X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঠান্ডা মার্বেল

মোহাম্মদ নূরুল হক
০৭ জুলাই ২০২২, ১৫:২৬আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২২, ১৫:২৬

পঙ্কজ মল্লিক ঘরে ঢুকতেই অক্টোপাসের মতো অস্বস্তি এসে তাকে গ্রাস করে। নিত্য আসা রাধার বাড়িকে আজ তার অচেনা মনে হয়। মাথার ওপর নিয়ে একটি মাছি ভনভন করে উড়ে গেল। পঙ্কজের মনে হলো নরকাসুর বধের আগে কৃষ্ণ যে শঙ্খ বাজিয়েছিল, আজ তারই নাদ ভেসে এলো। এই বুঝি মহাপ্রলয় শুরু হবে, আর তার প্রাণটাও প্রজাপতির মতো স্বর্গের দিকে উড়াল দেবে! তার অস্বস্তি যত পারদের মতো বাড়তে থাকে, রাধাকে দেখার অপেক্ষার পালাও তত দীর্ঘ হতে থাকে। যে আগ্রহ নিয়ে পঙ্কজ রাধার বাড়িতে এলো, সেই থরোথরো আবেগের আগুনে যেন বরফ ঢেলে দিলো কেউ। 
একটা তপ্ত-দীর্ঘশ্বাস পঙ্কজের নাভির গভীর থেকে বের হতে হতেও বাইরের হাওয়ায় এলো না। এতে তার অস্বস্তি আরও বাড়তে থাকে। ধপাস করে বসে পড়ে সোপায়। এমনই একদিনের কথা মনে পড়ে তার। সবাই ছুটছে প্ল্যাটফর্মে। উত্তরা থেকে কমলাপুরগামী ট্রেন ছেড়ে দেবে। দ্রুত উঠতে হবে তাকেও। পঙ্কজও দৌড়ে উঠে গেল নির্ধারিত কোচে। কিন্তু তার জন্য বরাদ্দ সিট নম্বরে আগে থেকেই একজন বসা। তারও টিকিটে একই সিট নম্বর লেখা। পঙ্কজ পথের ভ্রমণে ক্লান্ত। তাই তর্ক করে না। চুপচাপ হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই চোখে জল নেই, আগুন জ্বলছে। চুল উসকো-খুসকো। চেহারায় বদরাগি ভাব। এই বুঝি কারও ওপর হঠাৎ চটে যাবে। কাঁধে ব্যাগ। ঝুলছে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে পঙ্কজ যত দোলে, তারও দ্বিগুণ দোলে কাঁধের ব্যাগ। সেই ব্যাগ মাঝে মাঝে পেছনের সিটে বসা অল্পবয়সী এক তরুণীর খোঁপায় আঘাত করে। তরুণী বারকয়েক ব্যাগটি দূরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। কিন্তু কত আর সহ্য করা যায়! তাই সে ক্ষেপে ওঠে। নিচু অথচ দৃঢ়কণ্ঠ তার, এই যে মিস্টার! কী শুরু করেছেন, বলুন তো? আপনার ব্যাগ সামলান। 
সেই মিহি নারীকণ্ঠও পঙ্কজের কানে কর্কশ ঠেকে। চমকে ওঠে সে। ফিরে তাকায়। দেখে তরুণীর চোখে গনগনে আগুন। সেই আগুনচোখা তরুণীও হঠাৎ ব্রেককষা দুরন্ত ট্রেনের মতো থমকে যায় পঙ্কজের কোটরাগত চোখ দেখে। যে তেজ ও বিরক্তি নিয়ে তরুণীটি পঙ্কজের উদ্দেশে হুঙ্কার ছেড়েছিল, সেটা মুহূর্তেই কোমল স্বরে পরিণত হলো। সেখানে বিরক্তির পরিবর্তে ঝরে পড়ল করুণা, দয়া। পঙ্কজের দিকে না তাকিয়ে মেঝের দিকে চোখ রেখে তরুণী বলে, এই যে শুনুন, এই সিটেই বসুন। কথাগুলো বলতে বলতে তরুণী আরেকটু সরে বসে। পঙ্কজ বসবে কি না, ইতস্তত করে। ভাবতে ভাবতে তার মনে হলো এবার মেয়েটি তাকে ধমক দিচ্ছে, কী হলো আপনার? বসছেন না কেন? কথা ক’টি তার কাছে ধমক মনে হলো বটে, কিন্তু মুহূর্তেই সে তাকাল মেয়েটির দিকে। নাহ! মেয়েটি তার দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে, তাতে মনে হয় না, সেখানের ধমকের আভাস আছে। বরং এক ধরনের প্রশ্রয় আছে। সেই প্রশ্রয়ে আশ্রয়ের ইঙ্গিতও আছে। 
পঙ্কজ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কিছুটা শারীরিক ক্লান্তি, কিছুটা মানসিক অবসাদ; আর কিছুটা তরুণীর আহ্বানে হয়ে পড়ে দুর্বল। শেষমেষ তরুণীর পাশেই বসে পড়ে। বসে সত্য, কিন্তু তখনই কথা হয় না তাদের। কে আগে কথা বলবে? পঙ্কজ ভাবে—সে আগবাড়িয়ে কী বলবে, কিন্তু কেন বলবে, আচ্ছা মেয়েটা কী ভাবছে তার সম্পর্কে? তার মনে হলো অন্তত নামটা জানতে চাওয়া উচিত। মুখ দিয়ে বের করতে যাবে মাত্র, এমন সময় তরুণী বলে, আমি রাধা। আপনার নাম? চমকে ওঠে পঙ্কজ, তার মনের কথা কিভাবে জেনে ফেলল? তবে কি অবচেতনে মুখ ফসকে প্রশ্ন বেরিয়ে গেল? কিন্তু প্রশ্ন সরব বা নীরব যা-ই হোক, উত্তর দেওয়া তো দরকার। তাই সে সরবেই বলে, পঙ্কজ। 
রাধা এবার মুচকি হাসে, আপনি কোথায় যাবেন?
—মতিঝিল। একটা ব্যাংকে ইন্টারভিউ আছে।
—ও আচ্ছা।
কথা এটুকুই। একসময় তাদের বলার মতো কথা আর থাকে না। চৈত্রের চৌচির হয়ে যাওয়া নদীতীরের মতো মনের মাঠও যেন ধু-ধু করে। কোথাও কিছুই নেই। কেবল দক্ষিণ দিক থেকে যেমন হুহু করে তেড়ে আসে খোলা হাওয়া, সে হাওয়া যেমন শ্রাবণের শেষাশেষি ধানখেতে ঢেউ তুলে হারিয়ে যায়, তেমনি তাদের মনেও এক ধরনের বাতাস বয়ে যায়। কিন্তু সে বাতাসে কী উড়ে যায়, কী উড়ে আসে—তা বোধ হয় অন্তর্যামীও জানেন না। 
কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেন এসে থামে। কে কার আগে নামবে, তাই নিয়ে হুলুস্থুল। পঙ্কজ প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়ায়। কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে ট্রেনের দরোজার দিকে তাকায়। নাহ! রাধাকে কোথাও দেখা যায় না। রাধা কী করে, তাও জানা হলো না। মনের ভেতর সেই না জানার কাঁটা খচ খচ করে।
 
০২.
যথাসময়ে ইন্টারভিউ শেষ। মামা-চাচা ধরলেই চাকরি হয়ে যাবে। পঙ্কজ মোটামুটি নিশ্চিত। জগতে স্বার্থহীনভাবে কে কার জন্য সুপারিশ করে, এই ভাবনাই আসন্ন কালবৈশাখীর ঝড়ের আগের কালো মেঘের মতো তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ভাবে, কী আছে তার? বাহুবল, অর্থবল, জনবল—এই তিনের কোনোটাই নেই। তাহলে তার সমাজে সফল হওয়ার উপায় কী? মনে মনে বলে—বাহুবল, অর্থবল, জনবল—এই তিন বলের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কিন্তু মনোবল যদি না থাকে ওই তিন বল কিছুই করতে পারে না। প্রথমোক্ত তিন বল ছাড়াই কেবল মনোবলের জোরেই অনেক অসাধ্যকে সাধন করা সম্ভব। অতএব মনোবল বাড়াতে হবে। মনোবল হারালে চলবে না। পঙ্কজ ঘাটে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে পথে পথে হেঁটে হেঁটে মানুষের অবজ্ঞা-অপমান সহে সহে বুঝতে পেরেছে শিক্ষাগত যোগ্যতা, মেধাই আসল নয়। আসল হলো অন্য কিছু। সেই অন্যকিছুই মামা-চাচার খুঁটির জোর। সেই জোরটাই তার নেই। তবে, তার মনে হয়, মনোবল থাকলে মামা-চাচার অভাব হবে না। যেই ভাবনা সেই কাজ। হঠাৎ মনে পড়ে আব্দুল সালাম নামের এক ব্যাংকারের কথা। অনেক বছর আগে বাজার অর্থনীতিবিষয়ক এক সেমিনারে তার সঙ্গে দেখা-পরিচয়। তিনি বলেছিলেন, ব্যাংকে চাকরি করতে চাইলে তার ‘হেল্প’ পাওয়া যাবে। আজ তার হেল্প চাইলে কেমন হয়! 
সালাম সাহেবের রুমে ঢুকতেই তিনি হেসে উঠলেন—কেমন আছেন? কী করছেন এখন?
—ব্যাংকে চাকরির ইন্টারভিউ দিলাম। আপনার সাহায্য চাই।
—কী করতে হবে আমাকে?
পঙ্কজ মাথা নিচু করে বসে থাকে। বুঝতে পারে না সালাম সাহেবকে কী বলবে, আদতেই তার কী ধরনের হেল্প দরকার। তার নীরবতা দেখে আব্দুস সালামই কথা বলেন, দেখুন, আপনাকে ঠিক করতে হবে আপনি আসলে কী চান, কী ধরনের হেল্প চান। আপনি যদি আপনার চাওয়া কী, তা ঠিক করতে না পারেন, দাতা কী দেবেন, সেটাও তো তিনি বুঝতে পারবেন না। তাই আপনাকেই পরিষ্কার করতে হবে।
—জি। বুঝতে পারছি। কিন্তু কিভাবে যে আপনাকে বলবো, বুঝতে পারছি না।
—না। এভাবে বললে হবে না। আপনাকে আগে বুঝতে হবে। এরপর কিছুক্ষণ পঙ্কজের দিকে তাকিয়ে থাকেন সালাম। পঙ্কজের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা। সেই ফোঁটা পড়ার চেষ্টা করেন। সেখানে বিন্দু বিন্দু ফোঁটার ভেতর একজন বেকারের দীর্ঘশ্বাস, স্বপ্ন, বিব্রতবোধ, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া দেখেন। কিন্তু তিনি কী বুঝলেন, সেটা বুঝতে দেন না। বরং প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলেন, কী খাবেন? 
—খেয়ে এসেছি।
—হুম। এরপর দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সালাম সাহেব বলেন, খেয়ে এলেও হোস্টের সম্মানে আবারও খেতে হয়। চলুন আমার খাবারের সময় হয়েছে। চলুন। 
এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন পঙ্কজের পাশে। তার হাত ধরে টান দিলেন। পঙ্কজ আর সম্মোহিতের মতো সালাম সাহেবের পেছন পেছন হেঁটে চলে। আতিথেয়তার কারণ বুঝতে চেষ্টা করে। মনে পড়ে কিছু দিন আগে চাকরি চাইতে একটি করপোরেট অফিসে গিয়েছিল পঙ্কজ। সেখানে বড়কর্তা তাকে খুব যত্ন করে খাইয়েছেন। সে খুব ক্ষুধার্ত ছিল। বড়কর্তার খাবার শেষ হওয়ার আগেই পঙ্কজ গোগ্রাসে নিজের খাবার শেষ করে ফেলেছিল। বড় কর্তা তার খাওয়ার দৃশ্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন। একসময় নিজের খাবার শেষ না করেই হাত মুছে উঠে দুই কাপ কফি অর্ডার করেছিলেন। বিদায় বেলা তাকে ৫০০ টাকা হাতে দিয়ে বলেছিলেন, পঙ্কজ সাহেব, আমাদের লোক নিয়োগ হবে। আমরা একটু ভিন্ন ধরনের লোক চাই। আপনার করার মতো কাজের স্কোপ হলে খবর দেবো। 
পঙ্কজ ভগ্নহৃদয়ে সেদিন সেই করপোরেট অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আজ সালাম সাহেবও ভিষণ আন্তরিকতার সঙ্গে আতিথিয়তা দেখাচ্ছেন। কী জানি, আজও বিফল হতে হয় কি না। তার ভাবনার জাল পুকুর থেকে দিঘি, নদী থেকে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে, কিন্তু কোনো মাছ উঠে আসে না তাতে। শূন্য জাল আরও শূন্য করে আকাশও কালো মেঘে ছেয়ে যায়। তবু ভাবনার আকাশে ঝড়শেষের বৃষ্টি নামে না। হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে সালাম সাহেবের ডাকে, কী ব্যাপার পঙ্কজ সাহেব! শুরু করুন। কী ভাবছেন?
পুরো খাওয়ার সময়ও পঙ্কজ কী চায়, তা পরিষ্কার করতে পারলো না। এতে সালাম সাহেব হয়তো কিছুটা বিরক্ত হলেন। মনে মনে ভাবলেন, যে ছেলে কী চায়, তা-ই পরিষ্কার করতে পারে না, তাকে হেল্প করি কী করে? এবার নিজে থেকেই বললেন, দেখুন, আপনি কী ধরনের হেল্প চান, তা বলছেন না। আপনি যদি পরিষ্কার করে বলতে না পারেন, আমি কেন, কেউই আপনাকে হেল্প করতে পারবে না। 
পঙ্কজের মাথা নিচু। নিরুত্তর। যেন সাহায্য চাইতে এসে আরেকটা ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হয়েছে সে। যেন কুরুক্ষেত্রে কৌরবদের চক্রব্যুহ ভেদ করে অভিমন্যুর মতো হঠাৎই ঢুকে পড়েছে পঙ্কজ, কিন্তু ঢুকতেই বুঝতে পারে, সে এক চক্রব্যুহ ভেদ করে আরেক চক্রব্যুহে এসে পড়ল। এখন বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। কী করবে, বুঝে উঠতে পারে না। আবার কথা বলেন সালাম সাহেব।
—শুনুন পঙ্কজ সাহেব। আমার কাছে এসেছেন, আপনাকে শূন্য হাতে যেতে দিতে পারি না। আমি সরাসরিই বলি আপনাকে, হেল্প বলতে আমি টাকা ধার দিতে পারব না।
পঙ্কজ লজ্জায় কী অপমানে কী সংকোচে জড়োসড়ো হয়ে বসে। জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে, স্যার, টাকা ধার চাইতে আসিনি। 
—তো?
—আপনার সুপারিশ দরকার।
—সেই কথা তো বলবেন। ওকে। বসুন। দেখি কী করা যায়। 
পঙ্কজকে বসিয়ে রেখে কয়েক জায়গায় কল দিলেন সালাম সাহেব। কাকে কী বললেন, পঙ্কজ কিছুই বুঝতে পারলো না। কেবল স্ট্যাচুর মতো বসে থাকলো। তাকে পাথরের মতো বসে থাকতে দেখে সালাম সাহেব বললেন, আপনার কি তাড়া আছে? তাড়া থাকলে আসতে পারেন। কাল একবার কল দেবেন আমাকে। 
এর কিছু দিন পর ব্যাংক অফিসার পদে যোগ দেয় পঙ্কজ। ম্যানেজার শফিক সাহেব তাকে এনে বসার ডেস্ক দেখিয়ে দেন। পঙ্কজ চেয়ারে বসতেই পাশ থেকে নারীকণ্ঠ—অভিনন্দন। সেদিকে তাকাতেই রাধাকে দেখে চমকে ওঠে পঙ্কজ। আরে আপনি? স্যরি সেদিন আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি। খুব টেনশানে ছিলাম। ভালো করে কথাও বলতে পারিনি।
—আরে মিস্টার, টেনশান না টেনশন। এখন কাজগুলো বুঝে নিন। ডেস্কে বসে অত কথা বলা যায় না। 
কথাগুলো শুনে পঙ্কজ দমে যায়। সে কি আসলে আনফিট। যেখানেই যায়, লোকে তাকে লেসন দেয়। তবে কি সেই কিছুই জানে না? নিজেকে ধিক্কার দেয়। লুকিয়ে তাকায় রাধার দিকে। দেখে রাধা নির্বিকার। তার দিকে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করছে না। এদিকে, ক্লাইন্টরা টাকা জমা দিতে এসেছেন। লম্বা সিরিয়াল। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়েছে। ম্যানেজার উঠে এসেছেন, কী হলো? আপনারা কী করছেন? সার্ভিস দিচ্ছেন না কেন?
ম্যানেজারের গলা শুনে রাধা উঠে দাঁড়ায়, স্যার দেখছি। এখনই ঠিক হয়ে যাবে সব।
এরপর পঙ্কজের দিকে তাকিয়ে বলেন, কী ব্যাপার আপনি টাকা জমা নিচ্ছেন না কেন? কাজ শুরু করুন। এখন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার সময় নয়। কথা বলার সময়ও নয়। ব্যাংকে চাকরির প্রথম দিন পঙ্কজের এভাবেই গেলো।
দিন যতই যাচ্ছে, রাধার কাছে তার কাজ শেখার ফিরিস্তি ততই বাড়ছে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সিকিভাগও কর্মস্থলে এসে কাজে লাগলো না তার। কাজে লাগলো যা কিছু রাধা শেখাচ্ছে, তা-ই। ফলে দিনে দিনে রাধা-ই হয়ে উঠলো পঙ্কজের আরেক শিক্ষক। ইতোমধ্যেই দুজনের সুখ-দুঃখের কিছু কিছু বিষয়ই দুজনেই জেনেছে। যতটা জেনেছে, ততোধিক জানার বাকিও আছে। 
অফিসের সময় শেষ। একে একে সবাই বের হয়ে গেছে। ম্যানেজারের রুমে ম্যানেজার, ক্যাশে রাধা। পাশের ডেস্কে পঙ্কজ। উঠবে উঠবে করেও পঙ্কজ ওঠে না। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এবার বাসায় যেতে হবে। রাধার সামনে এসে দাঁড়ায় সে—কী ব্যাপার? আপনি বের হবেন না?
—না।
—কেন?
—ম্যানেজার বলেছেন জরুরি মিটিং আছে।
—কিসের মিটিং? কই আমরা তো কিছু জানি না।
—আমিও জানি না। আমাকে বলেছেন থাকতে। 
কথাগুলো বলে অসহায় ভঙ্গিতে পঙ্কজের দিকে তাকায় রাধা। পঙ্কজ প্রমাদ গোনে। আর রাধা বোঝার চেষ্টা করে, পঙ্কজ কী মনে করলো! পঙ্কজ এবার রাধার খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। বলে, মিটিংয়ের এজেন্ডা যা-ই থাকুক, আপনার সামনে দুটা পথ খোলা। নাম্বার ওয়ান, আপনি যতক্ষণ থাকবেন, আমিও থাকবো ততক্ষণ। নাম্বার দুই, আপনি এখনই বের হয়ে যাবেন। বলবেন, শরীর প্রচণ্ড খারাপ লাগছে। আপনার পিরিয়ড শুরু হয়েছে। বসে থাকতে পারছেন না। মাথা ঘুরছে। কথাগুলো বলেই পঙ্কজ অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। 
পিরিয়ড শব্দটা শোনা মাত্রই রাধার গা রি-রি করে ওঠে। পুরুষ মানুষ এত জঘন্য। কত সহজে তারা পিরিয়ডের মতো সংবেদনশীল শব্দও মুখে উচ্চারণ করতে পারে! আবার ভাবে—পঙ্কজ তো কোনোদিন কোনো আপত্তিকর কথা বলেনি। আজ সরাসরি এভাবে বললো কেন, ভাবনার অতল সাগরে ডুবে যায় রাধা। কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। দুই হাতে মাথা চিপে ধরে টেবিলের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। পঙ্কজের দৃষ্টি এড়ায় না বিষয়টি। রাধাকে নির্বিকার দেখে এগিয়ে আসে, কী হলো ম্যাডাম? আপনার সিদ্ধান্ত কী? আমি থাকবো, না আপনি পিরিয়ডের কথা বলে বের হয়ে যাবেন? আমি বুঝতে পারছি আজ কী হতে পারে।
—কী বুঝেছেন? আমিও কিছুটা আঁচ করেছি। কিন্তু কী করবো, তার কথামতো না থাকলে কাল আমার চাকরি থাকবে না। 
—তার কথা শুনতে হবে মানে কী? তার কথা না শুনলে চাকরি থাকবে না মানে? চাকরি কি তার হাতে?
—আপনি বুঝবেন না। আমার নিজের বোকামির কারণেই জিম্মি হয়ে পড়েছি।
—কী বোকামি?
—পরে একদিন বলব।
পঙ্কজ জানার জন্য আর পীড়াপীড়ি করে না। বরং বলে, একদিন শুনবো নে। আজ উঠুন।
রাধা খুব ধীরে উঠে দাঁড়ায়। এরপর ম্যানেজারের রুমে যায়। মিনিট দুয়েক পর বের হয়ে আসে। বলে, পঙ্কজ বাবু চলুন বের হই। 
দুজনেই বের হবে—এমন সময় ম্যানেজারের গলা ভেসে আসে, এভাবে চললে কাজ করা কঠিন হবে। যে যারমতো করে আসবে-যাবে, আমার কথা শুনবে না। পাখা গজিয়েছে। এরপরের কথাগুলো আর শোনা যায় না। রাধা-পঙ্কজ দুজনেই বের হয়ে যায়। একইদিকে দুজনের পথ। দুজনেই উত্তরা যাবে। কিন্তু একই গাড়িতে কখনোই ওঠে না। আজও নয়। কেউ হয়তো ট্রেনে যায়, কেউ হয়তো বাসে। আজ দুজনেই বাসে গেলো। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন গাড়িতে।
 
০৩. 
বেশ কয়দিন হলো রাধা অফিসে আসে না। পঙ্কজের কলও রিসিভ করে না। সে যেন জলের ঘূর্ণির ভেতর পড়ে যায়, কেবল ঘুরতে থাকে, একবার ডোবে, একবার ভাসে। তার নিশ্বাস বন্ধ হতে হতেও হয় না। সে দিব্যি বেঁচে থাকে। 
পঙ্কজের মনে হতে থাকে, এর আগে কত ইন্টারভিউ দিলাম। কোথাও চাকরি হলো না। বারবারই হতাশা গ্রাস করে করেছে। এবার সে হতাশ হবে না। মনকে বোঝায়, কোনো কারণে কোনো কাজে প্রথমে সফলতা না এলে আত্মসমালোচনায় বসা যেতে পারে। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, সেই আত্মসমালোচনা যেন আত্মপীড়নে পর্যবসিত হয়ে না যায়। আত্মসমালোচনা ব্যক্তিকে ভুলগুলো শুধরে নব উদ্যোমে কাজের শক্তি জোগায়, আত্মপীড়ন তার চলার গতি শ্লথ করে দেয়। তাই সে সম্ভাব্য ব্যর্থতার আশঙ্কা না করে, আত্মপীড়নকে এড়িয়ে চলতে চায়। নিজেকে বোঝায়, রাজ্যজয়ে সৈন্য লাগে, অস্ত্র লাগে। কিন্তু মানুষের মন জয় করতে কী লাগে? বাহুবল-অর্থবল-জনবলের বড়াই নয়, মনোবল-হৃদয়ের জোর লাগে। তাই মনোবল বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে হৃদয়ের জোর। সে প্রস্তুত হতে থাকে। 
পঙ্কজ কমলাপুর রেল স্টেশনে বসে বসে মোবাইলফোন ঘাটছে। বুঝতে পারে সামনে কেউ দাঁড়িয়ে। সে মাথা তোলে না। মোবাইলফোনের স্ক্রিন আরও চোখের সামনে তুলে ধরে। হঠাৎ নারীকণ্ঠে চমকে ওঠে, পঙ্কজ সাহেব! এখানে কী করছেন? অফিস কামাই? ঘটনা কী? চোখ তুলে দেখে সামনে রাধা। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় পঙ্কজ, আরে! আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? ফোন তোলেন না। কলও দেন না! আমার ওপর রাগ করেছেন না কি? রাধা গ্রীবা বাঁকিয়ে, ঠোঁটের কোনে নদীর তীরে চিকচিকে বালিতে যেমন ভোরের সূর্যের সোনালি রশ্মি চিকচিক করে ওঠে, তেমনি চিকন-বঙ্কিম হাসির রেখা দেখিয়ে বলে, আমাকে আপনার কিশোরী মনে হয়? আপনার ওপর রাগ করবো কেন? তার চেয়ে বড় কথা, আপনি আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো আমাকে জব্দ করতে চাইছেন? পঙ্কজ যেন এতক্ষণ ভেসে চলেছিল নিস্তরঙ্গ পুকুরে ভেলার ওপর। এবার রাধার কটাক্ষের ঝড়ো হাওয়া সেই দোলাহীন ভেলাকে প্রবল ধাক্কায় যেন উল্টে দিতে চাইলো। দক্ষ মাঝির মতো শক্তহাতে টাল সামলে নিলো পঙ্কজ। মৃদু হেসে বললো, অফিসে যাওয়ার এখনো অনেক সময় বাকি। চলুন, কোথাও এককাপ কফি খাওয়া যাক। 
কফিশপে বসে রাধা মৃদু হাসে। সেই হাসির অর্থ ধরতে পারে না পঙ্কজ। তাই জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রাধাই কথা শুরু করে, কফির অফারের মানে জানেন? কফি কিংবা চা, দুটিই পানীয়। কথা বলতে বলতে সময় কাটানোর জন্য কিংবা নিজের ভেতর চাঙাভাব আনার জন্যই সে কফি-চা খায়। কাউকে অফার করলেও এর ভিন্ন কোনো কারণ সে কখনো খুঁজে দেখেনি। তাই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। রাধা নিজেই বলে, ফরাসিরা কারও প্রেমে পড়লে তাকে কফি অফার করে। কথা কটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে পঙ্কজের পুরো শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। সে এমনভাবে চাইলো, তাতে রাধার লজ্জায় কান গরম হয়ে এলো। পঙ্কজ বললো, তাই বুঝি? জবাবে শুধু চোখের পাতা নড়লো, দুটি ছলছল চোখ পঙ্কজের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকলো। কী কথা বলতে এসেছিল কফিশপে, সেই সব ভুলে গেছে পঙ্কজ। কফি খাওয়া শেষ। পঙ্কজই বলে, অফিসের সময় হয়ে এলো। চলুন, যাওয়া যাক। রাধার যেন ওঠার ইচ্ছাই নেই, তবু উঠতে হলো। 

০৪
অফিসে ঢুকতেই সহকর্মীরা পঙ্কজকে ঘিরে মেতে ওঠে। পঙ্কজ সাহেব, মিষ্টি খাওয়ান। কিসের মিষ্টি—পঙ্কজ যেন আকাশ থেকে পড়ে। এবার ম্যানেজার তার রুম থেকে বের হয়ে আসে, আপনার প্রমোশন হয়েছে। আসুন, আমার রুমে। ম্যানেজারের রুম থেকে এসে নিজের ডেস্কে বসতেই রাধা এসে সামনে দাঁড়ায়, অভিনন্দন! জবাবে কী বলবে, বুঝতে পারে না পঙ্কজ। রাধা কিছুটা বিব্রত হয়ে নিজের ডেস্কে বসে। দুপুরে খেতে বসে একসঙ্গে। পঙ্কজকে বলে, ম্যানেজার আজ কী বলেছেন, জানেন? 
—কী?
—বলেছেন, অফিস শেষে তার সঙ্গে যেন মাওয়া যাই। ইলিশ খেতে।
—যাবেন?
—কী করবো বলুন। 
—গেলে সমস্যা কী?
এবার রাধার চোখে জল আসে। অভিমানে প্রায় কেঁদে দেয়, আপনি জানেন না? ম্যানেজার আমাকে কিভাবে চায়, কেন এমন করে? পঙ্কজের মনে পড়ে। বলে, আপনার কোনো এক বোকামির কারণে ম্যানেজার সুযোগ নিতে চায়, সেটা বলেছিলেন। কিন্তু ঘটনা কী, তা বলেননি। এখন বলবেন?
রাধা বলে, স্বামীর সঙ্গে বনিবনা নেই। বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। একবছরও সুখের সংসার হয়নি। নিত্য ঝগড়া। স্বামী গায়ে হাত তুলতো। তার আঘাত চোখেমুখে লেগে থাকতো। একদিন ম্যানেজার সেই আঘাত দেখে জানতে চেয়েছিলেন। তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল রাধা। ওই সময় পুরো ঘটনা খুলে বলেছিল ম্যানেজারকে। তখনই ম্যানেজার যেন বনের শিকার হরিণকে নিজের থাবার মধ্যে পেলেন। প্রথমে মাথায় হাত বোলালেন, এরপর পিঠে। এরপর…। না আর রাধা বলতে পারে না। একঝটকায় ম্যানেজারের হাত থেকে মুক্ত হয়ে নিজের ডেস্কে এসে পড়েছিল। ডেস্কে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল দীর্ঘক্ষণ। ম্যানেজার তার আচরণের জন্য ক্ষমা পর্যন্ত চায়নি আজও। আর প্রায় সংসারের সেই অশান্তির প্রসঙ্গ টেনে, গলায় সমবেদনার মদ ঢেলে তার সঙ্গে লংড্রাইভে যেতে বলে। বিভিন্ন জায়গায় ট্যুরে যেতে বলে। 
সব শুনে পঙ্কজ বলে, আপনি ভুল করেছেন। সংসারের কথা বাইরের লোককে বলতে হয় না। তাহলে সে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করবেই। ম্যানেজারও তাই করছে। দুজনের কথা বাড়তে থাকে। একসময় পঙ্কজেরও চোখ ছলছল করে ওঠে। রাধা বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে তাকায়, ও কী, আপনার আবার কী হলো? পঙ্কজও নিজের দাম্পত্য জীবনের অশান্তির কথা বলে। কিভাবে সে টাকা উপার্জনের মেশিন হয়ে পরিণত হলো, সেই বর্ণনা দেয়। ঘরে স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। সেই সংসারে মাসে মাসে তাকে টাকা দিতে হয়। ব্যস এটুকুই। সে কখনো স্ত্রীর কাছে যেতে পারে না স্বামীর অধিকার নিয়ে। স্ত্রী তাকে ডিভোর্সও দেয় না, সেও দিতে পারে না, সন্তানের মুখে দিকে চেয়ে। তার টাকায় স্ত্রী ফুর্তি করে, তার টাকায় বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে স্ত্রী তার ঘুরে, বেড়াতে যায়। স্বজনরা ডিভোর্স দিতে বলে। সে বুঝতে পারে না কী করবে! সব শুনে রাধা বলে, কিছু মনে করবেন না, আপনি একটা বলদ! পঙ্কজ, আহত হয় না। মলিন হাসে, হয়তো আপনার কথায়ই ঠিক। গত দশবছরে নিজেকে বলদই মনে হয়েছে। সর্বার্থেই।
শেষ শব্দটির মানে কী, বোধ করি রাধার বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই ভ্রূকুটি হানে পঙ্কজের দিকে, লজ্জা করে না? জবাবে পঙ্কজ বলে, সত্যের আবার লজ্জা কী, আর বলদের কাছে লজ্জার মানেটাই বা কী!

০৫.
বেশ কদিন হলো রাধা ছুটিতে। শোনা যাচ্ছে, স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে। ডিভোর্সের পর স্বামী এখন দেন-দরবার শুরু করেছে। ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে পর্যন্ত এসেছে। কিন্তু রাধার মন গলাতে পারেনি। আচ্ছা রাধার ডিভোর্সে পঙ্কজের উল্লসিত হওয়ার কী আছে, নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে সে। রাধা যদি স্বামীর সংসারে ফিরে যায়, তাতেই বা ক্ষতি কী!
ছুটির দিন। শুয়ে আছে পঙ্কজ। হঠাৎ সেলফোন বেজে ওঠে। দেখে রাধার কল। রিসিভ করতেই রাধার কণ্ঠ, ফ্রি আছেন? সোনারগাঁ-পানামসিটি ঘুরতে যাবেন? আমাকে নেবেন? কোনো কিছু না ভেবেই পঙ্কজ বলে, কোথায় আসবো বলুন? আমি হাজির হচ্ছি। দুজনই এসে দেখা করে সায়েদবাদ। এরপর প্রাইভেটকার নিয়ে সোনারগাঁ। এরপর পানামসিটি। দুজনেই ঘোরাঘুরি করে। রাধা খুব পঙ্কজের শরীরঘেঁষেই হাঁটে। একবার পা পিছলে পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়ায়। পঙ্কজ হাত বাড়ালে, সে হাত ধরে না। বলে, নো, থ্যান্কস। নারীর হাত দেখলেই ধরতে লোভ হয়, তাই না? পঙ্কজ লজ্জা পায়, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন…। তাকে কথা শেষ করতে দেয় না রাধা। বলে, হয়েছে হয়েছে ন্যাকামি করতে হবে না। বুঝি সব।

০৬
বাসায় ফিরে সারারাত রাধা ছটফট করে। পঙ্কজ কী চায়, তার চেয়ে বড় কথা সে নিজেই পঙ্কজের কাছে কী চায়? পঙ্কজ কি তাকে ভালোবাসে, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, সে কি পঙ্কজকে ভালোবেসে ফেলেনি? তাহলে কে প্রপোজ করবে? পঙ্কজ পুরুষ মানুষ, তার এত সংকোচ কিসের? এত একান্তে পেয়েও কেন প্রোপোজ করে না, তবে কি সে ভয় পায়? কিসের ভয়?
রাধা যখন আত্মসমালোচনায় ব্যস্ত, পঙ্কজের হৃদয়ে তখন তুমুল ঝড়। সেই ঝড় তাকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিচ্ছে। সে কি রাধাকে ভালোবাসে, তার ওপর ভরসা করতে চায়। রাধা নির্যাতিত, প্রতারিত, কিন্তু প্রতিবাদী সাহসী। পঙ্কজ নিজেও প্রতারিত, কিন্তু সে কি প্রতিবাদী-সাহসী? নাহ! নিজেকে সে সাহসী বলে স্বীকার করতে পারে না। নিজেকে ভীরু-কাপুরুষ মনে হয়। তবে, বুঝতে পারে, সে রাধাকে ভালোবেসে ফেলেছে। রাধা কি তাকে পছন্দ করে? তার প্রপোজ সে গ্রহণ করবে? একবার ‘না’ শোনার চেয়ে হাজার রাত অপেক্ষা করা শ্রেয়। এই মন্ত্র জপতে থাকে পঙ্কজ।

০৭.
সোনারগাঁ-পানাম সিটি থেকে ফেরার পর দুজনের দেখা নেই তিন চার দিন। তবে ফোনে-ম্যাসেঞ্জারে কথা হয়। দুজনেই যা বলে প্রকাশ করে, তারও বেশি না বলেই প্রকাশ করতে চায়। ফলে তারা নিজেদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। তারা যা চায়, তা বলে না। বলে উল্টোটা। নিজে বোঝাতে পারে না, সেটা স্বীকার করে না, প্রতিপক্ষ বোঝে না কেন, তার জন্য অনুযোগ করে। 
যত দিন যাচ্ছে, ততই ব্যথা যায় পঙ্কজ। শেষে কল দেয় রাধাকে, আপনার বাসায় আসতে চায়। আজ সন্ধ্যায়। আসবো? বাসায় থাকবেন? রাধা মৃদু ধমক দেয়, আমার বাসায় বোধ হয় আর আসেননি? পথ চেনেন না না কি? আসবেন, ভালো কথা। তার জন্য অনুমতি নিতে হবে নাকি! রাধার কথায় পঙ্কজ আরও বিব্রত হয়। কী করবে বুঝতে পারে না। 
দোদুল্যমান মন নিয়ে সে বের হয়। কলিং বেলে চাপ দিতেই রাধা এসে হাজির। ঘরে ঢুকেই ফুলের তোড়া এগিয়ে দেয় রাধার দিকে। রাধা হাত বাড়ায় না সে দিকে। টি-টেবিল দেখিয়ে ইশারায় সেখানেই রাখতে বলে। পঙ্কজ অপমানিত বোধ করে। অস্বস্তি তাকে গ্রাস করে। রাধা ভেতরে যায়। ফিরে আসে দুই কাপ কফি নিয়ে, নিন আপনার পছন্দের কফি। কফিতে চুমুক দিতে দিতে ঘামাতে থাকে পঙ্কজ। রাধার দৃষ্টি এড়ায় না। সে মুচকি মুচকি হাসে। বলে, কী ব্যাপার, তাড়া আছে নাকি? ঘামাচ্ছেন কেন? পঙ্কজ চুপ। নীরবতা ভেঙে রাধাই বলে, আজ মনে হয় জরুরি কিছু বলবেন? তা বলুন, কী বলতে এসেছেন।
—আপনি তো ফুলের তোড়া হাত দিয়েই ধরলেন না। যা বলতে এসেছি, তা বলা কি ঠিক হবে?
—ফুলের তোড়া ধরা না-ধরার সঙ্গে আপনার কথা বলার কী সম্পর্ক?
—সম্পর্ক আছে। নাহলে প্রসঙ্গ টানবো কেন?
—ঠিক আছে, ওই ফুলের তোড়া তুলে এবার দিন। আমি নেব।
পঙ্কজ ফুলের তোড়া হাতে তুলে নেয়। হাঁটু গেঁড়ে বসে রাধার সামনে। রাধা দাঁড়িয়ে। রাধা দুই হাত বাড়িয়ে দেয়। পঙ্কজের চোখে-মুখে বিজয়ীর হাসি। যেন অনন্ত তৃষ্ণার মরু পাড়ি দিয়ে এসে এখন শীতল জলের ফোয়ারায় স্নানে নেমেছে। থ্যান্ক ইউ বলে, রাধা মৃদু হাসে। সেই হাসিতে পঙ্কজ এতটাই গলে যায়, যেন গলতে গলতে পাহাড় বেয়ে ঝরনায় মিশে সমুদ্রের দিকে ছোটে। আর তখনই সে বলে, হে ঈশ্বরী, আমি তোমার প্রেমের পূজারি। আমার পূজা গ্রহণ করো। আই লাভ ইউ। 
কথাগুলো বলেই রাধার চোখের দিকে তাকায়। কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না পঙ্কজ। কারণ সেই চোখ দুটি নিষ্পৃহ, নিরাসক্ত, নিরাবেগ। সেখানে কোনো কম্পন নেই। জল নেই। যেন চোখ নয়, বরফের মতো ঠাণ্ডা দুটি মার্বেল।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা