সম্প্রতি দেশে দূরপাল্লার সড়কগুলোতে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা বেড়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এমন ঘটনা আরও বেড়েছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে—বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, প্রতিদ্বন্দ্বী বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে বা সহকারী-যাত্রীদের সঙ্গে চালকের কথা বলা এবং মাদক গ্রহণ।
গত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি বড় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে বৃহস্পতিবার (৬ অক্টোবর) দিনে-দুপুরে, বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্বপ্রান্তের গোলচত্বর এলাকায়। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে একতা পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে বিপরীত দিক দিয়ে আসা একটি মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হন।
পরদিন শুক্রবার (৭ অক্টোবর) সকালে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোপালগঞ্জে দিদার পরিবহনের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা দিলে ৪ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন কমপক্ষে ১০ জন। আহতরা অভিযোগ করেছেন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে। চালক চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে এবং সহকারীর সঙ্গে কথা বলে আসছিলেন।
একইদিন রাতে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের নতুনহাট এলাকায় দূরপাল্লার একটি বাসের মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে দ্বাদশ শ্রেণির তিন কলেজ শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। স্থানীয় দেয়াড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান বলেন, ‘দ্রুতগতিতে মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিল তারা। বিপরীত দিক থেকে আসা বাসটিও ছিল দ্রুত গতির। এই গতি তিনটি তাজা প্রাণ কেড়ে নিলো।’
শুক্রবার (৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় মাদারীপুরের রাজৈরে গ্রিন লাইনের একটি বাস বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিলে দুই জন মারা যান। প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য দূরপাল্লার বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে বাসটি বাইকটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয় বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন।
এ ছাড়া দূরপাল্লার রুটগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানির চালকদের বিরুদ্ধে মাদক নেওয়ার অভিযোগ মাঝেমধ্যেই সামনে আসে। বিশেষ করে দীর্ঘ ৪ থেকে ১২ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে গিয়ে এসব চালকরা মাদক নিচ্ছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। সঙ্গে মোবাইল ফোনে যখন-তখন কথা বলা এবং চালক-সহকারীর কথা বলতে থাকা তো আছেই।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে দেশে ৪০৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৭৬ জন এবং আহত ৭৯৪ জন। এর মধ্যে ৬৬টি মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৮৭টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১০৫টি, পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া ৪১টি বাকি দুর্ঘটনাগুলো অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
গত আগস্ট মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৯ জন নিহত হয়েছিলেন। সে হিসেবে সেপ্টেম্বর মাসে প্রাণহানি কিছুটা কমেছে। তবে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, প্রাণহানি হ্রাসের এ মাত্রা কোনও টেকসই উন্নতির সূচক নির্দেশ করছে না।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দূরপাল্লার গণপরিবহনে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো- চালক-সহকারীদের কর্মঘণ্টা নির্ধারিত না থাকা। তারা ১০-১২ ঘণ্টাও দায়িত্ব পালন করে। দ্রুতগতি বা বেপরোয়া গাড়ি চালানোও দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ। ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল, অন্য গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতাও উল্লেখ করার মতো। অনেক চালক-সহকারী শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা এবং মাদক গ্রহণও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
সড়কে সিসি ক্যামেরা বসানোর কথা থাকলেও তা নেই উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থেকে অনেক দূরে আছি আমরা। লাখ লাখ টাকার গাড়ি নামালেও ১৫ হাজার টাকার জিপিএসে অনীহা দেখা যাচ্ছে মালিকদের। এই সুবিধা থাকলে, নিয়মিত ডোপ টেস্ট করা হলে, সিসি ক্যামেরা বসিয়ে মনিটরিং করা গেলে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর সড়কে শৃঙ্খলা আনতে মনোযোগ দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পরিবহন মালিকরা সড়কে গাড়ি নামিয়ে কেবল অর্থ আয়ের জন্য বসে থাকে। দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত চালক-সহকারীদের বিষয়ে কোনও খোঁজখবর নেন না। দুর্ঘটনা ঘটলেই শোনা যায়, চালকের লাইসেন্স নেই, গাড়ির ফিটনেস নেই। গাড়িটি দ্রুত গতিতে চলছিল, চালক মাদকাসক্ত ছিল। পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানোর জন্য কিংবা মোবাইল ফোনে চালক কথা বলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু উত্তরণের কোনও উদ্যোগ বা পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না। উল্টো সড়কে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য চলছে।
এসব অভিযোগ মালিক ও শ্রমিকরা বরাবরই অস্বীকার করে আসলেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির প্রভাবশালী একজন নেতা বলেন, এ ক্ষেত্রে মালিকদের কী করার আছে? আমরা তো আর চালকদের বেপরোয়া গাড়িতে গাড়ি চালাতে অথবা অন্য গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতাও করতে বলি না। আমাদের অজান্তে তারা এমনটি করলে বা মাদক নিলে কিংবা অন্য কোনও অপরাধ করলে তা প্রশাসনের দেখার দায়িত্ব। তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এসব ঘটছে, চালক-সহকারীরা লাই পাচ্ছে, তার দায় আমরা নিবো কেন?
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমানী আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সব চালকরা তো এমনটি করছে না। যারা করছে, তারা দুর্ঘটনায়ও পড়ছে। এসব বিষয়ে আমরা সব সময় চালক-সহকারীদের সতর্ক করে আসছি। এমনকি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন সময়ে প্রচারণাও চালানো হয়েছে। আমরা সব সময় চালক-সহকারীদের দেশের আইন ও নিয়ম-কানুন মেনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য উৎসাহিত করে থাকি।