X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১
গীতিকবির গল্প

যে দেশে বৃক্ষ নাই, সেখানে ভেরেণ্ডা গাছই বটবৃক্ষ: নাসির আহমেদ

মাহমুদ মানজুর
মাহমুদ মানজুর
২৪ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৪৭আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০৩

নাসির আহমেদ। মূলত কবি ও সাংবাদিক। ২০১০ সালে কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। জীবনের প্রায় সিংহভাগ সময় সাংবাদিকতা করেছেন দৈনিক বাংলা, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক সমকাল ও দৈনিক বর্তমান-এ। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বার্তা পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়ে অবসরে গেছেন ২০১৮ সালে। তবে কবিতা ও সাংবাদিকতার বিস্তর পথে অনেকটা চাপা পড়ে আছে তার আরেকটি বড় অধ্যায়। সেটি হলো গীতিকবিতা। অথচ এই গান দিয়েই যার লেখালেখি শুরু এবং শেষ পর্যন্ত গানটাই এখনও সমানতালে লিখে চলেছেন। প্রায় পাঁচ দশকের গানের খাতায় নাসির আহমেদ লিখেছেন অন্তত ১২শ’ গান। যার মধ্যে অন্তত চাড়ে চারশ’ গানই দেশাত্মবোধক। তারচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য, তিনিই সম্ভবত একমাত্র কবি, যিনি সমৃদ্ধ ও দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সিনেমার জন্য মাত্র একটি গান লিখেছিলেন! এর পেছনেও রয়েছে তীক্ষ্ণ একটি আত্মসম্মানবোধের গল্প। এমন আরও কিছু গানের গল্পের খোঁজে সাম্প্রতিক এক বিকালে কবির মুখোমুখি বসা—

জীবনের দীর্ঘ সময় সাংবাদিকতায় কাটিয়েছেন বলেই হয়তো প্রচারবিমুখ নাসির আহমেদ কালক্ষেপণ না করে সময় দিলেন। ফোন করে পরিচয় দিতেই বললেন, ‘কাল বিকালেই বাসায় চলে আসুন। গান নিয়ে তো জীবদ্দশায় কখনও বেশি কিছু বলিনি। বলতেও চাইনি। এখন দেখি স্মৃতি হাতড়ে কতোটা বলতে পারি।’

রাজধানীর হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের উল্টোপাশেই কবির ছিমছাম বাসা। বসার ঘরের চারপাশে হরেক রকমের বই, হারমোনিয়াম, ক্রেস্ট। সোফায় বসতেই সামনে চলে এলো কমলা আর পেয়ারা, সঙ্গে রঙ চা। কবি তড়িঘড়ি করে চায়ের কাপ পিরিচে ঢেকে বললেন, ‘দুপুরের খাবারের পর ফল খাওয়া খুব ভালো। খেয়ে নিন। চা পরে খাবেন।’

এরপর ফল খেতে খেতে কবি যেন কী ভেবে বলতে শুরু করলেন— 

‘গীতিকার শব্দটা আমার পছন্দ নয়। আমি মনে করি যারা ছন্দ জানে না, কাব্যজ্ঞান নাই; এমন লোকদেরই গীতিকার বোঝায়! এটাকে বলা উচিত গীতিকবি। যে গানটা আমরা লিখি সেটা হলো গানের কবিতা। কারণ, ৬০-এর দশকে দেশের প্রধান কবিদের প্রায় সকলেই গান লিখেছেন। ফররুখ আহমেদ, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান...।’ 

সৈয়দ শামসুল হক। এই নামটি সম্ভবত মিস করছিলেন কবি। তাই মনে করিয়ে দেওয়া...।

‘উনি তো আরও বেশি লিখেছেন। অনেক বড় গীতিকবি তিনি। ওপার বাংলাতেও দেখেন, বড় বড় কবিরা গান লিখেছেন। স্বাধীনতার পরে দেখেন, ফসলের সঙ্গে আগাছা তো হয়। সেটা এত বেশি হয়েছে, ফসলটাকে মেরে ফেলেছে। তাই গীতিকবিতা থেকে কবিরা নাই হয়ে গেলেন। বসে পড়লো গীতিকার শব্দটি।’

নাসির আহমেদ কবির এমন আক্ষেপের বিপরীতে প্রশ্ন আসতে পারে, কবিরা গান থেকে ক্রমশ সরে দাঁড়ানোর কারণ কী? 

‘‘মূল কারণ, কবিরা যে গান লিখবেন সেই সম্মানটা তো থাকতে হবে। তাদের যে সম্মান দেওয়া হতো পাকিস্তান আমলে; যেমন আব্দুল আহাদের মতো লোক আমার কাছে গান চাইতেন। বলতেন, ‘নাসির একটা গান দিও’। খন্দকার ভাই ফোন করে বলতেন, ‘নাসির একটা গান দিসতো ভাই...। তাদের এই বলার ভেতরে কবি ও কবিতার প্রতি টান ও সম্মান ছিল।’’

খন্দকার নুরুল আলম...?

‘‘হুম। খন্দকার ভাই বলতেন, ‘নাসির, সাবিনা ইয়াসমিন গাইবে। আগামী ১৭ তারিখ রেকর্ডিং।’ ২ তারিখে এটা বললেন। মানে ১৫ দিন আগে। বলতেন, ‘তুই বাসায় আসিস, গান নিয়ে কিন্তু বসতে হবে।’ যাওয়ার পর গান দিতাম সামনে। মন দিয়ে পড়তেন। হয়তো বলতেন, ‘তৃতীয় অন্তরাটা পছন্দ হয় নাই। আরও কাব্যিক কর। তুই তো কবি।’ তো আমি লিখলাম, ‘রাতের আকাশে এই হৃদয়ে আমার/ জোছনায় শুনি সূর্যের হাহাকার...।’ ৮০ সালে রেকর্ড হয়েছে এই গান। বাংলাদেশ বেতারের জন্য। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল গানটি। এরপর আব্দুল জব্বারের জন্য লিখলাম, ‘ফুলের আড়ালে ছিল বিষকাঁটা/ আগে কেন তা দেখোনি/ হৃদয়ের ফুল কী করে কুড়োতে হয়/ ভালোবাসার আগে শেখোনি’। ৪৩ বছর আগে রেকর্ড করা এসব গান। তো আমরা এমন সম্মান পেয়ে গানগুলো লিখেছি। সেই মর্যাদা পেয়েছি। সেটি তো ক্রমশ হারিয়ে গেছে। কবিরা তো সাধারণত আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ হয়। সে জন্যই আস্তে আস্তে কবিশূন্য হয়ে পড়েছে সর্বত্র।’’  

প্রসঙ্গটি এখানেই শেষ হতে পারতো। তবে কবি আরেকটু যোগ করলেন—

‘সব মিলিয়ে বাংলাদেশের গানের ক্ষেত্রে সেই সুরকারও এখন নেই। পরে সুরকার এসেছে কিছু, কিন্তু তারা প্রতিভাবান গীতিকবি খুঁজে বের করেননি। যে দেশে বৃক্ষ নাই, সেখানে ভেরেণ্ডা গাছই বটবৃক্ষ! এখন তো শামসুর রাহমান নাই। হরিদাস পালই হয়ে গেছে শামসুর রাহমান। হরিদাস একটা প্রতীকী নাম দিলাম আরকি। সেই হরিদাসই এখন শামসুর রাহমানের চেয়ারে বসে। গান লেখে। পুরস্কারও পায়। এভাবেই চলছে। আগের বিষয়টা ছিল কবিরাই টিভি-রেডিওতে ছিলেন, তারাই গান লিখতেন, বাছাই করতেন, গাওয়াতেন। এখন কবিরা কোথাও টিকে নেই। চারদিকে হরিদাস পাল।’

কবিকে মনে করিয়ে দেওয়া, পত্রিকাটাও কিন্তু কবিদের হাতেই ছিল। আপনি নিজেও সেটার বড় প্রমাণ—

‘‘তাই তো। আমাদের হাত ধরে বহু তরুণ সাংবাদিক-গীতিকবি-সাহিত্যিক বের হয়েছে। ঐ প্র্যাকটিসটাই তো নাই এখন। অথচ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা আহসান হাবীব কাটছাঁট করে ছাপাতেন আমার সামনে। আবু হেনা মোস্তফা কামাল, হুমায়ূন আজাদ, আব্দুল মান্নান সৈয়দদের সঙ্গে তো আহসান হাবীবের সম্পর্কই নষ্ট হতো লেখা সম্পাদনার কারণে। আমার সামনে দেখা এসব। আর এখন অহরহ মানহীন লেখা ও গান প্রকাশ হচ্ছে, কেউ দেখছে না। আহসান হাবীব আমাকে বলতেন, ‘আল্লাহ যদি লেখক হন, আর তুমি যদি সম্পাদক হও, তাকেও এডিট করা যায়।’ কারণ, যিনি লেখক তিনি তার ত্রুটি সহজে খুঁজে পাবেন না। এ জন্য প্রয়োজন সম্পাদনার তৃতীয় নয়ন। বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দের চেয়ে বড় নন। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতা সম্পাদনা করে ছাপতেন বুদ্ধদেব। এটাই হলো আসল প্রক্রিয়া। আমরা সেই প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছি বলেই আজ কবিশূন্যতা।’’   

কবি নজির টানলেন এই প্রজন্মেরও। বলতে চাইলেন, অনেক হরিদাস পালের মধ্যেও কিছু গীতিকবি এখনও চেষ্টা করে চলেছেন অবিরত—

‘এগুলো বলার কারণ, এসব চর্চা বা সম্পাদনা বা গুরু তো আর নেই। নতুনরা শিখবে কেমন করে। যেমন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান আমাদের দেশের অসম্ভব শক্তিমান গীতিকবি। তিনিও কিন্তু মূলত কবি। ৬০-এর দশকে তার কবিতার বই বেরিয়েছে। অনেক পরে আমাদের জুলফিকার রাসেলও গানের মধ্যে কাব্য নিয়ে খেলার চেষ্টা করছে। যদিও একই সময়ে অনেকে অন্যের কবিতার লাইন চুরি করেও প্রশংসিত হচ্ছে।’

নাসির আহমেদ এসব বিষয়ে আরও জানবো। তবে তার আগে ছোট ছোট বিষয়গুলো একটু জানা জরুরি। বিশেষ করে কবি নাসির আহমেদের গীতিকবিতার জীবন অন্তর্জাল তথ্যভাণ্ডারে নেই বললেই চলে। তাই শুরু থেকেই পড়া যাক কবিকে— 

নাসির আহমেদের জন্ম ভোলা জেলার আলীনগর গ্রামে। জন্ম ১৯৫২ সালের ৫ ডিসেম্বর। এটা অবশ্য সার্টিফিকেট অনুসারে। আসলটি বলার আর অবকাশ নেই বলেই মনে করেন কবি। বাল্যশিক্ষা থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত কবির পড়াশোনা ভোলাতেই। সে হিসেবে ১৮ বছর পর্যন্ত তার বেড়ে ওঠা ভোলার এক অজপাড়াগাঁয়ে। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে নাসির আহমেদ চতুর্থ।

তিনি দুই মেয়ে ও এক ছেলের গর্বিত পিতা। বড় দুজন প্রতিষ্ঠিত, একজন এখনও বেশ ছোট। নাম যথাক্রমে প্রতীক আহমেদ, তাসনিয়া আহমেদ ও নাওসাবা আহমেদ।

ভোলায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা। যে সময়টার ভেতরে একজন মানুষ আসলে জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে ফেলেন। বিস্ময়, নদীগর্ভে ভোলার আলীনগর গ্রামে বসে ৬০ দশকের একজন তরুণ কেমন করে ঢুকে পড়লেন সাহিত্য আর গানে। ধর্মীয় অনুশাসনেও যেটি বিস্ময়কর বটে। জবাবে কবি বললেন বিস্তারিত। ফিরে গেলেন আলীনগরে—

‘১৯৫৮ সালে স্কুলে ভর্তি হই। ক্লাস থ্রি বা ফোর থেকেই যাত্রা, পালা গান, জারি সারির আসরে চলে যেতাম। টিভির তো প্রশ্নই আসে না। যারা সচ্ছল তেমন দুই একটি ঘরে রেডিও থাকতো। তো আমাদের ঘরে তখন একটা এনএসি রেডিও ছিল।’ 

এনএসি রেডিও কেমন ছিল...

‘‘এটা ছিল টিভির মতো বড় সাইজের। গোল। এন্টেনা লাগালে বিবিসি শোনা যেতো। বেশ পাওয়ারফুল। আর কলকাতার বেতার তো এমনিতেই শোনা যেতো। প্রতি রবিবার অনুরোধের আসর শুনতাম। দুপুর আড়াইটায় প্রচার হতো। সিনেমা হল ছিল ভোলায়। খালাদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেতাম। ওরা নিয়ে আমাদের বসিয়ে রাখতো পাশে। হা করে বসে থাকতাম। গল্প বুঝতাম না, তবে গানটা কানে লেগে থাকতো তখনই। ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ, ডিম নেই নাম তার তবু অশ্বডিম্ব’- এগুলা গান এখনও আমার মুখস্থ। সিনেমা হল থেকে বের হয়ে আমি এই গানগুলো গুন গুন করতাম। এটা ৬০-৬২ সালের কথা বলছি। আকাশবাণী শুনতাম নিয়মিত। ৬৯ সালে রেডিওতে শিপ্রা বসুর একটা গান শুনেছিলাম। সেটি এখনও সুরসহ গাইতে পারি।’’

কোন গানটা...

‘ভালোবেসে ব্যথা সহিব কেমনে...।’

খানিকটা গেয়েও শোনালেন সুরে। তাই জিজ্ঞাসা ছিল কবির দরবারে, ছোটবেলা থেকেই গান আপনার অন্তরে ও মুখে ছিল। না গেয়ে, মানে কণ্ঠশিল্পী না হয়ে গীতিকবি হলেন কেমন করে...

‘আমি কিন্তু গান গাইতে পারি। গানের গলা খুব ভালো ছিল। স্কুলে না শিখেও গেয়ে পুরস্কার পেয়েছি অনেক। ঢাকায় আসার পর শিল্পী বশির আহমেদের কাছে বছর দেড়েক গান শিখেছি। ফলে গাইবার যোগ্যতা আমার খুব একটা খারাপ ছিল না।’

তাহলে কেন গাইলেন না...

‘আমার বাবা ছিলেন ধার্মিক মানুষ। তবে কট্টর না, প্রগতিশীল ছিলেন। কিন্তু মুসলমানের ছেলে গান গাইবে—এই ভ্যালুজের সঙ্গে আপস করতে পারলেন না। ফলে চুরি করে বিভিন্ন সংগীত সংগঠন বা স্কুলের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে গান শুনতাম বা গুন গুন করতাম। রেডিও শুনতাম। যাত্রাপালায় চলে যেতাম। কিন্তু গাইবার অনুমতি ছিল না। মূলত এই অভাব থেকে আমার মাথায় এলো, গান শিখতে বা গাইতে যেহেতু পারবো না, সেটা লিখে দেখি না পারি কিনা। আমার মা আবার দারুণ পুঁথি পড়তেন সুর দিয়ে। সেই সুরটা আমার কানে খুব লাগতো। আমি মায়ের সুরে ভেসে যেতাম শিশুকালে। এখনও সেই সুর আমার মনে বাজে। তো এরপর নিজেই চেষ্টা করতাম গানের মতো কিছু লেখার। তখন তো গানটাই বুঝতাম, কবিতা কি বিষয় জানতামই না।’

নাসির আহমেদ তার মানে গান লেখা শুরু আপনার ভোলা থেকেই!

‘অবশ্যই। আমার প্রথম গানের পাণ্ডুলিপি পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্রে পাঠিয়েছি ১৯৬৯ সালে। সে হিসেবে বলতেই পারেন আমি গান লিখছি ৬০ দশক থেকে।’

সেই পাঠানোর অভিজ্ঞতাটুকু বলবেন...

‘২৫টা গান পাঠিয়েছিলাম। এনলিস্টেড হতে হলে এটাই ছিল নিয়ম। প্রথম যাত্রায় লাভ হলো না। এনলিস্টেড হতে পারিনি। ৭০ সালের অক্টোবরে একটা চিঠি পেলাম বেতার থেকে। যেখানে ইংরেজিতে লেখা ছিল- আপনার মধ্যে সম্ভাবনা আছে। আরও পূর্ণতা দরকার আপনার গানে। তাই এখনই আপনাকে অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। আমরা আপনাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অপেক্ষায় রইলাম। এসব। সাত আট লাইনের আন্তরিক একটা চিঠি।’

তখন আপনি কীসে পড়ছিলেন...

‘গানগুলো লিখছিলাম ৬৫/৬৬ সাল থেকে, ক্লাস এইটে থাকতে। আর ৭০-এ আমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছিলাম।’

এরপর...

‘এরপর তো মুক্তিযুদ্ধ। অস্থিরতা পেরিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। ৭২ সালের দিকে অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকায় এলাম। এসেই ক্লাসমেট কবি মোহাম্মদ সাদিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হলো। দেখলাম কবিতা নিয়ে ও ডুবে আছে। আমিও ওর সঙ্গে থেকে ডুবে গেলাম কবিতায়। তুমুল গতিতে কবিতা আর ছড়া লেখা শুরু করলাম। লাইব্রেরিতে গিয়ে বিশ্বসাহিত্যের নানা বই পড়া শুরু করলাম। গানের আশপাশেও তখন আমি নেই। ভুলেই গিয়েছিলাম, গান যে আমার প্রাণের একটা অংশ ছিল।’

কিন্তু ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছিলেন কোথায়...

‘যেহেতু ইন্টারমিডিয়েট কমার্স করে এসেছি, তাই ম্যানেজমেন্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কিন্তু ক্লাসে ঢুকে দেখলাম স্ট্যাটিসটিক মাথাতেই ঢুকে না। ওটা ছেড়ে পরে আমি জগন্নাথে বাংলায় ভর্তি হয়ে যাই। পরে অবশ্য মাস্টার্স করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখানেই সাদিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। ৭০ দশকের কবি হলেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ৮০ দশকে। তো ব্যাপক ছড়া কবিতা ছাপা হতে লাগলো দুজনেরই। কবিতার প্রতি একরকম এডিকশন চলে এলো।’

পরে গানে ফিরলেন কবে ও কীভাবে...

‘‘এর মধ্যে একদিন দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব ভাই তার দুটো গানের খোঁজ নিতে বললেন আমায়। এটা ৭৯/৮০ সালের কথা। বললেন, ‘আমি তো একটা সময় গান লিখতাম। দেখো তো রেডিওতে এই দুটি গানের খোঁজ পাওয়া যায় কিনা।’ পরে আমি গান খুঁজতে রেডিওতে যাই। এবং সেখানে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে আমার সেই চিঠিটার কথা। যেটা রেডিও থেকে পাঠিয়েছিল ভোলার ঠিকানায়। যে চিঠিতে লেখা ছিল, ‘আমরা তোমাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অপেক্ষায় রইলাম’। চিঠিটার কথা মনে পড়ায় অনেকটা আবেগতাড়িত হলাম। বলতে পারেন সেদিন থেকেই আমি গান লেখা আবার শুরু করি। ৬৯ সালে ভোলা থেকে এনলিস্টেড হওয়ার জন্য বেতারে গান পাঠিয়েছিলাম। ঠিক দশ বছর পর ৭৯ সালে আবার শুরু করলাম লেখা। মাঝের ১০ বছর কবিতা আর ছড়ার সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিলাম। ৮০ সালে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলাম রেডিও আর বেতারে। এবং খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সব সুরকারের দৃষ্টিতে পড়ে গেলাম। তখন যারা গান করতেন রেডিও-টিভিতে।’’

আপনার প্রথম গান কোনটা, যেটা রেকর্ড হলো...

‘‘সেটা হলো বশির আহমেদের সুর ও কণ্ঠে ‘নাম হারা ফুল ছিলাম ঘাসের আড়ালে/ কে তুমি তাকে ভালোবেসে হাত বাড়ালে’। এটা রেডিওর জন্য আমার লেখা প্রথম গান। টেলিভিশনেও কাছাকাছি সময়ে, ৮০ সালে লিখেছি। মনে পড়ে, প্রতি সপ্তাহে রেডিও-টিভিতে আমার গানের রেকর্ডিং থাকতো। তখন সর্বাধিক গান রেকর্ড হতো নজরুল ইসলাম বাবু, মুনসী ওয়াদুদ, মাহফুজুর রহমান মাহফুজ আর নাসির আহমেদের। আমার পরে আবিদ আনোয়ার আসেন এই তালিকায়। যদিও তিনি খুব একটা লিখতেন না। আমিই ধরে ধরে ওনাকে সবার কাছে নিয়ে যেতাম।’’

নাসির আহমেদ

তখন গানের মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে কোন শিল্পী বা সুরকারের সঙ্গে...

‘‘বশির আহমেদ। তারপর খন্দকার নুরুল আলম। তবে ওই আমলে জুটি বলে কিছু ছিল না। সবাই সবার সঙ্গে কাজ করতাম। পুরোটাই ছিল একটা যৌথ পরিবারের মতো। রাজা হোসেন খান, ধীর আলী মিয়া আমার গান করেছেন। দেবু ভট্টাচার্যের সঙ্গে একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। ওনার জীবনের শেষের দিকে। শেষ দুই তিনটা বছর উনি আমার বাসায় আসতেন, আমিও যেতাম। আরেকজনের সঙ্গেও আমার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। কিন্তু উনি এতই চুজি ছিলেন যে একটা গান করতে দুই তিন বছর সময় নিয়ে নিতেন। তিনি অনুপ ভট্টাচার্য। দুটো গান উনি আমার করেছিলেন। একটা নার্গিস পারভীন, আরেকটা কাকে দিয়ে যেন করলেন। আরেকটা গান করতেই পারলেন না।’’

এই যে লিখতেন, এখন আমরা দেখি বা শুনি গীতিকবিরা টাকা পয়সার বিষয়ে চরম অবহেলিত... তখন কেমন ছিল পরিবেশটা...

‘চরম অবহেলা তখনও ছিল। সম্মানি শুনলে তো লজ্জা পাবেন। আট আনা, এক টাকা আর দুই টাকা ছিল। আমার ছিল এক টাকা। আক্ষেপ ছিল। কিন্তু সংঘবদ্ধ কোনও প্ল্যাটফর্ম ছিল না। এখন যেমন আছে গীতিকবি সংঘ। তখন তো এসব বলার মতো কিছু ছিল না। আরেকটা বিষয় ছিল, আমরা যারা লিখতাম তারা কিন্তু এটা দিয়ে ভাত খেতাম না। প্রফেশন হিসাবে নিইনি। যেমন আমার প্রফেশন ছিল সাংবাদিকতা। যা পেতাম ভালোই চলতো। গানটা ছিল শখের বিষয়। নেশাও বলতে পারেন। তখন দৈনিক বাংলায় চাকরি করেছি। সরকারি ট্রাস্টের কাগজ। বেতন ভাতা খারাপ ছিল না। ফলে গানের রয়্যালটি নিয়ে ভাবতাম না। হয়তো দুই বছর পর একদিন হঠাৎ তুললাম ৫৬ টাকা। সেটাই অনেক পাওয়া ছিল।’

রেডিও আর টিভিতে আপনার গানের সংখ্যা অসংখ্য। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হলো সিনেমায় আপনি প্রায় অনুপস্থিত...

‘‘মাত্র একটা গানই লিখেছি সিনেমার জন্য। তাও পুরোটা লিখতে পারিনি। মুখ আর একটা অন্তরা লিখেছি! সেটাই প্রথম, সেটাই শেষ। মোস্তফা মেহমুদ সাহেব ছিলেন ওই ছবির প্রযোজক-পরিচালক। ‘স্বামীর সোহাগ’ সিনেমা। রুনা লায়লা কণ্ঠ দিয়েছেন। কথাগুলো এমন, ‘মুখের হাসি সবাই দেখে বুকের ব্যথা বোঝে না/ আমারও যে অতীত আছে অতীতটা কেউ খোঁজে না’। ক্যাবারে একটা নাচের দৃশ্যে নর্তকীর ঠোঁটে গানটি শুট হয়েছিল। আইটেম গান বলে এখন এটাকে। সুরকার ছিলেন বশির আহমেদ।’’

শুরুতেই শেষ হলো কেন! তাছাড়া তখন তো সিনেমায় কবিদেরই রাজত্ব ছিল...

‘‘ঘটনাটা হলো গানটা লিখতে গিয়ে মেহমুদ সাহেব বারবার আটকাচ্ছিলেন। আরোপ করছিলেন এভাবে, ‘এটা এভাবে না ওভাবে লেখেন।’ আমি আর বশির আহমেদ বসা। প্রথম অন্তরা লেখার পরেই উনি বারবার বিরক্ত করছিলেন। বশির আহমেদও উনাকে থামাচ্ছিলেন এই বলে, ‘ভালো হচ্ছে। আপনি থামেন, ওকে লিখতে দিন। নাসিরকে আমি জানি। ও খুব ভালো লেখে।’ এটা ৮০ সালের কথা হবে। তো সেদিন ওখান থেকে লেখা শেষ না করেই চলে আসি। সিনেমায় ওটাই আমার শুরু ও শেষ। এরপর আর আগ্রহই জন্মায়নি সিনেমার প্রতি। তাছাড়া তখন আমি রেডিও, টিভি, সাংবাদিকতা আর কবিতা লেখায় এতটাই নিমগ্ন, সিনেমা নিয়ে আসলে তেমন আবেগও ছিল না। তার ওপর যদি এতটা খবরদারি চলে- সেটা তো সম্ভব না।’’

পরে কি সেই গানটা শেষ হয়েছিল বা সিনেমায় ব্যবহার হলো...

‘হয়েছে। দ্বিতীয় অন্তরা লিখিয়েছেন ফজলে খোদাকে দিয়ে। আমি তো রগচটা। অসম্মান নেওয়া যাবে না। তখন সিনেমায় অবশ্য সম্মানি বেশি ছিল। দুই বা আড়াইশ’ টাকা। অনেক টাকা তখন। কিন্তু আমি তো টাকার জন্য গানটা লিখতাম না। যেখানে আত্মসম্মান থাকবে না, সেখানে সাহিত্যচর্চার মানে হয় না।’

কবির গান-জীবনের বেশিরভাগ সময়জুড়ে বিস্তার করে আছেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী বশির আহমেদ। সম্ভবত তার সঙ্গেই সর্বোচ্চ সখ্য গড়ে উঠেছিল। এমনকি ৮০’র দশকে রেডিও আর টিভিতে জুটি হয়ে উঠেছিলেন দুজনে। এমন প্রসঙ্গ তুলতেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন নাসির আহমেদ—
  
‘‘বশির আহমেদের সঙ্গে একটা মজার ঘটনা বলি। ওনার সঙ্গে একদিন রেডিওর গেটে দেখা। উনি বেরুচ্ছেন, আমি ঢুকছি। আমাকে দেখে বললেন, ‘আজকে তো ডিজির (বেতারের প্রধান) লগে তোমারে নিয়ে ঝগড়া করে আসলাম।’ বললাম, কেন! বললেন, ‘আমাকে উনি জিজ্ঞেস করছিলেন- আচ্ছা নাসির আহমেদ কে? আমি বলেছি- আমার বাপ! উনি বললেন, সব গানই যে তার লেখা। আর কারও গান তো গান না? সে জন্য জিজ্ঞেস করলাম।’ এরপর বশির ভাই আমাকে বললেন, ‘ভাগ্যিস আমি মিথ্যা বলি নাই। কারণ, আমার বাবার নামও নাসির আহমেদ!’ আমি সেই প্রথম জানলাম তার বাবার নাম। এবং মনে পড়লো আমাদের প্রথম দেখায় বশির আহমেদ খানিকটা চমকে উঠলেন কেন?’’

নাসির আহমেদ চমকে ওঠার গল্পটাও শুনতে চাই, যদি আপত্তি না করেন...

‘‘বলছি। ওনার গানতো এমনিতেই ভালো লাগতো। ‘যারে যাবি যদি যা...’, ‘অনেক সাধের ময়না আমার...’- এসব গান শুনে কতো যে মুগ্ধ হয়েছি। উনি তখন অলরেডি বিখ্যাত। আর আমি মাত্র শুরু করেছি লেখা। এটা ৭৯/৮০ সালের কথা। তো একদিন ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ওনার বাসায় গেলাম। হাতিরপুল কাঁচাবাজারের কাছে তিনতলা বিল্ডিংয়ের দোতলার একটা বাসায় থাকতেন। ওনার বাচ্চারা বেশ ছোট। তখন আমি দৈনিক বাংলায় কাজ করি। তো গেলাম। সালাম দিলাম। বললেন, ‘চিনতে পারলাম না তো।’ বললাম, ‘আমার নাম নাসির আহমেদ।’ নামটা শুনেই খানিক চমকে উঠলেন। সেদিন না বুঝলেও পরে বহুদিন পর ওই বেতারের গেটে জানতে পারলাম, তার বাবার নামও একই।’’

তারপর...। মানে প্রথম দিনের গল্পটা আরেকটু শুনতে চাই...

‘‘এরপর বললাম, ‘আমি রেডিওতে এনলিস্ট হয়েছি। আপনাকে আমার লেখা কিছু গান দেখাতে চাই।’
বললেন, ‘গানের খাতা এনেছেন?’
বললাম, ‘আমার তো গানের খাতা নেই।’
বললেন, ‘সেকি! আপনি কেমন গীতিকার।’
বললাম, ‘আমার তো গানগুলো কাগজে লেখা। পত্রিকার নিউজ প্রিন্টে।’
বললেন, ‘না, আমি তো কাগজে লেখা দেখবো না। আপনি খাতায় লিখে নিয়ে আসুন।’

পরে আবার গেলাম। খাতায় লিখে। তিন চারটা গান নিয়ে। ‘চন্দনও জ্বলে মনে বনে...’ সম্ভবত এই গানটা ছিল ওনার সঙ্গে প্রথম করা। যাহোক এর কিছু দিন পরেই আব্দুল জব্বার ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলো। তখন আমি সদ্য ব্যর্থ প্রেমিক। বিরহে কাতর যুবক। লিখলাম- ‘আজও মনে পড়ে বিদায় বেলায় বলেছিলে/ অতীতটা ভুলে গিয়ে দেখতে যেতে তোমাকে/ নতুন সুখের ঘরে আজও মনে পড়ে...’। এই গানটা দেখার পর জব্বার ভাই বললেন, ‘চমৎকার গান। আয় ভাই, তুই বুকে আয়’। নিজেই সুর করলেন রেকর্ড করে গাইলেন। সেটাও বেতারের জন্য। পরে টিভিতেও গেয়েছিলেন।’’

প্রথম কোন গানটা আপনাকে ফোকাসে আনে...

‘‘আব্দুল জব্বারের ‘ফুলের আড়ালে ছিল বিষকাঁটা’। সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘ওরা বলে আমি নাকি হৃদয়হীনা’। এই দুটো গান খুব বেজেছে শুরুতে। খুব ক্লিক করেছে তখন। এরপর তো অনেক গানই করেছি। দেশাত্মবোধক গানই লিখেছি সাড়ে চারশ’। লিখছি এখনও।’’ 

সহস্রাধিক গান লিখেছেন। যার মধ্যে অর্ধেকই প্রায় দিবসভিত্তিক বা দেশাত্মবোধক...

‘গানের সংখ্যা হাজার বারোশ’ হবে। হিসাব তো রাখিনি। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৫০টারা মতো, নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) নিয়ে গোটা দশেক হবে। এভাবে উৎসবে, পার্বণে, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে অসংখ্য গান লিখেছি। গত সপ্তাহেও দেশের উন্নয়ন নিয়ে একটা গানের কবিতা দিয়েছি মিল্টন খন্দকারকে।’ 

সহস্রাধিক গানের ভিড়ে নাসির আহমেদের কাছে নিজের লেখা ২০টি পছন্দের গান

১. তোমাকে দেখার পর। সুর: আবু জাফর। কণ্ঠ: ফরিদা পারভীন।
২. মৃত্যুও হতে পারে জীবনের চেয়ে এতটা দামি। সুর: শাহীন সরদার। কণ্ঠ: সুমনা বর্ধন।
৩. কাল সারা রাত বাগানে ফুলের চোখে ঘুম ছিল না। সুর: এ এইচ মো. রফিক।  কণ্ঠ: ইফফাত আরা নার্গিস।
৪. কে বলে নেই আমি। সুর: সুবল দাশ। কণ্ঠ: এন্ড্রু কিশোর।
৫. বহুদিন পর জানতে চেয়েছো তুমি আমার খবর। সুর: সমর দাশ। কণ্ঠ: সুবীর নন্দী।
৬. কতটুকু ভালোবাসি প্রশ্ন করো না। সুর: প্রণব দাশ। কণ্ঠ: মাহমুদুন্নবী।
৭. আজও মনে পড়ে বিদায়বেলায় বলেছিলে। সুর ও কণ্ঠ: আব্দুল জব্বার।
৮. ওরা বলে আমি নাকি হৃদয়হীনা। সুর: খন্দকার নুরুল আলম। কণ্ঠ: সাবিনা ইয়াসমিন।
৯. আমি এক শহীদের বোন। সুর: খন্দকার নুরুল আলম। কণ্ঠ: আবিদা সুলতানা।
১০. সবার চোখেই একটা আকাশ আছে। সুর: মোমিনুল হক। কণ্ঠ: আবিদা সুলতানা।
১১. মির্জা গালিব আমি নই। সুর: সুবল দাশ। কণ্ঠ: সুজিত মোস্তফা/তপন মজুমদার
১২. কখনও কখনও জীবনের চেয়ে মৃত্যু মহিমাময়। সুর: এ এইচ মো. রফিক। কণ্ঠ: শাকিলা জাফর।
১৩. আমাকে ভুল বুঝে ভুল করো না। সুর: খন্দকার নুরুল আলম। কণ্ঠ: ফেরদৌসি রহমান।
১৪. স্বপ্ন ছিল একটি ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাবো। সুর: প্রণব দাশ। কণ্ঠ: শাকিলা জাফর।
১৫. জোনাকিরা ঝিলমিল। সুর: মকসুদ জামিল মিন্টু। কণ্ঠ: বেবী নাজনীন।
১৬. দুষ্টু শ্যামের বাঁশি কান্দে হিয়ার ভেতর। সুর: মকসুদ জামিল মিন্টু। কণ্ঠ: বেবী নাজনীন।
১৭. ফুলের মতো আমার এই প্রেম। সুর: মকসুদ জামিল মিন্টু। কণ্ঠ: তপন চৌধুরী। 
১৮. আমি কাঁদলে নাকি অশ্রু আমার মুক্ত হয়ে ঝরে। সুর: সুজেয় শ্যাম। কণ্ঠ: শাম্মী আখতার।
১৯. সেই কবেকার বাজনা বাজে বুকের মাঝে। সুর: অজিত রায়। কণ্ঠ: সুবীর নন্দী।
২০. তুষার ঝরনা হয়ে ঝরনা নদী হয়ে: সুর ও কণ্ঠ: বশীর আহমেদ।

নাসির আহমেদ অনেক শ্রোতা-সমালোচকের মনে আরেকটি প্রশ্ন জাগতে পারে, সিনেমায় না হয় শুরুতেই একটা অভিমান বা অপমানের ক্ষত তৈরি হয়েছে। কিন্তু একই সময়ে দেশের অডিও ইন্ডাস্ট্রিটাও কিন্তু ক্রমশ জেগে উঠছিল। সেখানেও নাসির আহমেদের উপস্থিতি নেই। এর কারণ কী?

“সঠিক অনুসন্ধান। আমি অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করিনি। করার মতো আগ্রহই পাইনি। অডিও বাজার তো আমাদের চোখের সামনে জন্মালো আর বড় হলো। তো লক্ষ করছিলাম, এমন সব মানুষ সেখানে গীতিকবি হয়ে উঠছিলেন, তাতে আর আগ্রহ পাইনি। সেই পরিবেশে গিয়ে আমার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া ছাত্র, কবি, সাংবাদিক হয়ে গান লেখার পরিবেশটা পেলাম না। তাছাড়া বশির আহমেদ ছাড়া জীবদ্দশায় সেধে কারও কাছে গান উপস্থাপন করতে যাইনি আমি। কেউ সেধে এলে কাজটা করেছি। আমি জানি না অন্যরা কীভাবে করতেন। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের মতো হাতেগোনা দু’-একজন ছাড়া অন্য যারা গান লিখেছেন- কেমন করে আমি জানি না। কিন্তু আমি কোনোদিন নিজের থেকে চেয়ে কারও গান করতে পারি না। আমার প্রতিভা থাকলে আসবে। না আসলেও সমস্যা নাই। এটা তার ব্যর্থতা। হাজার ১২শ’ গান লিখেছি এভাবেই। এটাই আমার বড় প্রশান্তি।”

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের তো সুযোগই রাখলেন না। তবে কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। বাকি রইলো একুশে পদক...

‘জেনেছি, গত বছর আমার নাম একুশে তালিকায় ছিল, কিন্তু পাইনি তো। তবে এর জন্য তদবির করবো না। যেটা বলে নিতে হবে, সেটা আমি চাই না।’

দীর্ঘ এই গীতিকবিতা জীবনে নিশ্চয়ই পছন্দের কিছু মানুষ আছেন, যাদের লেখা ভালো লাগে। এমন ক’জন গীতিকবির নামও অকপটে জানালেন নাসির আহমেদ। তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, লোকমান হোসেন ফকির, এ ইউ এম ফখরুদ্দিন আহমেদ, কাওসার আহমেদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম বাবু, আবিদ আনোয়ার ও আবুল হায়াত মোহাম্মদ কামাল। তরুণদের মধ্যে তিনি তার পছন্দের তালিকায় রেখেছেন জুলফিকার রাসেল ও কবির বকুলের নাম।

বললেন সুরকারদের নিয়েও। এখানেও চলতি প্রজন্মের সুরকারদের নিয়ে হতাশাই বেশি নাসির আহমেদের মনে। তবে এরমধ্যে প্রশংসাও করলেন সচেতনভাবে— 

‘‘এখনকার অধিকাংশের কবিতার জ্ঞান কম। কবিত্ব কম। গানের কবিতাতে তো কাব্যমান লাগবে। যেমন খন্দকার নুরুল আলম ভাই একদিন বলছিলেন, ‘খালি ছন্দের গান দেস, একটা গদ্যের গান দে।’ আমি লিখলাম আবিদা সুলতানার জন্য, বিজয় দিবসে বেতারের জন্য- ‘আমি এক শহীদের বোন/ স্বাধীনতা আমার দেশের নাম/ একুশ আমার ডাকঘর/ শুধু এইটুকু লিখে চিঠি দিও/ আমি পেয়ে যাবো...।’ এইটুকু বোধ তো থাকা লাগবে। এখন সেই সুরকারও নেই। কাওসার আহমেদ চৌধুরী যদি বেঁচে থাকতেন তার গান সুর করার সুরকার আর পাওয়া যেতো না। তবে দু’-একজন যে নাই তা না। যেমন বাপ্পা মজুমদার। ভালো সুর করেন। ভালো গান করেন। আরেকজন অসামান্য সুর করেন শাহীন সর্দার। তাকে দিয়ে আমি ৬০-৭০টা গান করেছি। শওকত আলী ইমনের সুর কিছুটা ভালো লাগে। যেমন খন্দকার নুরুল আলম ভাই ৫০টা গান করলে ৪৮টাই ভালো লাগতো। যেটা এখনকার সুরে-কথায় পাওয়া যায় না। সুরকারকেও তো সুরের কবি হতে হবে। এখন সব হচ্ছে শর্টকাট। দুদিনে গান শেষ। আমরা এক গানে সময় নিতাম ১৫ দিন, এক মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত। এখন গান হচ্ছে রকেটের গতিতে। তাই মানটাও তেমনই, রকেটের গতিতে ভূপাতিত হচ্ছে।’’

কবি জানান, এখনও প্রতিদিনই গান লেখেন। এখনও রেডিও-টিভির জন্যই মূলত লেখেন। গান নিয়ে খুব বেশি স্বপ্ন বা পরিকল্পনা নেই নাসির আহমেদের। একটাই স্বপ্ন, নিজের লেখা অন্তত দুইশ’ ভালো গান তিনি বই আকারে রেখে যেতে চান, যেগুলোর মাধ্যমে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবেন তাকে। গীতিকবির সঙ্গে প্রতিবেদক

ছবি: মাহমুদ মানজুর

/এমএম/এমওএফ/
টাইমলাইন: গীতিকবির গল্প
২৪ নভেম্বর ২০২৩, ০৮:৪৭
যে দেশে বৃক্ষ নাই, সেখানে ভেরেণ্ডা গাছই বটবৃক্ষ: নাসির আহমেদ
সম্পর্কিত
অনেক কিছুই ইচ্ছে করে, কিন্তু করা যায় না: মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
গীতিকবির গল্পঅনেক কিছুই ইচ্ছে করে, কিন্তু করা যায় না: মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
মনিরুজ্জামান মনির: জন্মদিনে জানালেন বই প্রকাশের খবর
মনিরুজ্জামান মনির: জন্মদিনে জানালেন বই প্রকাশের খবর
গানের জন্য একমাত্র পুত্রকে হারানো এবং...
গীতিকবির গল্পগানের জন্য একমাত্র পুত্রকে হারানো এবং...
৭১ বসন্তে গীতিকবি ও সাংবাদিক নাসির আহমেদ
শুভ জন্মদিন৭১ বসন্তে গীতিকবি ও সাংবাদিক নাসির আহমেদ
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
একসঙ্গে এই অভিনেতারা...
একসঙ্গে এই অভিনেতারা...
শিল্পীদের সমস্যাগুলো সংসদে চিহ্নিত করতে চাই: ফেরদৌস
শিল্পীদের সমস্যাগুলো সংসদে চিহ্নিত করতে চাই: ফেরদৌস
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!