X
মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫
২৩ বৈশাখ ১৪৩২

গ্রিনল্যান্ড নিয়ে ট্রাম্পের আগ্রহের নেপথ্যে

সুদীপ্ত কবীর
১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:০৮আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:১৬

গ্রিনল্যান্ডে মার্কিন আধিপত্য নিশ্চিত করতে আর্থিক এমনকি সামরিক শক্তি ব্যবহারেও পিছপা হবেন না বলে কিছুদিন আগে হুমকি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই ভূখণ্ড নিয়ে ট্রাম্পের বা যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ এই প্রথমবার সামনে আসেনি। প্রথম মেয়াদেও ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ড নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। এর বহু আগে আরও মার্কিন প্রেসিডেন্টও নিজেদের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এবারের ট্রাম্পের হুমকি বিশ্বের নজর কেড়েছে। ইউরোপীয় নেতাদের পক্ষ থেকে সমালোচনাও শুরু হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতায় বসার আগেই তার এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্যের নেপথ্যে কী রয়েছে নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, খনিজ সম্পদের সম্ভাব্য বিপুল ভাণ্ডার ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই ট্রাম্পের কাছে গ্রিনল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

সাদা চাদরে ঢাকা সবুজ ভূমি

কানাডার উত্তরপূর্বে আর্কটিক ও আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে গ্রিনল্যান্ডের অবস্থান। ডেনমার্কের আধাস্বায়ত্বশাসিত বিশ্বের বৃহত্তম এই দ্বীপটিতে মাত্র ৬০ হাজার মানুষের বাস। ১৭২১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বরফাচ্ছাদিত এই অঞ্চল ডেনমার্কের উপনিবেশ ছিল। ১৯৭৯ সালে কোপেনহেগের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পায় গ্রিনল্যান্ড। ২০০৯ সালে সেখানে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের অধিকার চালু হয়।

গ্রিনল্যান্ডের বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ি একটি এলাকা। ছবি: এনপিআর

বিশ্বব্যাংকের জলবায়ু পরিবর্তন পোর্টাল অনুযায়ী, গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা বরফাচ্ছাদিত, যা কোথাও কোথাও প্রায় তিন কিলোমিটার পর্যন্ত পুরু। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এখানকার বরফ গলছে আশঙ্কাজনকভাবে। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির জলবায়ু বিজ্ঞানী ডেভিড হল্যান্ড বলেছেন, বিশ্বের অন্যান্য অংশের চেয়ে এখানকার উষ্ণতা চারগুণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

খনিজ সম্পদের ভাণ্ডারে নজর

গ্রিনল্যান্ডের টনকে টন বরফের নিচে লুকিয়ে আছে মূল্যবান ইউরেনিয়াম, যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় লিথিয়াম, কয়েকশ কোটি বিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের এক বিশাল সমারোহ। উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সম্পদের এই বিশাল ভাণ্ডার হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ হিসেবে দেখছে পরাশক্তিগুলো।

ইউরোপীয় কমিশনের ২০২৩ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, অতিগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত ৩৪টি খনিজ উপাদানের অন্তত ২৫টি রয়েছে গ্রিনল্যান্ডে। এর মধ্যে রয়েছে লিথিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌল। লিথিয়ামের বাজারে আধিপত্য রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, চিলি ও চীনের। বর্তমান বিশ্বে অতিগুরুত্বপূর্ণ খনিজের প্রায় ৭০ শতাংশের সরবরাহকারী চীন।

লন্ডন ইউনিভার্সিটির ভূরাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক ক্লাউড ডডস বলেছেন, গ্রিনল্যান্ডে বরফের নিচে লুকিয়ে থাকা বিপুল সম্পদ ট্রাম্পের আগ্রহের একটি বড় কারণ হতে পারে।

নৌপথ নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার

১৮৯০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ কৌশলবিদ ও বিশেষজ্ঞ আলফ্রেড টি মাহান তার ‘দ্য ইনফ্লুয়েন্স অব সি পাওয়ার আপন হিস্ট্রি’ গ্রন্থে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের একটি তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন, যা এখনও প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তার মতে, সমুদ্র যার নিয়ন্ত্রণে, বিশ্ব তার মুষ্টিতে।

অবস্থানগত কারণে গ্রিনল্যান্ড নিয়ে সবার আগ্রহ রয়েছে। ছবি: বিবিসি

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও রাশিয়ার মধ্যে অবস্থান হওয়ার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ওয়াশিংটনের কাছে গ্রিনল্যান্ডের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। উত্তর আমেরিকা থেকে ইউরোপে পৌঁছানোর সংক্ষিপ্ততম পথ রয়েছে গ্রিনল্যান্ডের মধ্য দিয়ে। ১৯৪১ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী সেখানে ঘাঁটি নির্মাণ করে। ফলে গ্রিনল্যান্ডে মার্কিন ও ন্যাটোর উপস্থিতি নিশ্চিত হয়। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বরফ গলার কারণে উন্মুক্ত হচ্ছে নতুন নৌ পথ।

বরফ গলতে থাকায় গ্রীষ্মকালে আর্কটিকে জাহাজ চলাচলের সময় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্কটিক কাউন্সিলের মতে, বরফ গলতে থাকায় ২০২৪ সালে গত এক দশকের মধ্যে ওই অঞ্চলে জাহাজ চলাচল ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

নৌপথে আধিপত্য বিস্তার সবসময়ই পরাশক্তিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ছবি: সিবিসি নিউজ

এখানকার নৌপথ চীন ও রাশিয়ার জন্য প্রবেশদ্বার হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে, যা নজরদারিতে রাখতে চায় ওয়াশিংটন। ফলে গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যকে সংযোগকারী জলসীমায় রাডার ব্যবস্থা স্থাপন করে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি আরও সংহত করতে আগ্রহী মার্কিন প্রশাসন।

ডেনিশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক উলরিখ প্রাম গ্রাড বলেছেন, সম্ভাব্য রুশ আগ্রাসন থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গ্রিনল্যান্ডের প্রতি নজর রয়েছে ওয়াশিংটনের। কারণ উত্তর পশ্চিম প্যাসেজ শিপিং লেনটি যুক্তরাষ্ট্রের উপকূল বরাবর এবং দ্বীপটি গ্রিনল্যান্ড-আইসল্যান্ড-যুক্তরাজ্য মোহনার অংশ যা একটি কৌশলগত সামুদ্রিক অঞ্চল।

প্রতিদ্বন্দ্বিদের প্রভাব মোকাবিলা

আর্কটিকে আগে থেকেই রুশ উপস্থিতি ছিল। এছাড়া এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেছে চীন। কানাডার দাবি, নতুন নৌপথ তাদের আঞ্চলিক জলসীমার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে, তাই এখানে তাদের অধিকার রয়েছে। ফলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঠেকাতে আগে থেকেই গ্রিনল্যান্ডে মার্কিন উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাইছেন ট্রাম্প।

প্রথম মেয়াদেও গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ট্রাম্প। তবে এই তালিকায় তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন। ১৮৬৭ সালে আলাস্কা কেনার সময় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসন গ্রিনল্যান্ডের প্রতিও আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হ্যারি ট্রুম্যানের প্রশাসন এই বিশাল ভূখণ্ড কেনার জন্য ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রস্তাব দেয়।

স্নায়ুযুদ্ধকালে গ্রিনল্যান্ড থেকে সোভিয়েতের ওপর নজরদারি করত যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: ইউটিউব

আর সোভিয়েত আমল থেকেই আর্কটিক অঞ্চলে সামরিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে আছে মস্কো। স্নায়ু যুদ্ধের সময় থেকেই তৎকালীন সোভিয়েত সাম্রাজ্যের ওপর নজরদারি করতে সেখানে থুলে বিমানঘাঁটি স্থাপন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েতের পতনের মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটলে গ্রিনল্যান্ড নিয়ে আগ্রহ কমে যায় মার্কিন প্রশাসনের। রাজধানী ন্যুকে মার্কিন দূতাবাসের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। তবে দৃশ্যপট বদলাতে থাকে বিগত বছরগুলোতে চীনের দ্রুত উত্থান শুরু হলে।

২০১৭ সালে প্রকাশিত বিবিসির কিছু প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিজেদের ভূখণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক মানে বিমানবন্দর তৈরি করার প্রকল্প হাতে নেয় ন্যুক। আর এ কাজে অর্থায়ন করতে আগ্রহ প্রকাশ করে বেইজিং। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক সংকেত বেজে ওঠে ওভাল অফিসে। গ্রিনল্যান্ডে চীনের অর্থায়নে বিমানবন্দর তৈরি হলে সেখানে চীনের আধিপত্য বৃদ্ধির আশঙ্কা ছিল। তখন মার্কিন উদ্যোগে বিমানবন্দর প্রকল্পের জন্য ডেনমার্ককে বিনিয়োগে রাজি করানোর মাধ্যমে চীনকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

রাজধানী ন্যুকের বিমান বন্দর। ছবি এনপিআর

এদিকে, আর্কটিকে রাশিয়ার শক্তিশালী অবস্থান নিয়েও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হবু ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে মনোনীত মাইক ওয়াল্টজের এক বক্তব্যে মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, রাশিয়া চাইছে আর্কটিক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে। তাদের রয়েছে বরফের মধ্যে দিয়ে চলাচল উপযোগী ৬০টির বেশি জাহাজ (আইসব্রেকার)। এর কয়েকটি আবার পারমাণবিক শক্তিচালিত। যুক্তরাষ্ট্রের এমন জাহাজ আছেই মাত্র দুটি, যার একটি আবার আগুনে পুড়ে গেছে।

 

/এসকে/ এএ/
সম্পর্কিত
অনুসন্ধানে পুলিৎজার জিতলো রয়টার্স, নিউ ইয়র্ক টাইমস পেলো চারটি পুরস্কার
সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পদগুলো কমানোর সিদ্ধান্ত মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর
কাশ্মীরে হামলা৭১ সালের পর প্রথম ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নিরাপত্তা মহড়ার নির্দেশ
সর্বশেষ খবর
বিপুল অস্ত্রসহ সুন্দরবনের বনদস্যু করিম শরীফ বাহিনীর ২ সদস্য আটক
বিপুল অস্ত্রসহ সুন্দরবনের বনদস্যু করিম শরীফ বাহিনীর ২ সদস্য আটক
খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরের পেছনে নেতাকর্মীদের আসা ঠেকানো যায়নি
খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরের পেছনে নেতাকর্মীদের আসা ঠেকানো যায়নি
তামাক পণ্যে কর ও মূল্য বৃদ্ধির দাবি
তামাক পণ্যে কর ও মূল্য বৃদ্ধির দাবি
প্রতিদিন আনলিমিটেড মোজো উপভোগের সুযোগ
প্রতিদিন আনলিমিটেড মোজো উপভোগের সুযোগ
সর্বাধিক পঠিত
চেম্বার থেকে নারী চিকিৎসককে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় এনে মারধর
চেম্বার থেকে নারী চিকিৎসককে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় এনে মারধর
এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের চাপে আওয়ামীপন্থি ৬ প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল
এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের চাপে আওয়ামীপন্থি ৬ প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল
প্রাথমিকে আরও একটি অধিদফতর হচ্ছে
প্রাথমিকে আরও একটি অধিদফতর হচ্ছে
বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে মাংস আমদানি চাপ আসছে: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে মাংস আমদানি চাপ আসছে: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয়ের আর্থিক অনিয়মের চিত্র
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয়ের আর্থিক অনিয়মের চিত্র