রেডিওর পুরনো গানও সিনেমায় ব্যবহার করে কেউ! জানতে চাইলাম, গানটি আপনার ভালো লেগেছে? বুলবুল বললেন, ‘ভালো লেগেছে মানে! আপনি যদি অনুমতি না দেন, তাহলে আমার ভীষণ মন খারাপ হবে।’ তার আগ্রহ দেখে আর না করলাম না। এরপর তিনি গানটি আবারও রেকর্ড করান। কলকাতায় নিয়ে যান শিল্পী-সুরকারকে। সাদী সুর ঠিক রেখেই সুবীর নন্দীকে দিয়ে আবারও রেকর্ড করেন গানটি। এরপর সেটি সিনেমায় যায়।
মনে পড়ে, ছবির জমকালো মহরতে আমাকেও দাওয়াত করেছিলেন বুলবুল আহমেদ। হোটেল শেরাটনে মহরত, এখন যেটা ইন্টারকন্টিনেন্টাল। যাবো না-যাবো না ভেবেও শেষ মুহূর্তে গেলাম। তখন অনুষ্ঠান প্রায় শেষ। কেয়ারলেস ছিলাম। মহরতে গিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। বুলবুল আহমেদ আমাকে দেখে কাছে এসে কানে কানে বললেন, ‘আপনারা কবিরা মশাই অসম্ভব অহংকারী!’ বুঝলাম তিনি খুব রেগে গেছেন, অনুষ্ঠানের শুরুতে আমাকে অনেকবার ডেকেছেন মঞ্চে। এই আর কী। সিনেমায় যাওয়ার পর গানটি আরও হিট হলো।
এরপর সিনেমা থেকে গান লেখার জন্য অসংখ্য অনুরোধ পেয়েছি। কিন্তু বেশিরভাগ অনুরোধই রাখিনি। আমার কথা একটাই– গান হতে হবে কাব্যময়। গান হতে হবে দৃশ্যের সূত্র ধরে। গানের ক্ষেত্রে আগে লিরিক হতে হবে, পরে সুর। কেউ সুর করে আনলে তাতে লিরিক বসাতে পারবো না। আর আমার লিরিকে হাত দেওয়া যাবে না। যা দেবো সেটাই রাখতে হবে। এসব শর্ত অনেকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে অনেক গানই করিনি বা করতে পারিনি।
আমি রেডিওতে চাকরি করি তখন। প্রভাবশালী ছিলাম বলা যায়। কবি হিসেবেও তো কম নাম ছিল না। যেখানে গাজী ভাই (গাজী মাজহারুল আনোয়ার) ২০ হাজার গান লিখে ফেললেন, সেই হিসাবে তো আমার গান এক-দুই হাজারের কম হওয়ার কথা না। অথচ আমার গানের সংখ্যা সব মিলিয়ে শ’খানেক হবে। তবে এসব নিয়ে আমার আফসোস নেই, বরং অহংকার আছে। কারণ গানের কবিতাকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছি।
|
সমসাময়িক গীতিকবি
আমার সময়ে যারা লিখতেন, তারা সবাই বড়মাপের মানুষ। আশি-নব্বই দশকের কথা বলছি। তখন ছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, আবুল হায়াত মোহাম্মদ কামাল, মনিরুজ্জামান মনির। সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এরপর আব্দুল হাই আল হাদী, আবিদ আনোয়ার– এমন অনেকেই আছেন। সবার নাম এখন মনে পড়ছে না।
এরমধ্যে বেশি সখ্য ছিল কিংবা গুরুত্ব দিয়েছি আবু হেনা মোস্তফা কামালকে। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো ছিল, যদিও তিনি আমার অনেক সিনিয়র। গাজী ভাই তো আছেনই। তার ত্রুটি আছে, কিন্তু এমন কিছু গান তিনি রেখে গেছেন, তাকে মাথায় তুলে না রাখার উপায় নেই। এরমধ্যে রফিকউজ্জামান তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন। তার সঙ্গেও দারুণ সম্পর্ক আমার।
বেতার জীবন
কবিতা ও গানের বাইরে সাংবাদিকতা করেছি। আমি মনে করি, বেতারই আমার সামনে দুনিয়াটা খুলে দিয়েছে। বেতারের সুবাদেই ডয়েচে ভেলের সূত্র ধরে বিশ্বভ্রমণ করতে পেরেছি। ফলে বেতারের জীবন আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ি, তখন রেডিও পাকিস্তানে প্রোগ্রাম প্রডিউসার নেবে। আবেদন করলাম। ১৯৭০ সালের কথা। মার্চে ইন্টারভিউ হলো। রেজাল্ট বের হলো ডন, অবজারভারের মতো পত্রিকায়। পত্রিকায় নাম ছাপা হলো। অনেক বড় বিষয় তখন। চাকরি পেলাম। কিন্তু পোস্টিং করাচি। সত্তরের শেষ দিক। উত্তাল হচ্ছে দেশ। কিন্তু আম্মা বললেন, ‘আমি যেতে দেবো না। তুমি এখানেই থাকো।’ এরপর আমার এক শিক্ষককে অনুরোধ করে ঢাকা কেন্দ্রে পোস্টিং নিয়েছিলাম। এরমধ্যে এক বছর পার। ১৯৭১-এর ১৮ জানুয়ারি যোগ দেই ঢাকা কেন্দ্রে। বেতারের সুবিধা হলো, প্রায় সবাই ছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ শাহবাগ কেন্দ্রের অফিসার ইনচার্জ ছিলাম। এটা তখন বিশাল বিষয়। অনেক ক্ষমতাধর। আমরা পরিকল্পনা করলাম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করবো। সব প্রস্তুত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে করাচি থেকে বার্তা এলো ভাষণ প্রচার করা যাবে না। তাদের ভয় ছিল, বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা করে দেন!
আমার তো মাথায় আগুন। এমনিতেই বাম রাজনীতি করে আসা ছেলে আমি। সবাই আমাকে মানতো। ভাষণ প্রচারে বাধা আসায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দেবো। আমি আর আশফাকুর রহমান খান, আমার সিনিয়র। চমৎকার মানুষ ছিলেন। তাকে নিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম, চলো রেডিও বন্ধ করে দেই। সবাই তখনই মাস্টার কন্ট্রোল রুমে (এমসিআর) গেলাম। সন্ধ্যা ছয়টা-সাড়ে ছয়টা হবে। সেখানে গিয়ে একে অপরের হাতে হাত রেখে স্টেশন সুইচ অফ করে দিলাম।
বঙ্গবন্ধু নিজেই তো সেদিন বললেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি...’। সেই মন্ত্রবলেই বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। এই কাজের মাধ্যমে আমিই তো স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। এর আগে তো যুদ্ধটা শুরু হয়নি। এই গৌরব আমি করতেই চাই। এটা আমার আত্মজীবনীতেও লিখবো। আমিসহ সেদিন আরও যারা সহকর্মী ছিলেন, সবাই মিলেই মুক্তির যুদ্ধটা শুরু করেছি বেতার থেকে।
পরদিন অবশ্য, সচিব-মন্ত্রী-সামরিক বাহিনী পর্যন্ত গড়ালো বিষয়টি। এরপর সিদ্ধান্ত হলো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতার সম্প্রচার করবে। আমাদের আশ্বস্ত করলো। আমরা পরদিন আবারও কাজে ফিরলাম।
|
পারিবারিক সমর্থন
পরিবারের সমর্থন পেয়েছি। বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। শিল্পের বিষয়ে সমর্থনটা আসলে বোঝা যায় না। তবে যা কিছু শিখেছি বাবার কাছ থেকে। ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছি বটে। অথচ শৈশবেই বাবার কাছ থেকে শেক্সপিয়র শিখে ফেলেছি মুখে মুখে। আমার বাবা অসম্ভব শিক্ষিত ছিলেন। চিকিৎসক ছিলেন রেলওয়ে হাসপাতালে। বদরপুরে পোস্টিং ছিল। ওখানেই আমার জন্ম। যদিও স্বাধীনতার পর আমাদের গ্রাম কুমিল্লায় ফিরে আসি। হাফ নোয়াখালীও বলতে পারেন। আমার নানার বাড়ি ফেনী। পড়াশোনা করেছি ফেনী সরকারি কলেজে।
ফিরে তাকালে
আমার প্রতিভা ও লেখাপড়া পরিপূর্ণ প্রয়োগ করতে পারিনি বলেই মনে হয়। কারণ, পারিবারিক দায়িত্ব। বাবা ১৯৭৬ সালে মারা যান। বড় ছেলে হিসেবে ছয় ভাইবোনের দায়িত্ব নিতে হয় আমাকে। তবে এজন্য আমার আক্ষেপ নেই। এটাও তো আমার একটা কাজ।
রাজনীতির মাঠে
ফেনী কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম। ১৯৬৮-৬৯ সালের কথা। আমার বন্ধু ছিলেন জয়নাল হাজারী, আকরামুজ্জামানরা। তারা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। পরে অবশ্য ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়াই। সমাজতন্ত্রের ভালোবাসার দিকটা চমৎকার, কিন্তু প্রয়োগের দিকটা বিপরীত। যেমন মার্কসবাদ বলছে, শ্রেণিহীন সমাজ চাই। অথচ সেটা কায়েম করতে চাইছে একটা শ্রেণিকে দিয়ে, যারা সর্বহারা। সে তো একটা শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করে। সে কেমন করে শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার বিপ্লব করবে? তবে মার্কসবাদের যে স্বপ্নের জায়গা, শ্রেণিহীন সমাজে সবাই সমান। এই স্বপ্নটা আমার কাছে এখনও দারুণ লাগে। এসব ভেবেই মূলত রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলি।
সংসার জীবন
আমি ঠিক সংসারী হয়ে উঠতে পারিনি। মানে স্ত্রী-সন্তান বিচারে। এমনিতে এখনও সংসারেই আছি ভাইবোনদের নিয়ে। ঢাকায় যে বাড়িটাতে থাকি সেটা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমি। এটাতে একটু একটু করে এখনও ইট-সিমেন্টের গাঁথুনি দিচ্ছি। আর ভাইবোনদের নিয়ে ভালোই আছি। পেনশন পাই বেতারের। এখনও কবিতা লিখি। বই প্রকাশ হয়। ভালোই আছি।
এরমধ্যে ২০১৭ সালে একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম। রেবেকা সুলতানা নাম। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণির তালিকাভুক্ত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ছিলেন। অসাধারণ গায়িকা ছিলেন। বিয়ের পর স্ট্রোক করেন। ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। চেষ্টা করেছি চিকিৎসা করে ফেরানোর। পারলাম না।
সময়ের গান
আমি যে গানগুলো লিখেছি, সেসবের একটা প্রভাব কিন্তু পড়েছে। এখন অনেক গান শুনি। যেগুলো শুনলে তৃপ্তি পাই। মনে হয়, গানটাকে যে কবিতার কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করেছি, সেটা একেবারে বিফলে যায়নি। এটাই আসলে আমার প্রাপ্তি। এই প্রজন্মের কবি ও গীতিকবিদের প্রতি অনুরোধ– গানের কবিতাকে, কবিতার মতো করে রাখার চেষ্টা করো।
|
স্বস্তির স্বীকৃতি
দুটো বাকি। একুশে আর স্বাধীনতা পদক। এগুলো আমি পাবো বিশ্বাস আছে। সমস্যা হচ্ছে আমি তো এগুলো পেতে যা যা করা লাগে কিংবা মানুষ করে, সেসব করতে পারি না। মজার ঘটনা বলি, আমি যেবার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাই, সেদিন মেলার শেষ দিন। রাত ৮টা বাজে। বেরিয়ে যাচ্ছি মেলা থেকে। একজন এসে বললেন, ‘আরে জাহিদ। তুমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাচ্ছো। তোমাকে সবাই খুঁজছে। তুমি কই যাচ্ছো?’
তখন মোবাইল ফোন ছিল না। ২০০২ সালের কথা। আমি তখনও বিশ্বাস করিনি। লোকটাকে বললাম, ‘পাই না পাই না বলে তোমরা এখন মশকরা করছো আমার সঙ্গে। এগুলো আমি বুঝি।’ তখন তিনি বললেন, ‘খোদার কসম তুমি পুরস্কার পাচ্ছো। তুমি ওদিকে যাও। সবাই খুঁজছে।’ এরপর আমি একাডেমির দিকে গেলাম। গেটে হুদাকে (কবি মোহাম্মদ নুরুল হুদা) পেলাম। হুদা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘জাহিদ তুমিই কি প্রমাণ না, তদবির ছাড়াও যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া যায়?’
সেজন্যই বলছি, একুশে ও স্বাধীনতা পদক হয়তো পাবো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে– এরমধ্যে যারা পেয়েছে তাদের অনেকেই এত নিম্নমানের লোকজন, যাদের নাম উল্লেখ করতে লজ্জা হয় আমার।
ছবি: মামাগ্রাফি