দুনিয়াজুড়ে নজরদারির শিকার হয়েছেন মানবাধিকার কর্মী, রাজনীতিক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সদস্যরা। লোকজনের ওপর গোপনে নজরদারি করতে ইসরায়েলের একটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে একটি স্পাইওয়্যার বিক্রি করেছে। এই স্পাইওয়্যার দিয়েই ৫০ হাজার ফোনের ওপর গোপনে নজরদারি চালানো হয়েছে।
২০১৯ সাল থেকে ১৭টি দেশের সংবাদমাধ্যম মিলে ‘দ্য পেগাসাস প্রজেক্ট’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে ফোনে নজরদারির বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। সেই অনুসন্ধানেই উঠে এসেছে বিশ্বজুড়ে ৫০ হাজার ফোন হ্যাক করে সেগুলোতে নজরদারি চালানোর বিষয়টি।
এই তালিকা এবং এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনটি সারা বিশ্বের কিছু প্রথম সারির কিছু সংবাদমাধ্যমের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। লন্ডনের দ্যা গার্ডিয়ানসহ ১৬টি সংবাদমাধ্যম একযোগে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
ম্যালওয়্যারটির বিক্রেতা ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও-র দাবি, এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে তারা যুক্ত নয়। বরং মানবাধিকার রেকর্ড ভালো এমন দেশের সামরিক বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা বিভাগের কাছে তারা এই সফটওয়্যার বিক্রি করেছে।
পেগাসাস নামে এই স্পাইওয়্যারটি সম্পর্কে ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্যা গার্ডিয়ান, ল্য মোঁদ এবং আরও ১৪টি সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের নিউজ পোর্টাল দ্য ওয়্যার এই হ্যাকিংয়ের তালিকায় সে দেশের অন্তত ৩০০ রাজনীতিক, সাংবাদিক, অধিকার কর্মী, বিজ্ঞানীর নাম রয়েছে বলে জানিয়েছে। তালিকায় এই পোর্টালের দুই জন প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিকের নামও রয়েছে।
যাদের টার্গেট করে হ্যাকিং
পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি এখনও প্রকাশ না হলেও এই তদন্তের সঙ্গে যুক্ত সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বিশ্বের ৫০টি দেশের অন্তত এক হাজার জনের নাম তারা জানতে পেরেছে। এদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, অধিকার কর্মী এবং আরব বিশ্বের বেশ কয়েকটি রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্য।
সিএনএন, আল জাজিরা এবং নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ১৮০ জনেরও বেশি সাংবাদিকের নাম এই তালিকায় রয়েছে।
এই অবৈধ নজরদারির ঘটনা বেশিরভাগ ঘটেছে মূলত ১০টি দেশে। এই দেশগুলো হচ্ছে ভারত, আজারবাইজান, বাহরাইন, হাঙ্গেরি, কাজাখস্তান, মেক্সিকো, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
তদন্তের অংশ হিসেবে যখন এসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় তখন তাদের মুখপাত্ররা পেগাসাস ব্যবহার এবং অবৈধভাবে নজরদারি চালানোর কথা অস্বীকার করেন। তবে পেগাসাস ব্যবহার করে কোন কোন দেশে কাদের ফোন হ্যাক করা হয়েছে তার বিস্তারিত তালিকা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।
যেভাবে কাজ করে পেগাসাস স্পাইওয়্যার
ব্রিটিশ দৈনিক দ্যা গার্ডিয়ান বলছে, পেগাসাস সম্ভবত কোনও বেসরকারি কোম্পানির তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী স্পাইওয়্যার। আইওএস বা অ্যান্ড্রয়েড-চালিত ফোনের ওপর গোপনে নজরদারি চালানোর ক্ষমতা এই ম্যালওয়্যারটির রয়েছে। পেগাসাস যদি কোনোভাবে একবার ফোনে ঢুকে যেতে পারে, তাহলে এটি আপনার ফোনকে সার্বক্ষণিক এক নজরদারির যন্ত্রে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে।
ফোন থেকে আপনি যত মেসেজ বা ছবি পাঠান, কিংবা রিসিভ করুন, পেগাসাস তা কপি করে গোপনে পাচার করে। পাঠিয়ে দেয় নির্দিষ্ট জায়গায়।
এই স্পাইওয়্যারটি আপনার অগোচরে ফোনের কথাবার্তা রেকর্ড করতে পারে, এমনকি ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে গোপনে আপনার ভিডিও রেকর্ড করতে পারে। আপনি কোথায় আছেন, কোথায় গিয়েছিলেন, অথবা কার কার সঙ্গে দেখা করেছেন, পেগাসাস সে সম্পর্কেও জানতে পারে বলে মনে করা হয়।
২০১৬ সালে গবেষকরা পেগাসাসের প্রথম ভার্সনটির কথা জানতে পারেন। সে সময় কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির ফোনে টেক্সট মেসেজ বা মেইল পাঠানো হতো, যাতে থাকতো একটি লিংক। সেই লিংকে ক্লিক করলেই পেগাসাস ফোনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতো। অবশ্য এরপর এনএসও গ্রুপ এই স্পাইওয়্যারের ক্ষমতাকে আরও বহুগুণ শক্তিশালী করেছে।
২০১৯ সালে ভারতে আরেকটি পেগাসাস কেলেঙ্কারির পর জানা যায়, ভিডিও কলের মাধ্যমেই স্পাইওয়্যারটি মোবাইল ফোনে ইন্সটল হয়ে যায়। যদি সেই ফোন রিসিভও না করা হয়, তবুও সফটওয়্যারটি ফোনে ইন্সটল হয়ে যায়। অর্থাৎ যার ফোনে নজরদারি চালানো হবে বলে টার্গেট করা হয়, তার বিশেষ কিছু করার থাকে না। সূত্র: বিবিসি।