X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যায় কেন গরমিল?

মাহফুজ সাদি
০৫ জুলাই ২০২৩, ১৬:০০আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৩, ১৬:০০

দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। সরকারিভাবে এসব তথ্য সংগ্রহে না রাখায় সঠিক তথ্য মিলছে না। এই খাত নিয়ে কাজ করা কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন মাসপ্রতি ও বছরভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে নিয়মিত। তাতে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে পূর্ণাঙ্গ তথ্য উঠে আসছে না। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সঠিক তথ্য নিয়ে বলতে গেলে থাকতে হচ্ছে অন্ধকারেই।

২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত— আট বছরের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একেক সংগঠন একেক রকম তথ্য দিচ্ছে। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) বলছে, গত ৮ বছরে ৩২ হাজার ১৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৩ হাজার ২২০ জন, আহত হয়েছেন ৫৪ হাজার ৩৮১ জন। সেভ দ্য রোড-এর হিসাবে এই সময়ে ১ লাখ ৩০ হাজার ৫০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪০ হাজার ৫২৩ জন, আহত হয়েছেন ১ লাখ ৮২ হাজার ৩০৮ জন। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, গত ৭ বছরে ৪৪ হাজার ১৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬১ হাজার ৬৫৬ জন নিহত ও ১ লাখ ১২ হাজার ৭৫৩ জন আহত হয়েছেন। আর রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে গত চার বছরে ২১ হাজার ৬২৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৪ হাজার ৬৩৯ জন ও আহত হয়েছেন ৩৪ হাজার ৫৬৫ জন।

বেসরকারি সংগঠনগুলোর নিয়মিত মাস ও বছরভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করায় চাপের মুখে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির গত ৫ মাসের হিসাব মতে, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ১ হাজার ৯৭৬টি। এতে প্রাণহানির সংখ্যা ১ হাজার ৯০৪ ও আহত ২ হাজার ৭৯৪ জন।

নিরাপদ সড়ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি বেসরকারি সংগঠন কাজ করলেও বর্তমানে চারটি সংগঠন কাজ করছে। এসব সংগঠনের দেওয়া গত আট বছরে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্যের তুলনা করলে ‘তথ্য বিভ্রাট’ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর কারণ হিসেবে তথ্য প্রাপ্তির নানা সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের খবর আসে গণমাধ্যমগুলোতে। ছোটখাটো দুর্ঘটনা কিংবা হতাহতের খবর অনেক সময় সংবাদ আকারে আসে না। আবার দুর্ঘটনার সময় হতাহতের সংখ্যা জানা গেলেও আহতদের থেকে পরবর্তীতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের হিসাব সেভাবে গণমাধ্যমে আসে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা না জানানোর কারণে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর নির্ভর করতে হয় বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। এ জন্য এক এক সংগঠনের দেওয়া তথ্য একেক রকম হচ্ছে। এর সমাধানে সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় একটি ডাটাবেজ বা তথ্য ব্যাংক করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যথায় জনসাধারণের সঠিক তথ্যপ্রাপ্তি মিলবে না, থেকে যাবে তথ্য বিভ্রাট।

দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য প্রকাশের সূচনা
১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এই দুর্ঘটনার পর আন্দোলন গড়ে তোলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। ওই বছরের ১ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)। এটি মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলায় জোরালো হতে থাকে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন।

এরপর একে একে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি, ২০০৭ সালে সেভ দ্য রোড ও ২০১৭ সালে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ২০১২ সাল থেকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি ২০১৫ সাল থেকে, সেভ দ্য রোড ২০১৪ সাল থেকে এবং রোড সেফটি ২০১৯ সাল থেকে সড়কের পাশাপাশি রেল ও নৌ দুর্ঘটনা এবং হতাহতের প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করে আসছে। বর্তমানে মাসভিত্তিক, এমনকি ঈদযাত্রার সময়েও আলাদা প্রতিবেদন প্রকাশ করছে সংগঠনগুলো।

মাস ও বছরভিত্তিক প্রতিবেদনে সংগঠনগুলোর দেওয়া পরিসংখ্যানে একের ধরনের তথ্য মিলছে

পরিসংখ্যানে বিভ্রান্তি
সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের মাস ও বছরভিত্তিক প্রতিবেদনে সংগঠনগুলোর দেওয়া পরিসংখ্যানে একের ধরনের তথ্য মিলছে। আবার সরকারি সংস্থা বিআরটিএ যে হিসাব দিচ্ছে, তার সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যের বিস্তর ফারাক। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বাদানুবাদের ঘটনাও ঘটছে। ফলে সঠিক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ থাকছেন বিভ্রান্তিতে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর গত ৮ বছরের হিসাব বলছে, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৬২৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ৩ জন, আহত ৬ হাজার ১৯৭ জন; ২০১৬ সালে ২ হাজার ৩১৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ২ হাজার ১৪৪ জন, আহত ৫ হাজার ২২৫ জন; ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৪৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ৬৪৫ জন, আহত ৭ হাজার ৯০৮ জন; ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১০৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪ হাজার ৮৩৯ জন, আহত ৭ হাজার ৪২৫ জন; ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭০২টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ২২৭ জন, আহত ৬ হাজার ৯৫৩ জন; ২০২০ সালে ৪ হাজার ৯২টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪ হাজার ৯৬৯ জন, আহত ৫ হাজার ৮৫ জন; ২০২১ সালে ৪ হাজার ৯৮৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ৬৮৯ জন, আহত ৫ হাজার ৮০৫ জন এবং ২০২২ সালে ৭ হাজার ২৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৮ হাজার ১০৪ জন, আহত ৯ হাজার ৭৮৩ জন।

সেভ দ্য রোড-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ২৬১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪ হাজার ৩০৩, আহত ১০ হাজার ১৭৮; ২০১৬ সালে ১২ হাজার ৬৬৭টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪ হাজার ৫৯৭, আহত ১২ হাজার ৬৪৫; ২০১৭ সালে ১৩ হাজার ৯৫৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪ হাজার ৬৬৪, আহত ১৩ হাজার ৫৯৩; ২০১৮ সালে ১৩ হাজার ৬২১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪ হাজার ২৯৫, আহত ১২ হাজার ৭০৫; ২০১৯ সালে ১১ হাজার ৭৫১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৩ হাজার ৯৩৮, আহত ৯ হাজার ৩৯৯; ২০২০ সালে ৮ হাজার ৬৯০টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৩ হাজার ৯২২, আহত ৮ হাজার ২২২; ২০২১ সালে ৭ হাজার ৫১২টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ৩৭০, আহত ৭০ হাজার ২২৯ এবং ২০২২ সালে ৫২ হাজার ৪৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৯ হাজার ৪৩৪, আহত ৪৫ হাজার ৩৩৭।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি ২০১৫ সাল থেকে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। সে হিসেবে, ওই বছর ৬ হাজার ৫৮১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৮ হাজার ৬৪২ জন, আহত ২১ হাজার ৮৫৫ জন; ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৬ হাজার ৫৫ জন, আহত ১৫ হাজার ৯১৪ জন; ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭ হাজার ৩৯৭ জন, আহত ১৬ হাজার ১৯৩ জন; ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭ হাজার ২২১ জন, আহত ১৫ হাজার ৪৬৬ জন; ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭ হাজার ৮৫৫ জন, আহত ১৩ হাজার ৩৩০ জন; ২০২০ সালে ৪ হাজার ৮৯১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৬ হাজার ৬৮৬ জন, আহত ৮ হাজার ৬০০ জন; ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭ হাজার ৮০৯ জন, আহত ৯ হাজার ৩৯ জন এবং ২০২২ সালে ৬ হাজার ৭৪৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৯ হাজার ৯৫১ জন, আহত ১২ হাজার ৩৫৬ জন।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ২০১৯ সাল থেকে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সংগঠনটির হিসাবে, ওই বছর ৪ হাজার ৬৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ২১১ জন, আহত ৭ হাজার ১০৩ জন; ২০২০ সালে ৪ হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫ হাজার ৪৩১ জন, আহত ৭ হাজার ৩৭৯ জন; ২০২১ সালে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৬ হাজার ২৮৪ জন, আহত ৭ হাজার ৪৬৮ জন এবং ২০২২ সালে ৬ হাজার ৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৭ হাজার ৭১৩ জন, আহত ১২ হাজার ৬১৫ জন।

বেসরকারি সংগঠনগুলোর নিয়মিত মাস ও বছরভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করায় চাপের মুখে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বিআরটিএ। সংস্থাটির বিভাগীয় কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই প্রতিবেদন তৈরির কথা জানানো হয়। হিসাব মতে, জানুয়ারিতে ৩২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৩৩ জন, আহত ৩৩৬ জন; ফেব্রুয়ারিতে ৩০৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩০৩ জন, আহত ৪১৬ জন; মার্চে ৩৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৫ জন, আহত ৬৮৮ জন; এপ্রিলে ৪৭৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৫৯ জন, আহত ৭০৫ জন এবং মে মাসে ৪৮৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৯৪ জন, আহত ৬৪৯ জন।

গত ৮ বছরে ৩২ হাজার ১৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৩ হাজার ২২০ জন

ঈদযাত্রার তথ্যেও বিভ্রান্তি
ঈদযাত্রাকে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়েও প্রতিবেদনগুলো আলাদা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। তাতেও এক এক সংগঠন এক এক রকম তথ্য দিচ্ছে, যা নিয়ে অনেককে প্রশ্ন তুলতে দেখা গেছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, গত ঈদযাত্রায় ১৪ দিনে (১৬ থেকে ২৯ এপ্রিল) ২৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০১ জন নিহত এবং ৫৫১ জন আহত হয়েছেন। এবার ঈদযাত্রায় সড়কে গত বছরের তুলনায় দুর্ঘটনা কমেছে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ, প্রাণহানি কমেছে ২১ দশমিক ১ শতাংশ এবং আহত ৩৩ শতাংশ কমেছে। রোড সেফটির হিসাবে ঈদযাত্রার এই ১৪ দিনে ২৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৫ জন নিহত এবং ৪৫৪ জন আহত হয়েছেন। আর সেভ দ্য রোড জানিয়েছে, ঈদযাত্রার ১৪ দিনে (১৬ থেকে ২৯ এপ্রিল) সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৪১টি। এতে নিহত হয়েছেন ২৪৪ জন এবং আহত হয়েছেন এক হাজার ১৭৩ জন।

ঈদযাত্রার ১৪ দিনের সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের হিসাব এই তিন সংগঠনের একটির সঙ্গে অন্যটির মিলছে না। যেমন— যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে দুর্ঘটনা ৩০৪টি, রোড সেফটি বলছে ২৪০টি আর সেভ দ্য রোড বলছে এক হাজার ৪১টি। যাত্রী কল্যাণ সমিতি হিসাবে নিহত ৩২৮ জন, রোড সেফটির হিসাবে ২৮৫ জন আর সেভ দ্য রোডের হিসাবে ২৪৪ জন। আহতের সংখ্যা যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে ৫৬৫ জন, রোড সেফটি বলছে- ৪৫৪ জন, সেভ দ্য রোড বলছে এক হাজার ১৭৩ জন।

পরিসংখ্যান নিয়ে পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন
গত মে মাসের শুরুতে বিআরটিএ’র কাছে এপ্রিল মাসের দিনভিত্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতদের তথ্য চেয়ে সংস্থাটির চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারের কাছে এক চিঠি পাঠান যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির ঈদযাত্রার প্রতিবেদনকে অবাস্তব ও কাল্পনিক দাবি করে বিস্তারিত তথ্য চেয়েও একটি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে বিআরটিএ’র প্রতিবেদনের চেয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫১টি, নিহত ৮৯ জন, আহত ৫৫ জন বেশি কেন হয়েছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির চিঠিতে বলা হয়, ‘বিআরটিএ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন তৈরি করে মাসভিত্তিক প্রকাশ করছে। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিআরটিএ’র প্রতিবেদনের সঙ্গে পুলিশের প্রতিবেদন বা বেসরকারি কোনও সংগঠনের প্রতিবেদনের মিল নেই।

কেন তথ্যবিভ্রাট
কেন এই তথ্য বিভ্রাট– জানতে চাইলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গত ১২ বছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনার ওপর প্রতিবেদন করে আসছি আমরা। আমাদের প্রধান সোর্স হচ্ছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে এবং নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকদের থেকেও পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন করা হচ্ছে। সোর্স হিসেবে নেওয়া গণমাধ্যমের সংখ্যায় কম-বেশি থাকায় একেক সংগঠনের তথ্য একেক রকম হচ্ছে। অনেক দুর্ঘটনা গণমাধ্যমে না আসায় ওই তথ্যগুলো আমাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার আমাদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে কেউ কিছু তথ্য যোগ-বিয়োগ করে আলাদা প্রতিবেদন দিচ্ছে। এসব কারণে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য আসছে। এই কাজটি করার কথা ছিল বিআরটিএ’র। তারা করছে না বলেই আমরা করছি কাজটি।

এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে নিয়ে থাকি। এটি করতে গিয়ে অনেক সময় একই তথ্য একাধিকবার চলে আসছে। আবার অনেক দুর্ঘটনা ও হতাহতের তথ্য গণমাধ্যমে না আসায় সেই তথ্যও দেওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া কেন দুর্ঘটনা ঘটলো, হতাহতদের বয়স কত, তাদের লিঙ্গ পরিচয় ইত্যাদি তথ্যও ঠিকভাবে পাওয়া যায় না অনেক সময়। এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে একটি দুর্ঘটনার তথ্য ব্যাংক করা অথবা অ্যাপলিকেশন (অ্যাপ) তৈরি করা।

সেভ দ্য রোডের মহাসচিব শান্তা ফারজানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশন থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। আমাদের বিভিন্ন জেলায় থাকা স্বেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি পুলিশের কাছ থেকেও আমরা তথ্য নিয়ে থাকি। এসব তথ্যের ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ওপর প্রতিবেদন করে থাকি। আসলে কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্যগুলো সংগঠিত না থাকায় সংগঠনগুলোর তথ্যে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে।

সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যের গরমিল থেকেই যাচ্ছে

সমাধানে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ধরনের সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের খবর আসে গণমাধ্যমগুলোতে। ছোটখাটো দুর্ঘটনা কিংবা হতাহতের খবর অনেক সময় সংবাদ আকারে আসে না। আবার দুর্ঘটনার সময় হতাহতের সংখ্যা জানা গেলেও আহতদের থেকে পরবর্তীতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের হিসাব সেভাবে গণমাধ্যমে আসে না। সরকারের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা না জানানোর কারণে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর নির্ভর করতে হয় বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। এ জন্য একেক সংগঠনের দেওয়া তথ্য একেক রকম হচ্ছে। এর সমাধানে সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় একটি ডাটাবেজ করা বা তথ্য ব্যাংক করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।

যা বলছে বিআরটিএ
সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহত নিয়ে এই তথ্য বিভ্রাটের বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ’র দায়িত্বশীল কোনও কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আগে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য তারা সেভাবে রাখতেন না। এখন বেসরকারি সংগঠনগুলো নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সংস্থাটি এসব তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে। সংগঠনগুলো গণমাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে আর বিআরটিএ তথ্য নিচ্ছে বিভাগীয় অফিস থেকে। এ কারণে একেক সংগঠনের একেক রকম— এমনকি সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিআরটিএ’র তথ্যের অমিল হচ্ছে।

গত মাসে (মে) সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যের গরমিল ঠেকাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিআরটিএ জনসাধারণের সহায়তা কামনা করেছে। এক বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটি বলেছে, গত জানুয়ারি থেকে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করে যাচ্ছে বিআরটিএ। প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার এই তথ্য সারা দেশে বিআরটিএ'র ৬৪টি সার্কেল অফিসের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। একই সঙ্গে পুলিশ বিভাগ ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়। কোনও স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ বিআরটিএ অফিস অথবা বিআরটিএ সদর কার্যালয়ে (০১৫৫০০৫১৫৮২) এই নম্বরে যোগাযোগ করে তথ্য জানাতে।

/এফএস/এমওএফ/
টাইমলাইন: নাগরিক পরিবহন
১৩ জুলাই ২০২৩, ১০:০০
০৫ জুলাই ২০২৩, ১৬:০০
সড়কে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যায় কেন গরমিল?
সম্পর্কিত
শাহজাদপুরে ট্রাকের ধাক্কার রিকশাচালক নিহত
ডিবি পুলিশের গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ গেলো ব্যবসায়ীর
হবিগঞ্জের সড়কে ঝরলো একই পরিবারের চার সদস্যসহ ৫ জনের প্রাণ
সর্বশেষ খবর
বজ্রাঘাতে দুই জেলায় ৫ জনের মৃত্যু
বজ্রাঘাতে দুই জেলায় ৫ জনের মৃত্যু
ভাঙা হাটের দিন
ভাঙা হাটের দিন
ওটিটিতে উঠলো মস্কোজয়ী ‘আদিম’
ওটিটিতে উঠলো মস্কোজয়ী ‘আদিম’
গাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চার শতাধিক ইসরায়েলি হামলা
গাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চার শতাধিক ইসরায়েলি হামলা
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
মে দিবসে ফুঁসে উঠলেন সিনেমা শ্রমিকরা
মে দিবসে ফুঁসে উঠলেন সিনেমা শ্রমিকরা