এরপর কী হলো? ঠিকঠাক যত্ন না পেয়ে মঞ্জুশ্রী জন্মালো অসুস্থ হয়ে। বেকার বাপের মেয়েকে কে ডাক্তার দেখায় কে দেয় পথ্য। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখ, সরু হাত-পা আর বড় একটা পেট কী যে খারাপ ছিল দেখতে। আমাদের দু’জনেরই মন খারাপ হলো কিন্তু প্রতিক্রিয়া হলো দু’রকম। আমার কেবলই রাগ, যন্ত্রণাকাতরতা আর তোমার দাদার বুক চাপা ব্যথা, নিজেকে অপরাধী ভাবা। মেয়ের সৌন্দর্যহীনতার জন্যে নিজেকেই দায়ী করতো সে। শুধু মঞ্জু নয় আমাদের দুটি সন্তানেরই সৌন্দর্যহীনতা আর অসুস্থতা অর্থাৎ মঞ্জু আর রঞ্জু দুজনেরই উচ্চ ডায়াবেটিকস, মঞ্জুর অস্থির স্বভাব এবং রঞ্জুর মানসিক অসামঞ্জস্য তোমার দাদার কাছ থেকেই পাওয়া এ আমিও মনে করি।
আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম এই যে বেকারত্বের কারণে ঘরে-বাইরে তার এতো অবমূল্যায়ন, আমার অশান্তি, মেয়ের দুর্দশা তাতে যেকোনো পুরুষ আরও যে কিনা সন্তানের বাবা তার তো হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজার কথা অথচ তোমার দাদার কোনো হেলদোল নেই! সে মগ্ন হয়ে পড়ছে, লিখছে আবার বলছে যে লেখককে চাকরিতে সময় নষ্ট করতে হয় এ নাকি নিদারুণ অপচয়! তোমার দাদা হৃদয়ের শুদ্ধতার চর্চা করেন, কবিতা লিখে মহত্ত্বের সাধনা করেন, বাংলাদেশের স্কুলকলেজের শিক্ষাদান পদ্ধতির সমালোচনা করেন। আমি মানি তার কথা সত্যি কিন্তু সেরকম দুরবস্থায় তো সায় দেয়া সম্ভব ছিল না। কী যে অসহায় লাগতো তখন আর কী ভয়ংকর রাগ হতো ঈশ্বরের ওপর সারা বিশ্বের ওপর। আমি যেন মা কালী আমার কোপে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাক চাইতাম। অভিশাপ দিতাম যারা আমার সাথে এই প্রবঞ্চনা করেছে তাদের। এত ধকল আমি আর নিতে পারছিলাম না। রাগ করে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকতাম, আত্মহত্যার কথা ভাবতাম। এই সময় আমার স্বাস্থ্যও ভাঙল। আত্মহত্যা করার কথা ভাবা ছাড়া আর কিছুই যেন ভাবতে পারতাম না! তুমি হলে কী করতে শোভনা? খুব সেবা শুশ্রূষা করে সবাইকে স্বর্গসুখে রাখতে বুঝি? হা হা আমি আন্দাজ করি তুমি সব বুঝেই কেটে পড়েছ।
শোভনা, একটানা পাঁচ বছর তোমার দাদা বেকার ছিল। আগেই বলেছি আমার পড়ায় ছেদ পড়েছিল সেইসাথে অনিচ্ছাকৃত মাতৃত্ব আমাকে পাগলপ্রায় করে রাখতো। মঞ্জুটা সবসময় ভুগতো তাই জ্বালাতোও খুব। রাতভর ঘুমাতে পারতাম না। মেয়েকে ভালো একটু খাবার দিতে পারতাম না। আবদার মেটাতে পারতাম না। কান্না জুড়লে মাঝেমধ্যেই দুমদাম মেরে নিজেই কাঁদতে বসতাম। তারপর নিজেকে শাস্তি দিতে উপোস। এভাবে আমার স্বাস্থ্যও ভাঙতে শুরু করে। গ্রামের মানুষ বলতো সূতিকা। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিলাম। এসব নিয়ে বাড়িতে তখন চরম অশান্তি। শাশুড়ি রাগারাগি করেন, তোমার দাদা আরও নীরব হয়ে যান, উপেক্ষা করেন। সম্পূর্ণ আশ্রয়হীন আমি।
অসুস্থ মঞ্জুর চিকিৎসা করাতে পারি না, সারারাত ওকে নিয়ে জাগা, গুচ্ছের কাপড়চোপড় ধোয়া, রান্নাবান্না, এতবড় সংসারের পরাধীন বউ হয়ে থাকার পরেও স্বপ্ন দেখি, সংসারের হাল ধরতে হবে একটা চাকরি করতে হবে। এই জেদে পড়াশোনায় মাথা গুঁজে রাখি। অবশ্য সেই সময়ই লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়া গেল। লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম বইপত্রে ডুব দিতে পেরে কিছুটা বাঁচলাম।
যদিও প্রিপারেশন ভালো না হওয়ায় অসুস্থতার অজুহাতে পরীক্ষা ড্রপ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অধ্যাপক হেমচন্দ্র ঘোষ বাঁধা দিলেন। তিনি তোমার দাদাকেও ডেকে এনেছিলেন আমাকে আরও শক্তভাবে বাঁধা দেয়ার জন্য। তোমার দাদা কিন্তু বাঁধা দেননি। উলটো বললেন শরীর বেশি খারাপ লাগলে বাড়ি চলে যাওয়াই উচিত। কিন্তু অধ্যাপক হেমচন্দ্র আমাকে ভালোবাসতেন। তিনি কিছুতেই মানলেন না। চটে গিয়ে আরও গোঁ ধরে আমাকে পরীক্ষা দিতেই হবে স্থির করলেন। সত্যি কথা বলতে অধ্যাপক হেমচন্দ্র আমাকে পরীক্ষা দিতে রাজি করাতে পেরেছিলেন শুধু তার গোঁ এর কারণে নয় আমারও গোঁ তৈরি হলো যখন তোমার দাদা বাড়ি চলে যাওয়ার পক্ষে মত দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল তখনই। আমি দেখতে পেয়েছিলাম ঠোঁটের কোণে তার তাচ্ছিল্য। সব সময়েই তিনি আমাকে পাখির ছানার মতো দুর্বল, কৃমিকীটের মতো পরজীবী ভাবতেন।
আমি যে ফেল করব এ বিষয়ে তোমার দাদা একেবারে নিশ্চিত ছিলেন। সান্ত্বনার মতো করে বলেওছিলেন আমি তো ক্লাস করতে পারিনি, পড়ালেখা করার অবকাশও পাইনি ফেল করাই স্বাভাবিক তাই মন যেন খারাপ না করি। এদিকে আমার পাশের খবর পত্রিকাতেও ছাপা হলো। বুঝলে ননদিনি, পাঁচ বছরের কন্যা লইয়া বিএ পাশ করিয়া আমি ইতিহাস স্থাপন করিয়াছিলাম।
নিজেকে তো জানি, জেনেই বলছি তোমার দাদার এই একচ্ছত্র প্রেম তোমাকে না দিয়ে আমাকে দিলে আমাদের দাম্পত্য ব্যর্থ হতো না। আমি হচ্ছি জীবনবাদী মানুষ। ভলোবাসাহীন অভাবের সংসারকেও আমি ভরে তুলেছিলাম। যখন বুঝেছি তোমার দাদার অর্থ উপার্জনে মতি নেই তখন ভগ্ন মন ভগ্ন স্বাস্থ্য আর রক্ষণশীল সমাজ-সংসারের হাজারটা জটিলতা ডিঙিয়ে পড়ায় মন দিয়েছি।
এখনো তোমার দাদার গবেষক নামক স্তাবকেরা বলে তুমি তাকে ত্যাগ করলে বলেই তোমাকে ভুলতে বেশ্যাবাড়ি, তোমাকে ভুলতে হঠাৎ বিয়ে তবু তোমাকে ভুলতে পারেনি। যেখানেই তুমি গেছো ছুটে ছুটে গেছে সে। ডায়েরির পাতায় পাতায় তুমি। তোমাকে নিয়ে টানাপড়েন, তোমাকে নিয়ে উত্তেজনাকর স্বপ্ন, তোমার সাথে দেখা করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা। পরিবারের বাঁধা মানার মানুষ সে ছিল না। আমিও মানি তুমি আগ্রহী হলে ঠিকই বিয়ে হতো তোমাদের। বাবা মা তাকে ঠেকাতে পারতো না। অবশ্য এ আমি তোমাকে বলছি কেন। এ যে মার কাছে মাসির গল্পের মতো শোনাচ্ছে। তোমার চেয়ে বেশি কে জানে তাকে! আচ্ছা তুমি বা তোমরা কখনো খ্রিষ্টান হবার কথা ভেবেছিলে নাকি? তিনি তো খুবই ভক্ত ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মের। হিন্দু ধর্মও যে খুব অপছন্দ ছিল তা না। আবার হিন্দু, বৌদ্ধ কোনো ধর্মেরই অনুরক্ত সে ছিল না। এমনকি ঈশ্বর বিশ্বাসীও তো সে ছিল না। তবে ব্রাহ্ম ধর্ম বেশ খানিকটা অপছন্দ ছিল। ব্রাহ্ম ধর্মের নীতির বাড়াবাড়ি মোটেও পছন্দ করতো না। এতোটাই বিরূপ ছিল যে আমার শাশুড়ি অনেকবার বলার পরেও রাজা রামমোহন রায় বা দেবেন্দ্রনাথকে নিয়ে কবিতা লেখেনি, লিখেছে চিত্তরঞ্জন দাশকে নিয়ে। তিনজনই ব্রাহ্ম তবে প্রথম দুজন গোড়া আর তৃতীয়জন উদারমনস্ক। চিত্তরঞ্জন দাশকে মানুষ হিসেবেই সে পছন্দ করেছিল ব্রাহ্ম ধর্মের সেবক হিসেবে নয়। তোমার দাদা তো খুবই মা ভক্ত ছেলে ছিল। বাবা-মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকার পরেও তাদের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অটল থাকা, তাদের নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করতে পারা সেই সময়ের মানসিকতায় খুবই ব্যতিক্রম।
আমার ধারণা ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি এত যে বিরূপতা সেও তোমাকে কেন্দ্র করেই। তোমাদের সম্পর্কে নৈতিকতার প্রসঙ্গ তুলে থাকবেন কাকা কাকীমা এমন কী তুমিও তাকে প্রত্যাখ্যানের কারণ হিসেবে ধর্মের দোহাই দিয়ে থাকবে। ব্রাহ্ম ধর্মে তো নৈতিকতার খুব বাড়াবাড়ি। আর আমার শ্বশুর মশাই শাশুড়ি মা’ও ব্রাহ্মধর্মের বড় সেবক। পরিবারের মানুষদের প্রতি বড় রকমের বিরক্তি তার ছিল বিয়ের আগ পর্যন্ত। বিয়ের পরেও ছিল তবে তখন আমার প্রতি তার শত্রুতা অন্য যারা আমার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন তাদেরকে তার কাছাকাছি করতে পেরেছিল।