X
শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
২০ বৈশাখ ১৪৩২

রাজধানীতে দেদার চলছে ফিটনেসবিহীন বাস, দায় কার?

আসাদ আবেদীন জয়
০৫ জুলাই ২০২৩, ১০:০০আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৩, ১৬:৪১

রাজধানীতে চলাচলকারী গণপরিবহনের একটি বড় অংশেরই ফিটনেস নেই। লক্কড়-ঝক্কড় এসব বাসের কোনোটার জানালার কাচ ভাঙা, কোনটার সিট ভাঙা, নেই সিট কভার, সব মিলিয়ে বাসের ভেতরে নোংরা পরিবেশ। কোনও বাসের হয়তো মূল বডিই ভাঙাচোরা, কিংবা ব্রেকলাইট বা ইন্ডিকেটর লাইট ভাঙা। রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন এই রুগ্ন বাস দিয়েই চলছে যাত্রীসেবা।

সরেজমিন রাজধানীর কয়েকটি রুটে চলাচলকারী বাসের এমন হাল দেখা যায়। যাত্রীরা বলছেন, বাধ্য হয়েই নোংরা ও লক্কড়-ঝক্কড় বাসে চড়তে হচ্ছে তাদের। এতে প্রতিনিয়ত তাদের বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তিতেও পড়তে হচ্ছে। কিন্তু উপায়ন্তর না পেয়েই তাদের এসব বাসে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এসব বিষয় কারও অজানা নয়, কিন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় পরিত্রাণ মিলছে না কিছুতেই।

‘অগো চলার পারমিট নাই, তাও ঘুষ দিয়া চলে’

রাজধানীর গাবতলী থেকে রায়ের বাজার, হাজারীবাগ হয়ে বাবুবাজার পর্যন্ত চলাচল করে প্রত্যয় ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের বাস। প্রত্যয়ের রুট নম্বর এ-২৮৯। এই পরিবহনের প্রায় প্রতিটি বাসই ভাঙাচোরা। ভেতরের পরিবেশ যেমন নোংরা, তেমনি নেই জানালার গ্লাস ও  সিট কভার।

বাসের এমন দুরবস্থার বিষয়ে কথা হয় প্রত্যয় বাসের সুপারভাইজার নাসির শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাস সবই মোটামুটি ভালো। কয়েকটা একটু ভাঙা। মালিককে বলেছি, ঠিক করে দিতে, কিন্তু মালিক বলেছেন—এখন নাকি হাতে টাকা নাই। টাকা পেলে ঠিক করে দেবেন। আর এই রাস্তায় ধুলোবালি বেশি, তাই তাড়াতাড়ি বাসগুলো নোংরা হয়ে যায়।’

প্রত্যয় বাসের চালক মো. রাসেল বলেন, ‘আমাদের বাস ঠিক করলেও ঠিক থাকে না। এক বাস আরেক বাসরে মাইরা দেয়। এ রকমই চলতে থাকে। এরমধ্যে রাস্তায় অটো (ব্যাটারি চালিত রিকশা) চইলা আরও ঝামেলা লাগায়। অগো চলার পারমিট নাই, তাও ঘুষ দিয়া চলে। অগো লাইগা আমরা যাত্রী পাই না। তাই জায়গায় জায়গায় দাঁড়াই, ফলে আরেক বাসের লগে ধাক্কা লাগে। আমাগো গাড়ি চালাইতে অনেক সমস্যা হয়।’

অনেক বাসের জানালার কাঁচ ভাঙা। এতে রোদ, ধুলো আর বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়ে যাত্রীরা

বাস নোংরা ও সিট কভার নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই রাস্তায় অনেক ধুলা, তাই ময়লা হইয়া যায়। আর  কভার পুরান হইয়া গেছে, তাই ফালায় দিছি। মহাজনরে কইছি, নতুন কভার বানাইতে দিছেন। কয়েক দিন পরই নতুন কভার লাগায় দেবো।’

সাভার ইপিজেড থেকে গাবতলী, ফার্মগেট, শাহবাগ হয়ে লিংকরোড পর্যন্ত চলাচল করে ‘গাবতলী এক্সপ্রেস’ নামের বাস (রুট নম্বর এ-১৮৮/১৯০)। এই বাসের হালচালও প্রায় একই। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আয়তনেও ছোট। তার ওপরে ‘গাবতলী এক্সপ্রেস’-এর বাসে ঠিকভাবে বসতে পারেন না যাত্রীরা। নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে বসানো হয়েছে অতিরিক্ত সিট। এই কোম্পানির অনেক বাসেরই জানালার কাচ ভাঙা। এতে রোদ, ধুলো আর বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।

গাবতলী এক্সপ্রেসের এক সহকারী বলেন, ‘আমগো লোকাল বাস। লোকাল বাসের সিট এমন নোংরাই থাকে। নতুন কভার লাগাইলে যাত্রীরা টানতে টানতে ছিঁড়া ফালায়। মালিকরে নতুন কভার লাগাতে কইলে শুনে না।’

গাদাগাদি করে এত মানুষ তোলা হয় যে, দাঁড়ানোর মতো জায়গা থাকে না

ভিক্টর ক্লাসিক বাসটি চলাচল করে রাজধানীর সদরঘাট থেকে আশুলিয়া থানার বাইপাইল পর্যন্ত। এর রুট নম্বর এ/৪৩৬। এই কোম্পানির কিছু বাস ভালো অবস্থায় থাকলেও বেশিরভাগই ভাঙাচোরা, অপরিচ্ছন্ন, ব্রেকলাইট নেই, নগরজুড়ে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে কালো ধোঁয়া।

এছাড়া রাজধানীতে বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন রুটে ভাঙাচোরা বাস দিয়েই চলছে যাত্রীসেবা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য শিকড় পরিবহন সার্ভিস লিমিটেড (মিরপুর ১২ থেকে যাত্রাবাড়ী), আকাশ এন্টারপ্রাইজ (কদমতলী-দিয়াবাড়ী) আজমেরী গ্লোরী (সদরঘাট-চন্দ্রা), তানজিল পরিবহন (চিড়িয়াখানা-সদরঘাট)।

১৫ বছর ধরে বাস চালান মো. রকি। তানজিল বাসের ড্রাইভার হিসেবে আছেন ৬ বছর। তিনি বলেন, ‘বাসের বডিতে কোনও সমস্যা নাই। খালি সিট কভার ময়লা হইয়া যায়, আর ছিঁড়ে যায়। মালিকরে বলি, মালিক কয় আজকে দিমু কালকে দিমু। কিন্তু আর দেয় না।’

পুরানা পল্টন মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের এএসআই মনজুর কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই বাসগুলো ধাক্কাধাক্কি করে বডি নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু অনেক বাসই রাস্তায় নতুন নামায়। আসলে বাসের ড্রাইভাররা কোনও নিয়ম মানে না। অনেক সময় তারা ট্রাফিক আইন মানে না। কত যে মামলা দেই, তার হিসাব নাই। তবু এরা ঠিক হয় না। নিয়মে আসে না।’

ভাঙা জানালা জোড়া দিয়ে দিব্যি চলছে নগরজুড়ে

গাবতলী এক্সপ্রেস বাসের যাত্রী মো. আরিফ বলেন, ‘আমার অফিস গ্রিন রোডে। বিভিন্ন বাসে যাতায়াত করি। কিন্তু এই বাসের অবস্থা খুবই খারাপ। সকালে অফিস টাইমে গাদাগাদি করে এত মানুষ তোলা হয় যে দাঁড়ানোর মতো জায়গা থাকে না। এই বাসের হাইটও কম, দাঁড়ালে মাথায় লাগে। আবার সিটে বসলে ঠিকমতো পা রাখা যায় না।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সুকান্ত। অফিসে যাতায়াতের জন্য তাকে নিত্য গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয়। গণপরিবহনে চড়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রতিনিয়তই যাতায়াতের জন্য বাসে চড়তে হয়। এ কারণে প্রতি দিনই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এমনিতেই অফিস টাইমে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। তার ওপরে গাবতলী এক্সপ্রেস-এর  অবস্থাও ভালো না। ভেতরে সিটগুলো নোংরা, জানালার গ্লাস থাকে না। বৃষ্টি আসলে ভিজতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আবার অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ধাক্কা লাগিয়ে দেয়। এতে দরজার পাশে যে হ্যান্ডেল থাকে, সেটা চ্যাপ্টা হয়ে যায়। তাই দ্রুত বাসে ওঠার সময় সমস্যা হয়। আমি একবার দ্রুত উঠতে গিয়ে এ রকম হ্যান্ডেল থাকায়, ধরতে না পারায় রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’

রাজধানীতে চলাচলকারী বাসগুলোর এই বেহাল দশা দেখার যেন কেউ নেই। এ জন্য যাত্রীরা দুষছেন বাসচালক ও শ্রমিকদের। আর চালক-শ্রমিকরা বলছেন, মালিকদের লোভের কারণে তারা যাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছেন না। তবে মালিকরা তাদের দায় অস্বীকার না করলেও দুষছেন নগর পরিবহন পরিস্থিতিকে। সবাই বিআরটিএ’র ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন এবং সংস্থাটির উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন।

ফিটনেসবিহীন যানবাহন কীভাবে চলছে, সেটি দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের

তাহলে কর্তৃপক্ষ কী করে
অভিযোগ আছে, গণপরিবহনের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে বিআরটিএ অভিযানে নামলেই বেকে বসেন গণপরিবহনের মালিক ও শ্রমিকরা। বিশেষ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামলেই হঠাৎ সড়কে বাস নামানো কমিয়ে দেন তারা। সেই সঙ্গে বিআরটিএ’র অভিযানের কার্যকারিতা নিয়েও নানা অভিযোগ করতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নতুন আইন অনুযায়ী সড়কে নিয়মিত অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি, বসে নেই। ফিটনেসবিহীন যানবাহন কীভাবে চলছে, সেটি দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের।’

রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জয়দেব চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। এটি তো আমরা দেই না। আমরা নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে অভিযান চালিয়ে থাকি। সনদ ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি পেলে ডাম্পিং করা হয়, মামলা দেওয়া হয়।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
টাইমলাইন: নাগরিক পরিবহন
১৩ জুলাই ২০২৩, ১০:০০
০৫ জুলাই ২০২৩, ১০:০০
রাজধানীতে দেদার চলছে ফিটনেসবিহীন বাস, দায় কার?
সম্পর্কিত
ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপটে বিশৃঙ্খল চট্টগ্রামের সড়ক, চলতি মাসে জব্দ ৩ হাজার
রাস্তা খুঁড়ে রেখে ঠিকাদার ‘উধাও’, জনভোগান্তি চরমে
গণপরিবহনে যৌন হয়রানি দেখলে চুপ না থেকে প্রতিবাদ করুন: বিশেষ সহকারী মইনউদ্দীন
সর্বশেষ খবর
শুকনো মরিচের দাম কেজিতে কমলো ১০০ টাকা
শুকনো মরিচের দাম কেজিতে কমলো ১০০ টাকা
মুক্ত গণমাধ্যমের ধারণাটিই ত্রুটিপূর্ণ
মুক্ত গণমাধ্যমের ধারণাটিই ত্রুটিপূর্ণ
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কর-মুক্ত মর্যাদা বাতিলের হুমকি ট্রাম্পের
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কর-মুক্ত মর্যাদা বাতিলের হুমকি ট্রাম্পের
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফিট হয়ে ফিরছেন স্টোকস
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফিট হয়ে ফিরছেন স্টোকস
সর্বাধিক পঠিত
কেন আবারও আন্দোলনে যাচ্ছেন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষকরা?
কেন আবারও আন্দোলনে যাচ্ছেন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষকরা?
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
‘নারী সংস্কার কমিশনের প্রতি ঘৃণা উসকে দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন’
‘নারী সংস্কার কমিশনের প্রতি ঘৃণা উসকে দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন’
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’