X
শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
২০ বৈশাখ ১৪৩২

বাস চালক-শ্রমিকদের আয়ের নিশ্চয়তা নেই!

জুবায়ের আহমেদ
০৬ জুলাই ২০২৩, ১০:০০আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৩, ১১:৩১

দেশের অধিকাংশ গণপরিবহন বেসরকারি খাতে পরিচালিত হওয়ায় এখন পর্যন্ত ন্যায্য শ্রমনীতি তৈরি হয়নি। বাস চালক-শ্রমিকদের আদর্শ মজুরি এবং কাজের সু-ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। এর ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য আয়ের নিশ্চয়তা নেই, জীবনমানেও আসেনি শৃঙ্খলা।

সম্প্রতি কথা হয় রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের বাস চালক ও শ্রমিকদের সঙ্গে। তাদের অধিকাংশই দৈনিক ৩ হাজার বা এরও বেশি টাকা চুক্তিতে বাস নিয়ে রাস্তায় চালান। এই চুক্তির টাকা জমা ও রাস্তায় বিভিন্ন জনকে উৎকোচ দেওয়ার পর বাড়তি যা থাকে তা তাদের আয়। কেউ আবার বেতনে বাস চালালেও তা স্বল্প মনে করেন। তাই আয় বাড়াতেই পরিবহন শ্রমিকরা অতিরিক্ত যাত্রী বহন, অন্য বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, বেপরোয়া গাড়ি চালানোসহ সড়কে নানান বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন। এছাড়া দিন শেষে নগদ টাকা হাতে পাওয়ায় স্ট্যান্ডে মাদক ও জুয়ার আসরে দৈনিক আয়ের অনেকাংশ ব্যয় করেন কেউ কেউ। এতে করে তাদের কাটে না অর্থ সংকট, জীবনে থাকে না কোনও শৃঙ্খলা।

নির্দিষ্ট আয়ের নিশ্চয়তা নেই

‘চুক্তিতে বাস নেও, রাতে জমার টাকা বুঝায়া দেও’— এইটাই রীতি মন্তব্য করে শিকড় বাসের চালক আউয়াল হোসেন বলেন, ‘২০ বছর ধরে গাড়ি চালায়া আসতাছি। আগে মুড়ির টিন চালাইছি, এখন অনেক ভালো গাড়িও চালাই। কিন্তু নিয়ম ওই একটাই। রাতে গিয়া বাস মালিকরে প্রতিদিনের জমার টাকা বুঝায়া দেওয়া লাগে। এরপর বাকি যা থাকে তা আমার আর আমার হেল্পারের।’

বাস চালক বা তাদের সহকারীদের আয়ের নিশ্চয়তা নেই, জীবনমানেও আসেনি শৃঙ্খলা (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

একদিনের আয়ে দুই দিন চলতে হয় জানিয়ে খাজাবাব পরিবহনের চালক মো. নুর ইসলাম বলেন, ‘নিয়ম হলো একদিন গাড়ি চালায়া আরেকদিন রেস্ট। তাতে আমার এই একদিনের আয় দিয়া দুইদিন চলতে হয়। মনে করেন বাড়তি লোক উঠায়াও দিনে যদি ১২০০ থেকে ১৫০০, কোনও দিন যদি ভালো যায় ১৮০০ টাকাও আয় হয়। এখন এত কষ্ট কইরা দুই দিনের হিসাবে দিনপ্রতি কত করে আসে? বর্তমান বাজারে এই টাকায় কী হয়? রিকশা চালাইলেও দিনে এই টাকা আসে, তাও আরাম। আমাদের মতো এত হয়রানি নাই।’

নিজের আয়, মালিকের দৈনিক জমার চিন্তায় চাপে থাকতে হয় জানিয়ে বিহঙ্গ বাস চালক আব্বাস বলেন, ‘আমাদের ওপর সব দায় চাপায়া না দিয়া বাস মালিকরা যদি বলে বাস ড্রাইভাররা শুধু গাড়ি চালাইবো, ইনকামের চিন্তা নাই। তখন না সব সিস্টেমে আসবে। এখন আমার মাথার ওপর বোঝা দিয়া যদি বলেন, দৌড়ান। তাহলে তো আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার তো টেনশন থাকে ঘরে টাকা নিয়া যাইতে হইবো, মাহাজনরে টাকা বুঝায়া দিতে হইবো। আমার তো শুধু টেনশন থাকবো কীভাবে যাত্রীরে নিরাপদে পৌঁছাইয়া দেওয়া যায়?’

নেই নির্দিষ্ট শ্রম ঘণ্টা, বিশ্রামের সুযোগ

গণপরিবহন শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কোনও কর্মঘণ্টা নেই বলে জানিয়েছেন বাস চালক ও সহকারীরা। সকাল থেকে সন্ধ্যায় অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজ করতে হয়। রাজধানীর জ্যাম ঠেলে যতটা ট্রিপ দেওয়া যায়, তার ওপর নির্ভর করে দিনের কাজ কখন শেষ হবে। কাজ শেষ করে বাস মালিককে জমার টাকা ও গাড়ির চাবি ফিরিয়ে দিতে দিতে মধ্য রাত হয়ে যায় বলেও জানান তারা।

নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টাও মানা হয় না বাস চালক বা তাদের সহকারীদের ক্ষেত্রে (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

দিনে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় জানিয়ে মিরপুর লিংক বাসের চালক ফয়সাল বলেন, ‘আমাদের যে বর্তমান পরিস্থিতি, আগে যারা গাড়ি চালাইতো, তারা একদিন পর পর চালাইতো। আর এখন যারা গাড়ি চালাই তারা ঘুমাইতে পারি না। এই সকালে আসি রাতে বাড়ি যাই পরের দিন আবার রাস্তায় নামি। এখন বাধ্য হইয়াই টানা গাড়ি চালাইতে হয় ফ্যামিলি বাঁচাইতে।'

দীর্ঘ সময় কাজের মধ্যে কোনও বিশ্রামের সুযোগ নেই বাস শ্রমিকদের। জ্যামের শহরে এক ট্রিপ দেওয়ার পর আরেক ট্রিপ দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। অন্যথায় দিনের ট্রিপ কম হলে জমার টাকা দিয়ে নিজের আয়ে টান পড়ার দুশ্চিন্তায় থাকেন বাস শ্রমিকরা।

এবিষয়ে বিকাশ পরিবহনের চালক নজরুল বলেন, ‘দিনে পুরা ট্রিপ দেওয়া যায় তিনটা। এর মাঝে যদি বিশ্রাম নিতে চাই, তাইলে তো সময়ই পাওয়া যাইবো না গাড়ি চালানোর। এমনিতে রাস্তার বেশিরভাগ জ্যামেই আটকায়া থাকি।’

গাড়িতেই বিশ্রাম জানিয়ে শিকড় পরিবহনের আরেক চালক সোহেল বলেন, ‘আমাদের তো কোথাও পার্কিংয়ের সুযোগ নাই। সদরঘাট গেলে গাড়ি অলটাইম দৌড়ের ওপর রাখে। গাড়ি ব্রেক করারই সুযোগ দেয় না, পার্কিং তো পরে। দুপুরে খাওয়ার পরে চায়ের দোকানে না হলে বাসেই রেস্ট নিতে হয়।’

দুর্ঘটনায় আহত হলে দেখার কেউ নেই

যে কোনও দুর্ঘটনায় শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে কোনও ক্ষতিপূরণ পান না বাস শ্রমিকরা। তাদের ভাষ্য, শ্রমিকের কল্যাণের নামে নানা অর্থ আদায় করা হলেও দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হলে কোনও ক্ষতিপূরণ পান না গণপরিবহন শ্রমিক বা তার পরিবারের সদস্যরা।

এবিষয়ে বাস চালক জাফর বলেন, ‘শ্রমিকের নাম কইরা, প্রোটেকশন দেওয়ার নাম কইরা ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৬০ টাকা আমরা চাঁদা দেই। সবখানেই কিন্তু আমাদের চাঁদা কে খায়, কোন কাজে লাগে আমরা জানি না। আমি এখন পর্যন্ত শুনি নাই কোনও শ্রমিক এক্সিডেন্ট করলে ১০ টাকা দিয়া কেউ সহায়তা করছে।’

পরিবহন শ্রমিকরা দুর্ঘটনার শিকার হলে নেই সহায়তার আশ্বাস (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

শ্রমিকের বিপদে শ্রমিকই এগিয়ে আসে জানিয়ে আরেক বাস চালক মো. কাউসার বলেন, ‘এমনিতে তো কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে কাউরে খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও কেউ সহায়তার জন্য আসে, ভুক্তভোগীরে নিয়া বাসস্ট্যান্ডে মূর্তির মতো বসায়া রাখে। এসময় অন্যান্য শ্রমিকরা ৫০ টাকা, ১০০ টাকা করে দেয়। এর বেশি তো দেওয়াও সম্ভব না। তারাই কত আর কামায়।’

আয় থেকে পথে পথে দিতে হয় চাঁদা 

দৈনিক আয়ের একটা অংশ পথে পথে চাঁদা দিতেই ব্যয় হয় বলে জানান গণপরিবহন শ্রমিকরা। তারা বলেন, দৈনিক প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বিভিন্ন জায়গায় ওয়েবিল ও চাঁদা দিতে হয়। এই টাকার পুরোটা যায় তাদের আয় থেকে। আর এসব চাঁদা বিভিন্ন গণপরিবহন সমিতির ও স্থানীয় রাজনৈতিক দলের লোকেরা আদায় করেন বলে জানান বাস চালক ও সহকারীরা।

মিরপুর ১২ থেকে আজিমপুর যেতে আসতে প্রায় ৮ থেকে ১০ জায়গায় চাঁদার টাকা দিতে হয় জানিয়ে মিরপুর লিংকের সহকারী রুবেল বলেন, এই পেশার কোন ভবিষ্যৎ নাই, আয় রুজির ঠিক নাই। একদিন বেশি হয় তো আরেকদিন খরচাপাতি দিয়া টানাটানি অবস্থা। তার ওপর রাস্তার সব খরচ আমাদের। এত কিছু দিয়া আর থাকে কত। সবাই দেখে টাকার লাইগা পাড়াপাড়ি করি। এইটা তো আর এমনি এমনি না।

শিকড় বাসের সহকারী বাবু বলেন, ‘রাস্তার চাঁদা-মাদা সব টাকা আমাদের দিতে হইতাছে। আর শেষে আমার ইনকাম হোক না হোক, মালিকের টাকা বুঝায়া দিতে হয়। এক পয়সা কম নাই আগে টাকা দেও। এই চাঁদার চার-পাঁচশো যদি না দেওয়া লাগতো তাহলেও তো কিছুটা সেভ হয়'।

গণপরবহনের শ্রমিকরা সবচেয়ে অবহেলিত মন্তব্য করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের থেকেও কষ্ট করে আমাদের গণপরিবহন শ্রমিকরা। গার্মেন্টসে কাজ করলে কাজের একটা নির্ধারিত সময় আছে। কিন্তু এদের তা নাই। এত কষ্টের পরেও পার্কিংয়ের সুযোগ নাই, বিশ্রামেরও কোনও সুযোগ নাই। এখন পর্যন্ত এই পরিবহন শ্রমিকদের কল্যাণে কেউ চিন্তা করে না।

/ইউএস/
টাইমলাইন: নাগরিক পরিবহন
১৩ জুলাই ২০২৩, ১০:০০
০৬ জুলাই ২০২৩, ১০:০০
বাস চালক-শ্রমিকদের আয়ের নিশ্চয়তা নেই!
সম্পর্কিত
খিলগাঁওয়ে পৃথক ঘটনায় দুই শিশুর মৃত্যু
রাজধানীতে মোটরসাইকেল ধাক্কায় পথচারী নিহত, আহত স্বামী-স্ত্রী
রাজধানীতে মাদরাসা শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
সর্বশেষ খবর
শুকনো মরিচের দাম কেজিতে কমলো ১০০ টাকা
শুকনো মরিচের দাম কেজিতে কমলো ১০০ টাকা
মুক্ত গণমাধ্যমের ধারণাটিই ত্রুটিপূর্ণ
মুক্ত গণমাধ্যমের ধারণাটিই ত্রুটিপূর্ণ
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কর-মুক্ত মর্যাদা বাতিলের হুমকি ট্রাম্পের
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কর-মুক্ত মর্যাদা বাতিলের হুমকি ট্রাম্পের
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফিট হয়ে ফিরছেন স্টোকস
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ফিট হয়ে ফিরছেন স্টোকস
সর্বাধিক পঠিত
কেন আবারও আন্দোলনে যাচ্ছেন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষকরা?
কেন আবারও আন্দোলনে যাচ্ছেন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষকরা?
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতার ওপর দিনে সশস্ত্র হামলা, রাতে বাড়িতে আগুন
‘নারী সংস্কার কমিশনের প্রতি ঘৃণা উসকে দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন’
‘নারী সংস্কার কমিশনের প্রতি ঘৃণা উসকে দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন’
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
আগে রওনা দিয়েও এড়ানো গেলো না ‘নোটাম’, শাহজালালের ফ্লাইট গেলো ওসমানীতে
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’
‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট যুক্ত করার কথা ভাবছে সরকার’