শহরের অলিগলি, কাঠ কয়লা, ধুলোবালি—কত গল্পের সাক্ষী। গল্পরা সব পাখি হয়ে ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় দূরে। তারপর ঝড়ো হাওয়ায় ছিটকে পড়ে পথে। আহত পাখি পিষে যায় মালবাহী ট্রাকের মস্ত চাকার নিচে। খাটিয়া নিয়ে ধাবমান ট্রাকে কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে। একজন সজোরে চিৎকার করে কাঁদছে। ট্রাকের পর আসে কালো রঙের একটি পাজেরো। আটকে যায় সিগন্যালে। পাজেরোর পেছন থেকে দশ-বারো বছরের এক ছেলে উদাস ভঙ্গিতে এগুচ্ছে সামনের দিকে। শীর্ণকায় শরীর, উদোম পিঠে তেলপোড়া দাগ। পাজেরোর অর্ধনমিত গ্লাসের ফাঁক দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা লোকটার মুঠোফোন নিয়ে দৌড় দেয় সে। পালাতে পারে না। উৎসুক জনতার এলোপাথাড়ি কিলঘুষি শুরু হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। তারপর শুরু হয় এলোপাথাড়ি লাথি। ছেলেটার গগনভেদী চিৎকার। সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়ে অসহায় রক্ত। কারো করুণা হয় না? না না, এই দৃশ্য সহ্য হয় না।
সুমিত ওভারব্রিজ থেকে ঘটনাটি প্রত্যক্ষণ করছে। হাঁপিয়ে ওঠে সে। সুমিতের বয়স সাতাশ—প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য আইনে স্নাতক সম্পূর্ণ করেছে। লেখাপড়ায় কোনোদিনই ভালো ছিল না। টাকা-পয়সা খরচ করে সার্টিফিকেট আদায় করেছে ঠিকই কিন্তু এক বাক্য ইংরেজি বলতে হিমশিম খায়। কলেজ জীবনে গান গেয়ে স্টেজ মাতাতো। এলাকায় কোনো ফাংশন থাকলে সবার আগে তার ডাক পড়ত। ওইসব দিন চলে গেছে অনেক দূরে। এখন বাড়িতে তার সুন্দরী অষ্টাদশী বউ আছে। গত বছর ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার পর পারিবারিক আয়োজনে বিয়ে করে। সুমিতের তখন চাকরি ছিল। একদমই নতুন এক চামড়ার ব্যাগের কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি। লোকসানে পড়ে কোম্পানি বন্ধ আজ ছয় মাস। তাই আপাতত সে বেকার।
আগে অফিস থেকে ফেরার সময় সুমিত ওভারব্রিজে দাঁড়াত মাঝেমধ্যে। এখন অবশ্য যখন-তখন গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় ওভারব্রিজেই। দাঁড়িয়ে মানুষ দেখে, গাড়ি দেখে। বিল্ডিং, বিল্ডিংয়ের সামনে থালা হাতে শীর্ণকায় ভিখারি। দোতলায় রেস্তোরাঁ, স্বচ্ছ গ্লাস দিয়ে ঢাকা। গ্লাসের ওপাশে একটা পরিবারকে দেখছে সুমিত। উপভোগ্য দৃশ্য। সন্তানকে নিয়ে বাবা-মা খেতে এসেছে। সুমিতের শৈশবের কথা মনে পড়ে। ঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে সুমিত ও তার দুই ভাই-বোনকে মা খেতে দিয়েছে। গরম গরম ভাতের সাথে সরষে ইলিশ। ইলিশের লোভনীয় ঘ্রাণ।
সুমিতের দুপাশে তিন চারজন হকার। তাদের ঝুলিতে চশমা, মানিব্যাগ, ঝালমুড়ি। বিপরীত পাশে এক পাগল শুয়ে। তীব্র গরমেও লোকটার পরনে মোটা সোয়েটার। স্বাচ্ছন্দ্য ঘুমোচ্ছে। ভাগ্যিস, গাড়ি-ঘোড়া ওভারব্রিজে চলে না। নইলে কখন পিষে দিয়ে যেতো কোনো মালবাহী ট্রাক।
সুমিত ছোটবেলায় বন্ধু মাহির মৃত্যু দেখেছিল। সিএনজি চাপায় ওর ছোট্ট শরীর কেমন ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। সুমিতের প্রথম বন্ধু মাহি। ফুপুর বাড়িতে গেলে মাহি বাতাসে খবর পেতো। দৌড়ে আসতো দেখা করতে। তারপর তারা সারাদিন পুকুরপাড়ে বসে খেলতো। একদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সুমিত শুনলো বাবা তাকে ফুপুর বাড়ি নিয়ে যাবে। মাহির সাথে দেখা হবে সেই উৎকণ্ঠা নিয়ে সে যাত্রা করল। পৌঁছে দেখলো মাহিদের বাড়িতে উপচে পড়া ভিড়। ভিড়ের মধ্যখানে আধখোলা রক্তজমাট চোখে শুয়ে আছে মাহি। ওর সারা শরীর দুমড়ে মুচড়ে গেছে।
আজ রোদের তীব্রতা অনেক। গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। তার ফর্সা শরীর রোদে কেমন লালচে হয়ে গেছে। হাতা গোটানো কালো ফুল শার্টে সুমিতকে আরও ফর্সা দেখাচ্ছে। শার্টটা ওর সাবেক প্রেমিকা তিন্নী উপহার দিয়েছিল। সুমিতের মাথা ঘোরাচ্ছে। সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। শক্তহাতে ওভারব্রিজের খুঁটি ধরে ও দাঁড়িয়ে থাকে। নিচে পড়লে চলবে না। একটা কাজ সমাধান হওয়া জরুরি। কংক্রিটে সেঁটে থাকা রোদে দগ্ধ অশ্বত্থ গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে হয়। নইলে কংক্রিটের দেয়াল ক্ষয়ে যায় দ্রুত। কংক্রিটের নগরীতে অশ্বথের ঠাঁই নেই। সুমিত মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, মা তাঁর সবুজ শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে দিচ্ছে। প্রতিবার বাড়ি থেকে ফেরার সময় মা রাস্তা অবধি এগিয়ে দেয়। মুখে আঁচল দিয়ে কাঁদেন। সুমিতের প্রতিবারই ইচ্ছে হয় মাকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে। সে কাঁদে না। বরং মায়ের চোখ মুছে হাসি মুখে বিদায় নেয়।
পেছন থেকে কেউ একজন সুমিতকে উদ্দেশ্য করে ‘ভাই, ভাই’ বলে ডাকছে। ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকায়। কিন্তু লোকটার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পারছে না সে। তবে বোঝা যাচ্ছে লোকটার চোখে চশমা আছে।
‘ভাই, অসুস্থ আপনি? পানি খাবেন?’
সুমিত একহাতে খুঁটি ধরে আরেক হাতে চোখ ডলে নেয়।
‘নাহ, খাবো না’, কথাটা বলতে বলতে আবার রাস্তার দিকে ফিরে দাঁড়ায়। এবার সে কিছুটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সারি সারি গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়িয়ে। রং বেরঙের গাড়ি, মালবাহী ট্রাক, সিএনজি আর মাঝে মানুষ। সুমিতের কানে বাজছে সেই বাচ্চা ছেলের গগনভেদী চিৎকার, গাড়ির হর্ন, ফেরিওয়ালার হাক আর বাসে হেল্পারের তাগাদা ‘চাল্লু উঠেন, চাল্লু, এই চাল্লু!’
সিগন্যাল নামতেই গাড়িগুলো হুড়মুড় করে চলতে শুরু করে হর্ন বাজাতে বাজাতে। সুমিত ওভারব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখছে খানিকটা দূরে থাকা মালবাহী ট্রাকটিকে। দ্রুত এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। পিচঢালা রাস্তায় ট্রাকের ভারী চাকার উৎকট শব্দ সুমিত শুনতে পাচ্ছে। সাথে ভেসে আসছে তাগাদা, ‘চাল্লু চাল্লু’।
মালবাহী ট্রাক ক্ষণিকেই ওভারব্রিজের ছায়া মাড়িয়ে সামনে ছুটে গেল। পিষে দিয়ে গেল সুমিতের শরীর। ওভারব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ার সময় সুমিতের মনে পড়েছিল, তার অষ্টাদশী স্ত্রী জেবার কথা আর মেয়েটার লাজুক হাসি।