X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

গৌতম আদানি ও ভারতের নয়া পুঁজিবাদ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:২৯আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:২৯

গৌতম আদানির সব কিছু দারুণ কাটছিল। ২০২২ সালে অল্প সময়ের জন্য হলেও, বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি হয়েছিলেন তিনি। চলতি বছরের শুরুটাও হয়েছিল চমৎকার। ভারতের জনপ্রিয় একটি সংবাদমাধ্যম জানুয়ারিতে আদানিকে ‘প্রবৃদ্ধির রাজা’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।

চলতি বছর আদানি আরও ভালো কিছু করবেন বলে আশা করা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, জানুয়ারিতে তার কোম্পানি শেয়ার বাজার থেকে সংগ্রহ করবে ২৪০ কোটি ডলার। ফলে আদানি ও তার গ্রুপকে অনেকটা অপরাজেয় বলেই মনে হচ্ছিল।

আদানি এখনও সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছেন, তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আসলে নিউইয়র্কভিত্তিক  সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরই মূলত তোলপাড় শুরু হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানি গ্রুপ তার স্টক মূল্য ও বাজার দরকে কারসাজি করে বাড়িয়েছে। করপোরেট ইতিহাসে আদানি সবচেয়ে বড় ‘জালিয়াতি’ করেছেন।

আদানি গ্রুপ অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। অভিযোগের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে নিউইয়র্কের একটি শীর্ষ আইনি সংস্থাকে নিযুক্ত করেছেন তিনি।

এসব অবশ্য আদানির পতন ঠেকাতে পারেনি। বাজারে তার শেয়ারের দাম হু হু করে পড়তে থাকে। আদানি গ্রুপের স্টককে নেতিবাচক সংকেত দেয় ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস। আদানি গ্রুপের স্টককে দেওয়া লেনদেন কমিয়ে দিয়েছে মর্গ্যান স্ট্যানলি ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল। টেকসই সূচক থেকে স্টকগুলো সরিয়ে দিয়েছেএস অ্যান্ড পি ডো জোনস ইনডিসেস।

নরওয়ের সার্বভৌম সম্পদ ফান্ড তার হোল্ডিং বিক্রি করে দিয়েছে। আর ক্রেডিট সুইস ও সিটি গ্রুপ বলছে, তারা আর আদানি গ্রুপের সিকিউরিটিজকে জামানত হিসেবে গ্রহণ করবে না।

গ্রুপটির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা প্রতিবেদনটিকে ভারতের ওপর আক্রমণ বলে বর্ণনা করেছেন। ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেস আদানি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে জবাব চেয়েছে। রাহুল গান্ধী সংসদে আদানির সঙ্গে মোদির কথিত সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন যা পরে সরকারি রেকর্ড থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল।

মোদির সঙ্গে আদানির সম্পর্ক গভীর। ভারতের একটি সমৃদ্ধ বেসরকারি খাত থাকলেও আদানির উত্থান সবার চোখে পড়েছে। কারণ মোদির ক্ষমতায় আরোহণের সঙ্গে তার উত্থানের দারুণ মিল রয়েছে।

মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ফুলেফেঁপে উঠেছে আদানির ব্যবসা। ২০০২ সাল থেকে রাজনীতিবিদদের জন্য বড় পৃষ্ঠপোষক বনে যান আদানি। ২০০১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন মোদি। দাঙ্গার পর বিপাকে পড়েছিলেন মোদি। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। এ সময় মোদিকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন আদানি।

গুজরাটের ব্যবসায়ী নেতাদের একত্রিত করেছিলেন তিনি। মোদি হয়তো সেই উপকার ভুলে যাননি।  বিপদে যারাই তার পাশে দাঁড়িয়েছে, সবাইকেই কোনও না কোনোভাবে ঋণ ফিরিয়ে দিয়েছেন মোদি।

মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় গুজরাটের মুন্দ্রায় ভারতের বৃহত্তম ব্যক্তিগত বন্দরসহ রাজ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন আদানি। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে আদানি গ্রুপ ভারতের বন্দর ক্ষমতার এক-চতুর্থাংশ নিয়ন্ত্রণে নেয়। পাশাপাশি ছয়টি সরকারি মালিকানাধীন বিমানবন্দর পরিচালনা করার দায়িত্ব পান আদানি। এক সময় ভারতের দ্বিতীয় ব্যস্ততম ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭৪ শতাংশ শেয়ারও কিনে নেন তিনি। আদানি গ্রুপ ২০২১ সালে একটি উচ্চাভিলাষী পরিবেশবান্ধব জ্বালানি প্রকল্প ঘোষণা করে।

আজকের ভারতীয় পুঁজিবাদ অতীতের থেকে আলাদা। স্বাধীনতার পরের দশকগুলোতে যখন ভারত নিজেদের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করেছিল এবং কোম্পানিগুলোকে পুঁজি বাড়াতে বা কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য সরকারি অনুমতির প্রয়োজন হতো, তখন ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বিশাল আমলাতন্ত্রকে বশে আনার প্রতিযোগিতা ছিল। এরপর বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নেমে আসে কঠোর বিধিনিষেধ। কর্মীদের ছাঁটাই থেকে শুরু করে বিনিয়োগের বিষয়ে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন হতো।

ভারতে অর্থনৈতিক সংস্কারটা মূলত শুরু হয় ১৯৯১ সালের দিকে। তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসিংহ রাও এবং অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং এ উদ্যোগ নেন। এরপর থেকে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রভাব দেখাতে শুরু করেন।

গুজরাট সব সময় বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। অতীতে এখানকার বড় ব্যবসায়ীরা সরকারকে নাখোশ করতে চাইতেন না। একই সঙ্গে তারা তাদের কার্যক্রমেও সরকারি হস্তক্ষেপ পছন্দ করতেন না। এটি যদি গুজরাটের অতীতের বাণিজ্যিক মডেল হয়ে থাকে তাহলে সরকার ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিভাজন রেখা ছিল মোদি ও আদানি সেটিকে অস্পষ্ট করে দিয়েছেন। 

এক প্রতিবেদন অনুসারে, আদানি গ্রুপ মুন্দ্রা বন্দর এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য প্রতি বর্গমিটারে ১ থেকে ৩২ রুপি নিয়েছে; যা এমন কাজের জন্য অন্যান্য কোম্পানিগুলোকে পরিশোধিত অর্থের তুলনায় যথেষ্ট কম।

২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চার বছর পর, ভারত বিমানবন্দরের জন্য দরপত্র দাখিলের ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই এমন একটি কোম্পানিকে অনুমতি না দেওয়ার জন্য নিয়ম পরিবর্তন করে। এরপর বিমানবন্দরের ছয়টি কাজ পেয়ে যান আদানি। যখন ভারত বাজারভিত্তিক কৃষি সংস্কার চালু করার পরিকল্পনা ঘোষণা করে তখন আদানি শস্যখাতে বিনিয়োগ করেন। যদিও পরে এই সংস্কার বাতিল করা হয়েছিল।

ভারতের এই বাণিজ্যিক মডেলটিকে অনেকেই পূর্ব এশীয় রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট পুঁজিবাদের মতো মনে হতে, যেখানে একজন রাষ্ট্রপ্রধান তাকে সমর্থনকারী কোম্পানিগুলোকে শক্তিশালী করতে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। যেমন, জাপানের সোগোশোশা বা দক্ষিণ কোরিয়ার চেবোল।

কিন্তু এখানে কিছুটা পার্থক্য আছে। জাপানি সোগোশোশা ছিল আন্তঃসংযুক্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যারা একের অপরের সঙ্গে মধ্যস্থতায় উৎপাদন বাড়িয়ে অধিক মুনাফা লাভ করত। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার চেবোল ছিল যুদ্ধোত্তর জাতি-নির্মাতা; কার্যকরভাবে পুঁজির অভাবগ্রস্ত একটি দেশে উদ্যোগী মূলধনী সংস্থা। উভয় ক্ষেত্রেই শিল্পগোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা এবং পৃষ্ঠপোষকতা থেকে উপকৃত হয়েছিল। তবে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। কিন্তু আদানি গ্রুপের উত্থানে বিভিন্ন খাতে একচেটিয়া পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

বরং ভারতে আদানির উত্থান মার্কোস, সুহার্তো এবং মাহাথিরের অধীনে বিরাজমান পুঁজিবাদকে অনুসরণ করে বলেই মনে হয়। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে মুষ্ঠিমেয় কয়েক ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

মার্কোসের ছিলেন ‘ব্যানানা কিং’ আন্তোনিও ফ্লোরেন্ডো এবং ‘কোকোনাট কিং’ এডুয়ার্ডো ‘ড্যান্ডিং’ কোজুয়াংকো। সুহার্তোর ছিলেন লিয়েমসিওলিওং, মোহাম্মদ ‘বব’ হাসান এবং অন্যান্য ধনকুবের। যারা তার সন্তানদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করে এবং অংশীদারত্বকে পারস্পরিকভাবে লাভজনক করে তোলেন। মাহাথিরের ছিলেন তাজুদিন রামলি।

এই ব্যবসায়ীরা ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে তাদের দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকা শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ধনকুবেররা প্রায়শই এমন চুক্তি পেতেন যা এই পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে অনেকটাই একচেটিয়াতে পরিণত হয়েছিল।

আদানি যেমন ভারতকে পুণর্নির্মাণ করতে চান, মোদিও ভারতীয় পুঁজিবাদকে নতুন গড়ে তুলতে চাইছেন। মোদির এতদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সমাজে ব্যবসায়ীদের অবস্থান পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে গেছে: রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে সহযোগিতাকারী শ্রদ্ধাভাজন ট্রাস্টির বদলে বাণিজ্যিক ব্যক্তিত্বরা এখন রাজনীতিকদের কাজ করতে দিতে উন্মুখ ভয়ঙ্কর মিত্রতে পরিণত হয়েছেন এবং যারা সুবিধামতো সম্পর্ক গড়ে তুলে কাজ পাওয়া নিশ্চিত করছেন।

মহাত্মা গান্ধী যে জনচেতনার পূঁজিবাদের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন এই পরিবর্তন ভারতকে সেটি থেকে অনেক দূরবর্তী ধনিকতান্ত্রিক সমাজের দিকে নিয়ে যাবে। স্বাধীনতা পরবর্তী চেতনা থেকে ভারত এখন অনেক দূরে সরে গেছে।

ফরেন পলিসি অবলম্বনে।

 

/এসপি/এএ/
সম্পর্কিত
বৃষ্টি ও বন্যায় কেনিয়ায় নিহত অন্তত ৪৫
হামাসকে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
গাজায় যুদ্ধবিরতি নাকি রাফাহতে হামলারাজনৈতিক সংশয়ের মুখোমুখি নেতানিয়াহু
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার