মনে আছে সেই ফাতেমার কথা? ২০২২ সালের ১৬ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তঃসত্ত্বা মায়ের পেট ফেটে রাস্তায় জন্ম হয় ফাতেমার। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ওই দুর্ঘটনায় মা, বাবা ও বোনকে হারায় শিশুটি। শিশুটির স্বজনদের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় সরকার তাকে জায়গা করে দেয় রাজধানীর ‘ছোটমণি নিবাসে’। আজ মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) ফাতেমার দ্বিতীয় জন্মদিন। তার জন্য দিনটি আজ অন্যরকম। নিবাসের অন্য শিশুদের সঙ্গে হেসে খেলে, কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন করেছে ফাতেমা।
শিশু মণি নিবাসে অত্যন্ত পরম যত্নে বেড়ে উঠছে ফাতেমা। ধীরে ধীরে কথা বলা শিখছে। জন্মের পর একটি শিশুর প্রথম ডাক হয় ‘বাবা’ কিংবা ‘মা’। বাবা বা মায়ের সান্নিধ্য পাওয়ার সেই সৌভাগ্য হয়নি তার। তাই তার দেখভাল করা আয়াদের আপু বলে ডাকে, আর নিবাসে কাজ করা পুরুষদের ডাকে মামা। তবে ফাতেমা তার সঙ্গে থাকা অন্য শিশুদের চেনে। নাম ধরে জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দিতে পারে বলে জানান তার দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা।
আজ ফাতেমার জন্মদিন , তাই তার পরনে ছিল নতুন গোলাপি পোশাক। ছোটমণি নিবাসে শিশুদের থাকার জায়গা আজ সেজেছে নানা রঙয়ের বেলুনে। সকাল থেকেই শিশুরা নিবাসের ভেতর বেলুন হাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের মুখে মুখে বেলুন বেলুন বলে শোরগোল। আর তার মধ্যেই গতবছরের মতো বড় আকারের একটি কেক এবং উপহার নিয়ে হাজির হলেন যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। তার সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী এবং সন্তান।
সকালে ছোটমণি নিবাসে এসে তিনি প্রথমে ফাতেমা এবং অন্যান্য শিশুকে সঙ্গে কিছু সময় কাটান। নিবাসের শিশুদের খোঁজ খবর নেন তিনি। এরপর তারা ছোটমণি নিবাসের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট জুবলী বেগম রানুকে নিয়ে ফাতেমার জন্মদিনের কেক কাটেন। ছোট্ট এই শিশুর হাতে হাত রেখে সবাই যখন কেক কাটছিলেন, তখন চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল নিবাসের অন্য শিশুরা। ফাতেমার মুখে কেক তুলে দেওয়ার পর সবাইকে কেক খাওয়ানো হয়। এসময় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফাতেমা। হয়তো রক্তের সম্পর্কের কাউকে খোঁজার চেষ্টা ছিল তার।
কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, ‘মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা এবং ফাতেমার জন্ম হওয়ার ঘটনাটি আমাদের চরমভাবে নাড়া দিয়েছিল। সে কারণে তার জন্মদিনে আমরা তাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি। তাকে শুভেচ্ছা জানাতে আমার স্ত্রী ও ছেলে এসেছে। আমরা ফাতেমার সুন্দর ও উন্নত জীবন কামনা করছি।’
নিবাসের কর্মীদের মতে, দুর্ঘটনার ট্রমা এখনও হয়তো ফাতেমার মধ্যে রয়ে গেছে। নতুন কাউকে দেখলে নিস্তব্ধ হয়ে যায় ফাতেমা। নিজে থেকে হাঁটা চলা করতে পারলেও অপরিচিত কাউকে দেখলে আয়াদের কোলে আশ্রয় নেয়।
ছোটমণি নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম রানু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই শিশুরা পৃথিবীতে এসেছে কিন্তু জানেনা, তার আসার মাধ্যম কে। কে তার বাবা, কে তার মা, কে তার পরিবার তারা জানে না। ফাতেমা জানে তার একটা পরিবার আছে কিন্তু তাদের সঙ্গে তো তার যোগসূত্র নেই। আজকে ফাতেমার দুই বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু তার কথা সামগ্রিকভাবে সবাই ভুলে গেছে। আমি খুবই অবাক হলাম এত ব্যস্ততার মাঝেও নাবিল স্যার মনে রেখেছেন ফাতেমাকে। উনি সারা বছরই বিভিন্ন সময় খোঁজ নেন। ফাতেমার প্রথম জন্মদিনে উনি সশরীরে উপস্থিত ছিলেন, আজকেও আসলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটা যেমন ফাতেমার জন্য পাওয়া, একইসঙ্গে আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।’
ফাতেমা প্রসঙ্গে জুবলী বেগম রানু বলেন,‘ বাবা মায়ের আকাঙ্ক্ষা এসব শিশুদের মধ্যে এমনিতেই জাগ্রত হয়। ফাতেমার বিষয়টা আমার কাছে ভিন্ন মনে হয়। সব শিশুই মিশুক, কিন্তু ফাতেমা নতুন কাউকে দেখলে তার কেয়ারগিভার যারা, তাদের কাউকে না কাউকে আকড়ে ধরে। আমার কাছে মনে হয়, ফাতেমার জন্মের সময় যে ট্রমাটি ছিল সেটি তার মধ্যে থেকে গেছে। যদি কেউ তাকে দত্তক নিতে পারতো, তাহলে হয়তো বাবা মায়ের অভাব কিছুটা পূরণ হয়ে তার ট্রমা আস্তে আস্তে কেটে যেতো।’
জুবলী বেগম রানু জানান, এই মুহূর্তে নিবাসে ২০টি শিশু আছে।
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ১৬ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ট্রাকচাপায় নিহত হন জাহাঙ্গীর আলম (৪২), তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রত্না বেগম (৩২) ও ছয় বছরের মেয়ে সানজিদা। সে সময় ট্রাকচাপায় অন্তঃসত্ত্বা রত্নার পেট ফেটে সড়কে জন্ম নেয় ফাতেমা। তাদের বাড়ি ত্রিশাল উপজেলার রায়মনি এলাকায়।
ওই সময় শিশুটিকে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ভর্তি করা হয় নগরীর বেসরকারি লাবীব হাসপাতালে। সেখানে জন্ডিসসহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এনআইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন, ত্রিশাল উপজেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা অধিদফতর একাধিক সভা করে শিশু ফাতেমাকে ঢাকার আজিমপুরে ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর শিশুটির চিকিৎসাসহ ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে ছোটমণি নিবাসে পাঠানো হয়।
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন