X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০২২

একটা গান লেখার জন্য অনেক কষ্টে ঢাকায় এসেছিলাম: জীবন

কামরুল ইসলাম
০১ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:০৩আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ১৮:৪২

সময়টা ছিল ২০০৭ সাল। তখন দেশের অডিও বাজারে আসিফ আকবরের দাপট। দেশজুড়ে তারই গান বাজে, আনাচে-কানাচে। সেই আসিফের কণ্ঠেই দুটি গান দিয়ে গীতিকার হিসেবে রবিউল ইসলাম জীবনের আত্মপ্রকাশ। ‘ভাড়াটিয়া চাই’ ও ‘ভালোবাসি বলে’ শিরোনামের গান দুটি তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছিল। এরপরের গল্পটা জীবন যেন নিজের মতো করেই সাজিয়েছেন। অসংখ্য হিট ও প্রশংসিত গান, সঙ্গে নানাবিধ পুরস্কার। গীতিকার হিসেবে প্রায় সব অর্জনই নিজের করে নিয়েছেন তিনি। এবার তার ঝুলিতে যুক্ত হলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০২২ সালের ‘পরাণ’ সিনেমায় ব্যবহৃত ‘ধীরে ধীরে’ গানটির জন্য পুরস্কারটি তার হাতে উঠছে। সর্বোচ্চ প্রাপ্তির অনুভূতি আর গানটির পেছনের গল্প বাংলা ট্রিবিউনকে শুনিয়েছেন জীবন।

বাংলা ট্রিবিউন: একটু ভিন্নভাবে শুরুটা করি। ক্রিকেট পাগল মানুষ আপনি। যে সন্ধ্যায় বাংলাদেশ দল পাকিস্তানের সঙ্গে হেরে যাচ্ছিল, সেই সন্ধ্যায় নিজের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির খবর পেলেন। অনুভূতিটা কেমন আসলে? 

রবিউল ইসলাম জীবন: সত্যি বলতে আমি তখন (৩১ অক্টোবর) খেলা দেখতে দেখতে ভাত খাচ্ছিলাম। ভীষণ মন খারাপ। কারণ বাংলাদেশের খুবই বাজে অবস্থা। যদিও পুরো টুর্নামেন্টেই খারাপ খেলেছে। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচে আমাদের মধ্যে একটা অন্যরকম চেতনা কাজ করে। প্রত্যাশা ছিল অন্তত এই ম্যাচটা জিতবে। কিন্তু দলের এমন করুণ অবস্থা দেখে খুব মন খারাপ হয়েছিল। ইনফ্যাক্ট এ কারণে খাবারও খাচ্ছিলাম অনেক দেরিতে। ঠিক ওই সময়, একজন আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে প্রজ্ঞাপনটা পাঠায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজের নামটা খুঁজতে শুরু করি। যেন দেখেও দেখিনি, এমন মনে হচ্ছিল! বারবার দেখলাম। নিশ্চিত হওয়ার পর মনে হলো, এটা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। বাংলাদেশ দলের বাজে অবস্থা দেখে মনে যে অন্ধকার ছিল, সেটার মধ্যে এই পুরস্কারের খবর একটা আলো হয়ে এলো। তবে দুটো অবশ্যই দুই দিক। খেলার জন্য আবেগ-অনুভূতি অন্য রকম। বাংলাদেশ জিতলে আনন্দটা দ্বিগুণ হতো।

রবিউল ইসলাম জীবন বাংলা ট্রিবিউন: খবরটা পাওয়ার পর নিজ থেকে প্রথমে কাকে জানিয়েছেন? 

রবিউল ইসলাম জীবন: সবার আগে মা, বাবা, পরিবারের কথাই মনে এসেছে। আর স্ত্রী-কন্যা তো আমার সঙ্গেই আছে। তো ফোন করে মাকে পাইনি, তাই ছোট ভাইকে জানিয়েছি। সে মাকে জানিয়েছে। বাবা তো বেঁচে নেই।

বাংলা ট্রিবিউন: ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। ফলে আপনার বেড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা মায়ের। ছেলের এমন অর্জনের কথা শুনে তিনি কী বলেছেন? 

রবিউল ইসলাম জীবন: আমার এই অর্জনের পেছনে পুরো কৃতিত্বই আমার মায়ের। অনেক সংগ্রাম, কষ্ট করে তিনি আমাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন। খবরটা শুনে মা শুকরিয়া প্রকাশ করেছেন। আসলে মা এটুকু বুঝেছেন, আমি একটা বড় পুরস্কার পাচ্ছি। কিন্তু এটা আসলে কী, কত বড় বা এর মর্যাদা কেমন, এত সব কিছু তো তিনি বোঝেন না। তবে যতটুকুই বুঝুক, পুরোটা জুড়েই তো ছেলের জন্য ভালোবাসা। সবচেয়ে ভালো লাগার ব্যাপার হলো, মা বেঁচে থাকতেই এমন একটি পুরস্কার পেলাম। মায়ের চোখের সামনে সন্তানের একটা বড় অর্জন হলো। 

মায়ের সঙ্গে রবিউল ইসলাম জীবন বাংলা ট্রিবিউন: এবার একটু গানে আসি। ‘ধীরে ধীরে’ গানটি আসলে কবে, কোন প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন? এর পেছনের গল্পটা কেমন ছিল?

রবিউল ইসলাম জীবন: এটা ২০১৭ সালে লিখেছিলাম। তখন রায়হান রাফী ‘দহন’ ছবির কাজ করছিলেন। তিনিই আমার সঙ্গে গানের জন্য যোগাযোগ করেন। এই গানের সুর আগে তৈরি করে রেখেছিলেন ইমন চৌধুরী। ফলে সেই সুরের ওপরই লিখতে হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। তবু চেষ্টা করেছি সুন্দর একটা গল্প-কথা ফুটিয়ে তুলতে। যারা গান লেখেন, তারা জানেন সুরের ওপর একটা ভালো লিরিক লেখা কতটা কঠিন। তো গানের প্রাথমিক রেকর্ডিংয়ের জন্য আমিই লুইপার নাম সাজেস্ট করি। সেটা শুনে সংশ্লিষ্টদের পছন্দ হয়। কিন্তু রাফী ভাই বললেন, তার পরবর্তী ছবি ‘পরাণ’র জন্য এই গানটি বেশি মানানসই হবে। সে জন্য এটি রেখে দেওয়া হয়। আসলে গানটার কাজ যখন আমরা করি, তখনই ইমনের সঙ্গে আলোচনা হতো যে এটা ভালো কিছু হতে পারে, পুরস্কারের তালিকায় থাকতে পারে। কিন্তু গানটা তৈরি হয়েও যখন পড়ে ছিল, তখন আসলে খারাপ লাগছিল এই ভেবে যে এত কষ্ট করে কাজটা করলাম, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। রাফী ভাইও অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে যান। একপর্যায়ে ইমন তার ইউটিউব চ্যানেলে গানটি প্রকাশের কথাও ভাবে। কিন্তু এর মধ্যেই ফের রাফী ভাই আবার গানের জন্য যোগাযোগ করেন। অবশেষে ২০২২ সালে গানটি প্রকাশ হয়। সুর, মিউজিক, গায়কী মিলে আমার মনেও প্রত্যাশা তৈরি হয় গানটি নিয়ে। প্রকাশের পর অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি এবং সবশেষে এই পুরস্কার।

ইমন চৌধুরীর সঙ্গে রবিউল ইসলাম জীবন বাংলা ট্রিবিউন: এই আসরে আপনার যারা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, তাদের গানগুলো নিয়ে আপনার মন্তব্য শুনতে চাই...

রবিউল ইসলাম জীবন: প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে চাই না, তারা আমারই ভাই, সহকর্মী। আমরা একই ইন্ডাস্ট্রির মানুষ। আমার মতে, যারা প্রাথমিক তালিকায় ছিলেন, প্রত্যেকেই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। তাদের সবাইকে আমার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই। আমি হয়তো একটু ভাগ্যবান, তাই এগিয়ে ছিলাম। সবাই একসঙ্গে পেলে আরও বেশি ভালো লাগতো, কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। আমি মনে করি, তাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি পেয়েছি, এই পুরস্কার আমার একার না, তাদের সবার। 

লুইপার সঙ্গে রবিউল ইসলাম জীবন বাংলা ট্রিবিউন: সিনেমায় আপনার লেখা সব গানই শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। এরপরও রুপালি পর্দায় আপনার গানের সংখ্যা তুলনামূলক কম। কারণ কী? 

রবিউল ইসলাম জীবন: সিনেমায় আমার সব মিলিয়ে ত্রিশটার মতো গান হবে হয়তো। অধিকাংশই শ্রোতারা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সত্যি বলতে ক্যারিয়ারের শুরু থেকে সিনেমায় গান লেখার প্রতি আমার জোরালো আগ্রহটা ছিল না। ২০১০ সালে প্রথম সিনেমায় গান লিখেছিলাম। বরাবরই চেয়েছি ভালো সিনেমায়, ভালো গান লিখতে। হিট হওয়ার চেয়েও আমার চাওয়া ছিল গানটা যাতে ভালো হয়। তো সেই চাওয়া-সুযোগ মিলিয়েই আসলে গানের সংখ্যা কম। তবে এই কম নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। 

রায়হান রাফীর সঙ্গে রবিউল ইসলাম জীবন বাংলা ট্রিবিউন: শ্রোতাপ্রিয়তা, পুরস্কার সবই অর্জন করলেন। এই পর্যায়ে লেখার ক্ষেত্রে আসলে কোন বিষয়ে নজর দিতে চান?

রবিউল ইসলাম জীবন: মাত্র একটা গান লেখার জন্য আমি অনেক কষ্টে ঢাকায় এসেছিলাম। তখন বারবার মনে হচ্ছিল, জীবনে কেউ আমার লেখা একটা গান গাইলেই ধন্য হবো। সেই থেকে এত গান, এত অর্জন, ভালোবাসা, পুরস্কার, সৃষ্টিকর্তা অনেক কিছুই দিয়েছেন। এই পর্যায়ে আমার একটাই লক্ষ্য, আগের চেয়েও আরও সুন্দর কথার গান লিখতে চাই। মানুষের ভাবনার জগৎ নাড়িয়ে দেওয়ার মতো, ইতিবাচক দিকে প্রভাবিত করার মতো কিছু গান লিখতে চাই।

চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস নিচ্ছেন রবিউল ইসলাম জীবন

বাংলা ট্রিবিউন: ঢাকায় আসার প্রসঙ্গ টানলেন। ওই গল্পটা একটু শুনতে চাই। গান লেখা শুরু, এরপর সেটাকে সম্বল করে ঢাকায় আসা…

রবিউল ইসলাম জীবন: আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা নোয়াখালীতে। তবে গান লেখার শুরু চট্টগ্রামে। আমি তখন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে পড়ি। আর টিউশনি করিয়ে, কোচিংয়ে পড়িয়ে নিজের পড়াশোনা ও যাবতীয় খরচ মেটাই। ওই সময়ে প্রচুর গান শুনতাম। তবে আমি গান শোনার পাশাপাশি ক্যাসেটের প্রচ্ছদে থাকা লিরিকগুলো পড়তাম মন দিয়ে। কীভাবে লিখেছে, বোঝার চেষ্টা করতাম। দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে, ২০০২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর; কলেজ থেকে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ মাথায় কিছু লাইন আসে। বাসায় গিয়েই সেটা লিখে ফেলি। আর মনে হলো, আমি তো গান লিখে ফেলেছি! নিজের মধ্যে তুমুল আবেগ, উন্মাদনা চলে এলো। কীভাবে এই গান প্রকাশ করা যায়, ভাবতে থাকলাম। চট্টগ্রাম থেকেই ঢাকার বিভিন্ন সুরকারের কাছে ফোন করতাম। অনুরোধ করতাম। কিন্তু এভাবে তো আসলে হয় না। আর তখনকার লেখাও ছিল কাঁচা। লিখতে থাকলাম। একসময় গানের খাতায় প্রায় পঞ্চাশটি গান হয়ে গেলো। সেটা সম্বল করেই ২০০৪ সালে ঢাকায় চলে আসি। কিন্তু এই শহরে আমার কোনও আত্মীয়-স্বজন ছিল না। এক বন্ধুর সহযোগিতায় ঢাকায় আমার আশ্রয় হলো। এরপর টানা তিন বছর অবর্ণনীয় সংগ্রাম আর চেষ্টার পর কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নটা পূরণ হয় ২০০৭ সালে; আসিফের ‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ’ অ্যালবামে আমার দুটি গান স্থান পায়। সেই শুরু।

বাংলা ট্রিবিউন: মানুষের না, নিজের কাছে আপনার লেখা সবচেয়ে পছন্দের গান কোনগুলো? 

রবিউল ইসলাম জীবন: নিজের লেখা গান থেকে প্রিয় বাছাই করা খুব কঠিন। এই মুহূর্তে ‘জ্বলে ওঠো বাংলাদেশ’, ‘দেয়ালে দেয়ালে’, ‘রাতভর’, ‘ধীরে ধীরে’, ‘কেউ না জানুক’, ‘মন কারিগর’, ‘নদীপথ’, ‘আজ বৃষ্টির দিন’ গানগুলোর কথা মনে পড়ছে। রবিউল ইসলাম জীবন

/এমএম/এমওএফ/
টাইমলাইন: গীতিকবির গল্প
০১ নভেম্বর ২০২৩, ১৫:০৩
একটা গান লেখার জন্য অনেক কষ্টে ঢাকায় এসেছিলাম: জীবন
সম্পর্কিত
অনেক কিছুই ইচ্ছে করে, কিন্তু করা যায় না: মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
গীতিকবির গল্পঅনেক কিছুই ইচ্ছে করে, কিন্তু করা যায় না: মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
মনিরুজ্জামান মনির: জন্মদিনে জানালেন বই প্রকাশের খবর
মনিরুজ্জামান মনির: জন্মদিনে জানালেন বই প্রকাশের খবর
গানের জন্য একমাত্র পুত্রকে হারানো এবং...
গীতিকবির গল্পগানের জন্য একমাত্র পুত্রকে হারানো এবং...
যে দেশে বৃক্ষ নাই, সেখানে ভেরেণ্ডা গাছই বটবৃক্ষ: নাসির আহমেদ
গীতিকবির গল্পএখন হরিদাস পালই হয়ে গেছে শামসুর রাহমান: নাসির আহমেদ
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!