X
বুধবার, ১৪ মে ২০২৫
৩১ বৈশাখ ১৪৩২
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

‘সান্ত্বনা একটাই, শেখ হাসিনা তো বেঁচে আছেন’

পাভেল হায়দার চৌধুরী
২১ আগস্ট ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২১, ২০:০৬

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি, হারিয়ে গেছে অনেক মূল্যবান জীবন, তছনছ হয়ে গেছে অনেকের স্বপ্ন-সংসার। সেদিনের সরকারের পরিকল্পিত সেই সন্ত্রাসের ভয়াবহ চিহ্ন এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে। শরীরজুড়ে তাদের আঘাতের ব্যথা, তারমধ্যেও কৃতজ্ঞতা তাদের শেখ হাসিনার প্রতি। সবাই ভুলে গেলেও তাদেরকে ভুলেননি নেত্রী শেখ হাসিনা, এখনও আগলে রেখেছেন পরম মমতায়।

অন্যদের মত সুস্থ স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে ২১ আগস্টের ওই সমাবেশে গিয়েছিলেন দৌলতুন নাহার, রাশিদা আক্তার, মাহাবুবা পারভীন ও কাজী শাহানা ইসলামও। তখন কি আর জানতেন ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে বাকিটা জীবন তাদের কাটাতে হবে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে?

গ্রেনেড হামলার শিকার আহত আওয়ামী লীগের কর্মীরা বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন। ইতিহাসের জঘন্যতম এই হামলায় নারী নেত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের বিকট শব্দে এক কানের শ্রবণশক্তি হারান তিনি। তবে ১৭ বছর ধরে ওই দিনের হামলায় আহত কোনও নেতাকর্মীকেই ভোলেননি শেখ হাসিনা।

আহত নেতাকর্মীরা বলেন, তাদের জীবনের সান্ত্বনা— শেখ হাসিনা তাদের আগলে রেখেছেন এখনও। ১০৪ জন আহত কর্মীকে নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। এককালীন অনুদান দেওয়া হয়েছে। ঢাকায় ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে ৩৬টি পরিবারকে।

তেমনই একজন রশেদা আক্তার রুমা। তিনি বলেন, ‘দিনটিকে কখনোই ভুলতে পারবো না৷ স্বাভাবিকভাবে হেঁটে সেদিন সভায় গিয়েছিলাম। জানতাম না যে সেখানে লাশ হয়ে আমাদের পড়ে থাকতে হবে। হাসপাতালে হাসপাতালে জীবনযাপন করতে হবে৷ আমি নিজে লাশের ওপর পড়ে ছিলাম। সেই দৃশ্যটা আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভুলতে পারবো না।’

রাশিদা আক্তার বলেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার পরে চিকিৎসকরা ভেবেছিল আমি বুঝি মারা গেছি। তাই সাদা কাপড়ে মুখ ঢেকে লাশের সঙ্গে ফেলা রাখা হয়েছিল আমাকে। হঠাৎ আমার মুখে গোঙানির একটু আওয়াজ শুনতে পায় চায়না নামের একটা মেয়ে। সে সাবের (সাবের হোসেন চৌধুরী) ভাইকে বললো, ‘ভাই মেয়েটি মনে হয় বেঁচে আছে’। পরে আমাকে সেখান থেকে ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিক্যালে নেওয়া হয়। সেখানকার ডাক্তাররা বললো— আমার দুই পা কেটে ফেলতে হবে।’

রুমা বলেন, ‘পরে চিকিৎসার জন্য নেত্রী আমাকে ভারতে পাঠান। সেখানে দুইবছর থেকে চিকিৎসা করিয়েছি। পা কাটা হয়নি। এসেছিলাম হুইল চেয়ারে করে। ডান পায়ের পাতা এখনোও শুকায়নি।।’

তিনি বলেন, ‘জীবনে ঘোর অমানিশা নেমে এসেছে। তবুও সান্ত্বনা পাই, নেত্রী (শেখ হাসিনা) খবর নেন, সাহায্য পাঠান। দুই বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মিরপুরে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। আর  মাসিক পাঁচ হাজার করে টাকা দেওয়া হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। প্রথমে এককালীন ১০ লাখ টাকার সঞ্চয় পত্রের চেক দেওয়া হয়৷ পরে বাচ্চাদের জন্য ৫ লাখ টাকার এফডিআর করে দেওয়া হয়।’

ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মাহবুবা পারভিন সাভার থেকে নেতাকর্মীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এসেছিলেন ওই দিন। ছিলেন একেবারে অস্থায়ী মঞ্চের (ট্রাক) সামনেই। হঠাৎ শোনেন বিকট আওয়াজ। দেখেন ধোঁয়ার কুণ্ডুলি। ঘটনার প্রায় ২০ দিন পরে কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জ্ঞান ফিরে মাহাবুবার।

তিনি বলেন, ‘ট্রাকের সামনেই ছিলাম। নেত্রী জয়বাংলা বক্তব্য দিয়ে শেষ করতে পারেন নাই। পুরো এলাকা কালো ধোঁয়ায় ভরে গেলো। তখন কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। সবাই চিৎকার করে বলছিলো বাঁচাও, বাঁচাও।’

মাহবুবা জানান, দেশের ডাক্তাররা তার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন রক্ষা পেয়েছে তার। তবে সেদিনের পরে আর কখনোই সুস্থ স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারেননি তিনি। কয়েকদিন পর পর স্প্লিন্টারের ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। ব্যথার চিৎকার এখনও মাঝে মাঝে জড়ো হয়ে যান প্রতিবেশীরা। এমনকি, ওয়াশরুমে যেতে হলেও অন্যের সাহায্য নিয়ে যেতে হয়।

মাহবুবা বলেন, ‘তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিয়মিত খোঁজ-খবর নেন, আর তাই এখনও বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে থেকে আমার জন্য প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। আর প্রথমে এককালীন ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়ের চেক দেওয়া হয়৷ পরে আরও ১০ লাখ টাকার চেক দেওয়া হয়। শুধু প্রধানমন্ত্রীই আমাদের খোঁজ খবর নেন। আর কেউ নেন না। এছাড়াও মিরপুরের ১৩ নম্বরে ১৪০০ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট দিয়েছেন।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে সহকর্মীদের সঙ্গে মিছিল নিয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কাজী শাহানারা ইয়াসমিন৷ আর সেখানে নিজেই শিকার হন বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার৷ হামলার ভয়াবহতার কথা মনে উঠলে এখনও শিউরে উঠেন৷

শাহানারা বলেন, ‘আমারতো বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এর সাথে সাথে ব্যথাও বাড়ছে। স্প্রিন্টারের যে ব্যথা, ভেতরে শিরশিরেভাব, দিনে দিনে বাড়ছে। ওষুধের ডোজও বেড়ে গিয়েছে৷ আগে খেতাম একবেলা এখন তিনবেলা খেতে হয়।’

ওই সময় চিকিৎসায় ভালো হলেও এখন শরীরে তাদের দেখা দিয়েছে নানান রোগের উপসর্গ৷ যারা সেই সময় কানের চিকিৎসা করাননি, এখন তাদের সেই সমস্যা বাড়ছে। অনেকেই কানে ইয়ারফোন ব্যবহার করছেন।

২১ আগস্টের ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘সেদিন ঢাকা বার থেকে আমরা মিছিল করে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে যাই। ট্রাকের বামপাশে নারী নেত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। অনেক গরম ছিল, আমরা ছায়া খুঁজতেছিলাম। অনেক মানুষ ছিল।’

শাহানারা বলেন, ‘নেত্রীর বক্তব্য শেষের পরে আমার মনে হয় আকাশটা ভেঙেই পড়লো। কারণ এত শব্দতো কখনোই শুনি নাই। আইভি আপাকে দেখলাম আস্তে বসে গেলো৷ ওনার চারপাশে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি। তারপর মানুষের হুড়োহুড়ি। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’

জ্ঞান ফেরার পরে দেখেন তাকে নিয়ে কয়েকজন টানাটানি করে গলির ভেতরে নিয়ে গিয়েছে৷ সারা শরীরে রক্ত। সেই সময় বার বার তার মনে পড়ছে দুই সন্তানের কথা। তিনি মারা গেলে দেখবেন কে তাদের৷ এই সময় এক রাজনৈতিক সহকর্মীকে দেখেন। তার কাছে সাহায্য চান। কিন্তু প্রথম পর্যায়ে তিনি ব্যর্থ হন। কারণ, তখন পুলিশ ঘটনাস্থলে টিয়ারগ্যাস চার্জ করেছিল।

সেই ঘটনা উল্লেখ করে শাহানারা বলেন, ‘সালেহ ভাই নামে এক রাজনৈতিক কর্মীকে বললাম, ভাই আমার ছোট দুইটি সন্তান আছে। আমি বাঁচতে চাই। পরে আমাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হলো।’

বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা তাদের সহযোগিতা করেছেন বলে জানান তিনি। বলেন, ‘আমাদের অনেককেই ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। আরও বাকি আছে। শুনেছি সবাইকে দেবে। আমি পাবো কিনা জানি না। কখনোই আবেদন করি নাই। তবে একবার তিন লাখ, আরেকবার ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল চিকিৎসার জন্য।’

ভয়াবহ সেই হামলায় আহত দৌলতুন নাহার বলেন, ‘২০০৪ সালের ২১ আগস্টের পর জীবনটা থেমে গেছে। চিরতরে হারিয়েছি এক চোখ। দুই পা আঘাতপ্রাপ্ত। এখন ডান পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। জীবনের কষ্ট কাউকে বোঝানো যাবে না। তবুও সান্ত্বনা খুঁজে পাই, নিজের করুণ পরিণতি হলেও বেঁচে আছেন বঙ্গবন্ধুরকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্ধকার জীবন অতিবাহিত করলেও সান্ত্বনা পাই এই ভেবে যে, আর কেউ না হোক স্বয়ং নেত্রী (শেখ হাসিনা) তো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।’ 

/এমকে/
টাইমলাইন: ২১ আগস্ট
২১ আগস্ট ২০২১, ০৯:০০
‘সান্ত্বনা একটাই, শেখ হাসিনা তো বেঁচে আছেন’
২১ আগস্ট ২০২১, ০০:০১
সম্পর্কিত
শেখ হাসিনাকে অবসরে গান শোনাতেন মমতাজ: পাবলিক প্রসিকিউটর
জুলাইয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে, জেনোসাইড হয়নি: চিফ প্রসিকিউটর
শেখ হাসিনা-জয়সহ রাজউক কর্মকর্তাদের গ্রেফতার সংক্রান্ত প্রতিবেদন পিছিয়েছে
সর্বশেষ খবর
কালুরঘাট সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা
কালুরঘাট সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করলেন প্রধান উপদেষ্টা
আ.লীগের সাবেক প্রভাবশালী ৭ মন্ত্রী-এমপি নতুন মামলায় গ্রেফতার 
আ.লীগের সাবেক প্রভাবশালী ৭ মন্ত্রী-এমপি নতুন মামলায় গ্রেফতার 
ডা. জুবাইদা রহমানের জামিন, আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ
ডা. জুবাইদা রহমানের জামিন, আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র: প্রধান উপদেষ্টা
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র: প্রধান উপদেষ্টা
সর্বাধিক পঠিত
বিমানবন্দরে তিন উপদেষ্টা, জেরার মুখে দায়িত্বরতরা
সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগবিমানবন্দরে তিন উপদেষ্টা, জেরার মুখে দায়িত্বরতরা
বাড়লো স্বর্ণের দাম, বুধবার থেকে কার্যকর
বাড়লো স্বর্ণের দাম, বুধবার থেকে কার্যকর
রাতে চিয়া বীজ খেলে এই ৬ উপকার পাবেন
রাতে চিয়া বীজ খেলে এই ৬ উপকার পাবেন
রাজধানীতে ৩০০ লিমিটেডের যাত্রা শুরু
রাজধানীতে ৩০০ লিমিটেডের যাত্রা শুরু
শেখ হাসিনাকে অবসরে গান শোনাতেন মমতাজ: পাবলিক প্রসিকিউটর
শেখ হাসিনাকে অবসরে গান শোনাতেন মমতাজ: পাবলিক প্রসিকিউটর