দেশের আগামীর রাজনৈতিক ক্ষমতার ভবিষ্যৎ কী হবে এ নিয়ে গত তিন দিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ, স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়ন, নারী প্রতিনিধিত্ব, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি), প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রভৃতি বিষয়।
গত ১৭ জুন ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এই আলোচনা শুরু হয় এবং এটি আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে। এর মধ্যে ১৮ জুন পর্যন্ত তিন দিন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে দলগুলো সাংবাদিকদের সঙ্গে তাদের মতামতের বিষয় জানায়। এই তিন দিনের আলোচনায় কোনও কোনও বিষয়ে অনেকটাই একমত হলেও কিছু বিষয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সিদ্ধান্তে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।
প্রথম দিন (১৭ জুন)
আলোচনার বিষয়: ৭০ অনুচ্ছেদ, নারী আসনে সরাসরি ভোট ও বিরোধী দলের কমিটি নেতৃত্বে ঐকমত্য
দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার প্রথম দিন ১৭ জুন সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। তবে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা নিরপেক্ষতা হারানোর অভিযোগে প্রতিবাদস্বরূপ অনুপস্থিত থাকে জামায়াতে ইসলামী। এদিন আলোচিত ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ‘আস্থা ভোট’ এবং ‘অর্থ বিল’ বাদে অন্য কোনও বিষয়ে নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোটদানে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতার বিষয়ে সবাই একমত হয়। এতে তাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল হবে না। তবে বিএনপিও এ বিষয়ে একমত থাকলেও ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ এবং ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ এই দুই বিষয়েও দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া যাবে না এমন প্রস্তাব রেখেছে। পরবর্তীতে জনগণের ম্যান্ডেটে তা যুক্ত করা হবে বলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ জানান।
এছাড়া চারটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় স্থায়ী কমিটি- পাবলিক অ্যাকাউন্টস, প্রিভিলেজ, ইস্টিমেশন এবং পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটির সভাপতি পদ বিরোধী দল থেকে দেওয়ার সিদ্ধান্তে সবাই একমত হয়েছে। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দিতে হবে বলে দাবি করে।
প্রথম দিন ১০০টি নারী আসনে সরাসরি ভোটের বিষয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল একমত প্রকাশ করে। কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে মতানৈক্য আছে। এদিকে নারীদের জন্য আলাদা আসনের বিষয়ে ধর্মীয় দলগুলোর দ্বিমত রয়েছে। তারা নারী-পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিশ্বাসী। এদিনের শুরুতেই আগামী জুলাই মাসে ‘জুলাই সনদ’ গঠিত হবে বলে জানান ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ।
তবে বৈঠক শেষে এনসিপি সংশয় প্রকাশ করে, ঐকমত্য কমিশন যে দলগুলোকে আলোচনায় ডাকছে সেখানে একটি নির্দিষ্ট দল এবং তাদের মিত্রদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এতে কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে তরুণদের এই দলটি।
দ্বিতীয় দিন (১৮ জুন)
আলোচনার বিষয়: এনসিসি গঠন ও বৈঠকে উত্তেজনা, প্রশ্নবিদ্ধ নিরপেক্ষতা
১৮ জুন দ্বিতীয় দিনে জামায়াত ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে ফিরে। এছাড়া পূর্বের দলগুলোও অংশগ্রহণ করে। এদিন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন নিয়ে আলোচনা হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রীয় কার্যাবলিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে এনসিসি গঠন প্রয়োজন। এনসিসি’তে থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, নিম্নকক্ষের স্পিকার, উচ্চকক্ষের স্পিকার, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দল মনোনীত নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, বিরোধী দল মনোনীত উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে উভয় কক্ষের কোনও একজন সংসদ সদস্য।
কয়েকটি শর্তে জামায়াত, এনসিপি’সহ অধিকাংশ দল এনসিসি গঠনে একমত হলেও এর বিরোধিতা করেছে গণফোরাম ও বিএনপি। গণফোরামের দাবি, এটি আরেকটি ‘স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান’ হয়ে উঠবে এবং বিএনপি এনসিসি’র জবাবদিহি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
এদিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়। অধিকাংশ দল ইলেকটোরাল পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে হলেও, বিএনপি বিদ্যমান সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে। তবে এদিন জেলা সমন্বয় কাউন্সিল নিয়ে তুলনামূলকভাবে কম আলোচনা হয়েছে বলে জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘কয়েকটি দল এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও এটি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়নি।’
এদিনও জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে না আসায় হতাশা প্রকাশ করে এনসিপি। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “সার্বিকভাবে আজকের দিনটি হতাশার। আমরা আশা করছিলাম এনসিসি’র বিষয়ে নীতিগত ঐক্যে পৌঁছাতে পারবো, যাতে করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঐকমত্য ও আস্থার ভিত্তিতে নিরপেক্ষ নিয়োগ হবে। একদলীয়ভাবে আগের মতো প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়োগ হবে না। কিন্তু সেই ঐকমত্য হয়নি।”
এছাড়াও দ্বিতীয় দিনে অন্য দলগুলোর প্রতিনিধিদের কথা বলতে বাধাগ্রস্ত করে জামায়াতকে বেশি সময় দেওয়ার অভিযোগ তোলে গণফোরাম, সিপিবি ও এলডিপি। একপর্যায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ঐকমত্য কমিশনের সভায় উত্তেজনার সৃষ্টি হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. মিজানুর রহমান, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এবং এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম। পরে আবার কমিশনের অনুরোধে তারা বৈঠকে ফিরে যান।
তৃতীয় দিন (১৯ জুন)
আলোচনার বিষয়: রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে মতপার্থক্য, আলোচনা চলমান
১৯ জুন তৃতীয় দিনের শুরুতেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়। দিন শেষে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পদ্ধতি রয়েছে তা পরিবর্তন হওয়া দরকার বলে রাজনৈতিক দলগুলো মত দিলেও বিএনপি বলছে, এ নিয়ে আলোচনা চলমান। এ বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনায় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল স্মরণ করিয়ে দেয় এর সঙ্গে পার্লামেন্টের দ্বিকক্ষ যুক্ত। রাষ্ট্রপতি কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সেক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ কেমন হবে, সেটি নিয়ে আলোচনা করেছি।’
এদিন প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়েও আলোচনা হয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ দল দুই মেয়াদের বেশি একজন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এমন মত দেয়। তবে বিএনপির বক্তব্য, দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর একবার বিরতি দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন একজন ব্যক্তি।
এ বিষয়ে দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না রাখার কারণ হিসেবে এনসিপি’র উত্তরের আহ্বায়ক ও দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা দেখেছি, যখন রাষ্ট্রের অন্যান্য অংশগুলো বুঝে যায় একজনই রাষ্ট্রের প্রধান হবে, তখন ক্ষমতা এককেন্দ্রিক হয়ে যায়।’
তবে তিন দিনের আলোচনায় দলগুলোর মধ্যে তেমন কোনও ঐকমত্য আসেনি বলে মন্তব্য করেছেন আমার বাংলাদেশ পার্টি’র (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, ‘তিন দিন ধরে ব্যাপক আলোচনা-বিশ্লেষণ চলছে, কিন্তু কোনও বিষয়েই ঐকমত্য হচ্ছে না। ইতোমধ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসহ কোনও বিষয়েই চূড়ান্ত ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এটি খুবই দুঃখজনক। জনগণ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন আমরা দেশের বিষয়ে একমত হতে পারি।’
এদিকে আলোচনা নিয়ে আশায় কথা বলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিটি দল স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত জানাতে পারছে। মতভিন্নতা থাকলেও মতামত প্রদানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বিরাজ করছে।’