যখন আপনি চোখ বন্ধ করে রাখবেন তখন সেই চোখ খুলতে এমন স্থানে ধাক্কা দেওয়া দরকার, যা আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ক্ষতির কারণে চোখ খুলতে আপনি হয়তো বাধ্য হবেন, এই আকাঙ্ক্ষা থেকে নেট দুনিয়ায় এখন ‘সেলিব্রেটি ব্লকআউট’ প্রচার শুরু হয়েছে। হু হু করে ফলোয়ার কমছে, ব্লক তালিকায় পড়ছেন বিশ্বের নামিদামি সেলিব্রেটিরা। গাজায় চলমান সহিংসতা নিয়ে তারা কোনও ‘রা’ না করায় এবার তাদের জনপ্রিয়তায় আঘাত পড়তে শুরু করেছে।
আসলেই কি প্রভাব পড়ছে?
‘ব্লকআউট’ সমর্থকদের যুক্তি হলো, ব্লক করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ব্র্যান্ডগুলোকোনও পণ্যের প্রচারের জন্য তাদের সঙ্গে কাজ করে যারা সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রভাবশালী, অর্থাৎ অনেক ফলোয়ার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সেলিব্রিটিদের ফলোয়ার সংখ্যা ও জনপ্রিয়তা বিবেচনায় থাকে কোম্পানিগুলোর। সোশ্যাল মিডিয়াতে কাউকে ব্লক করার অর্থ হলো আপনি সেই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টের পোস্টগুলো আর দেখতে পাবেন না। এর ফলে সেলিব্রিটি অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা কোনও কনটেন্ট ব্লককারী ফলোয়ারদের কাছে পৌঁছায় না। এতে কোম্পানিগুলোর পণ্য অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।
তবে এই ক্যাম্পেইনের বিপক্ষে আলাপও চলছে। নেট দুনিয়ার কিছু পোস্ট দাবি করছে, ব্লকআউটটি একটি নেতিবাচক উদাহরণ। কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন, জটিল ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুতে কথা বলা সেলিব্রিটিদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাদের প্রশ্ন- সেলিব্রেটিরা এসব বিষয়ে কী ভাবছেন সেটা কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা হতে পারে।
এদিকে, ফিলিস্তিনে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধে সর্বশেষ গাজার উত্তরাঞ্চলীয় জাবালিয়ায় লড়াই আরও তীব্র হয়েছে। শুক্রবার (১৭ মে) সেখানে হামলা আরও জোরদার করেছে ইসরায়েল। সেখানে ট্যাংক-বুলডোজার নিয়ে প্রবেশ করে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে সেনারা। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের যোদ্ধারা সুড়ঙ্গপথের কাছে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরেও লড়াই চলছে। সেখানে প্রবেশ করা ইসরায়েলি ট্যাংকগুলোতে হামলা চালিয়েছে হামাস যোদ্ধারা। এরমধ্যে গত সপ্তাহে জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজি)-তে আবেদন করে দক্ষিণ আফ্রিকা বলেছে- ফিলিস্তিনিদের বাঁচাতে রাফাহ অভিযানে ইসরায়েলকে অবশ্যই থামাতে হবে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, সাত মাসের বেশি সময় ধরে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনে প্রায় ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
মেট গালায় ‘তাদের কেক খেতে দাও’ বিতর্ক
গত ৬ মে মেট গালার সময় থেকে স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে #Blockout2024 হ্যাশট্যাগের একটি প্রতিবাদ শুরু হয়। এতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের আহ্বান জানানো হয়- গাজায় চলমান যুদ্ধ বন্ধে কথা বলেনি এমন সেলিব্রিটিদের অ্যাকাউন্ট ব্লক করতে। এছাড়া কোন কোন সেলিব্রেটি গালায় অংশ নেন তাতেও নজর ছিল অ্যাক্টিভিস্টদের। এই অনুষ্ঠান ঘিরে প্রতিবাদ করে আসছিলেন তারা।
একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্টিভিস্টরা যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গণহত্যার মুখোমুখি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করায় এক শিক্ষার্থীকে বার্নার্ড কলেজ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠছে।
যুদ্ধবিরোধী অ্যাক্টিভিস্টদের সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পড়েছেন টিকটক তারকা হ্যালি কালিল। যার ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় এক কোটি। তার শেয়ার করা একটি ভিডিও থেকে এই সমালোচনা ও বিতর্কের সূত্রপাত। ওই গালা আয়োজনে যে ফুলেল সাজের পোশাক ও মেকাপে তিনি হাজির হয়েছিলেন সেটির ছিল ফ্রান্সের শেষ রানির পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভিডিওতে তাকে ‘তাদের কেক খেতে দাও’ বলে ঠোঁট নাড়াতে দেখা গেছে। এতে পুরনো একটি চলচ্চিত্রের অডিও ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক বিতর্কিত উক্তি। যা ফরাসি বিপ্লবের সময় বলেছিলেন রানি ম্যারি-অ্যান্টোইনেট। ওই সময় ফ্রান্সের ক্ষুধার্ত কৃষকদের খাওয়ার মতো রুটি ছিল না। তখন ফরাসি রানি বলেছিলেন, রুটি নাই তো কী হয়েছে, কেক খেতে দাও।
যেহেতু কেক রুটির চেয়ে বেশি দামি, উপাখ্যানটিকে সাধারণ মানুষের অবস্থা ও দৈনন্দিন জীবনের প্রতি মারি-অ্যান্টোইনেটের অজ্ঞানতার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যুদ্ধবিরোধী অ্যাক্টিভিস্টদের কাছে, লাল গালিচায় হাঁটার সময় এই সেলিব্রেটিরা চাইলেই গাজায় মারাত্মক সংঘাত বন্ধ করার আহ্বান জানাতে পারেন, কিন্তু তারা তা জানাচ্ছেন না।
সমালোচনার মুখে ভিডিওটি মুছে ফেলা হয় ও পরে কালিল ক্ষমা চেয়েছেন। যদিও এর আগেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। বিশ্বব্যাপী সংঘাত ও মানবিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে এই সরিয়ে নেওয়াকে পিছু হটা হিসেবে বিবেচনা করছেন অ্যাক্টিভিস্টরা।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিবাদীরা কী চাইছেন?
সেলিব্রেটি ব্লকআউট আন্দোলনটি ফিলিস্তিনের সমর্থকদের নিয়ে গঠিত। গাজা যুদ্ধ নিয়ে নিশ্চুপ সেলিব্রেটিদের ব্লক করার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা। বিখ্যাত ব্যক্তিরা যদি কোনও পদক্ষেপ না নেন তাহলে তাদের কাছ থেকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে এই প্রতিবাদে। তারা মনে করছেন এই সেলিব্রেটিরা যুদ্ধবিরতির আহ্বান নিয়ে সামনে আসতে পারেন।
গত কয়েকদিনের পর্যালোচনা থেকে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, গ্যাল গ্যাদত, জেন্ডায়া, কিম কারদাশিয়ান এবং কাইলি জেনারের মতো বিপুল সংখ্যক ফলোয়ার থাকা সেলিব্রেটিরা ব্লকের শীর্ষে রয়েছেন। জাস্টিন বিবার, টেলর সুইফ্ট এবং সেলেনা গোমেজসহ সেলিব্রেটিরা এই বছর মেট গালায় অংশ নেননি। তবে ব্লকআউট তালিকায় তারাও রয়েছেন। লিজো ও প্রভাবশালী ক্রিস ওলসেনসহ ব্যাপকভাবে প্রচারিত ব্লক তালিকায় থাকা বেশ কয়েকজন তারকা প্রথমবারের ভিডিও পোস্ট করেছেন যাতে ফিলিস্তিনিদের সহযোগিতাকারী সংস্থাগুলোকে অনুদান দেওয়ার জন্য ফলোয়াদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তবে এই ব্লকআউট সফল নাকি ব্যর্থ সেই আলাপও চলছে তুমুলভাবে। টিকটকে ফিলিস্তিনপন্থি অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যাক্টিভিজমের সফলতা বা ব্যর্থতা এভাবে বিচার করা যায় না। হাজারো বা লাখো ফলোয়ারকে হারিয়ে সেলিব্রেটিরা অবশ্যই বুঝতে পারবেন কেন তারা ফলোয়ার হারালেন এবং মানবতার পক্ষে তাদের কী করার ছিল, যা তারা করেননি।
ব্লকআউট শুরু হয়েছে খুব বেশিদিন হয়নি। কোনও নির্দিষ্ট সেলিব্রেটিকে ঠিক কতজন ফলোয়ার ব্লক করেছেন সেই তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া যায়নি। তবে অনেকে ফলোয়ার হারাতে শুরু করেছেন।
শনিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআর এক খবরে জানিয়েছে, গত সপ্তাহে টিকটকে প্রায় ৩ লাখ ও ইনস্টাগ্রামে প্রায় ৫০ হাজার ফলোয়ার হারিয়েছেন টেলর সুইফট।