X
বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫
২৫ বৈশাখ ১৪৩২

‘সামওয়ান’ কিলড মুনিয়া-তনু-লাভলী

উদিসা ইসলাম
১৮ আগস্ট ২০২৪, ১০:০০আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১০:০৬

গত এক দশকে বেশকিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে যেগুলোর সুরাহা হয়নি। ভুক্তভোগীদের দাবি, ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ মদদে এসব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মুনিয়া হত্যার দায়ে প্রধান অভিযুক্ত বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে দায়মুক্তিও দেওয়া হয়েছে। কুমিল্লার তনু হত্যা মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও আছে অভিযোগ। আর তাজরীন গার্মেন্টস অগ্নিকাণ্ডে আগুনে পুড়ে ১১৪ জন নিহতের মামলায় সাক্ষীই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ভুক্তভোগীদের স্বজনদের দিন কাটছে ন্যায় বিচারের আশায়। সরকার ও প্রশাসন বদলের পর নতুন করে এবার কী তারা ন্যয়বিচার পাবেন।

গত ২০ মার্চ মোসারাত জাহান মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরসহ ৮ জনকে। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক শওকত আলীর আদালত বাদীপক্ষের নারাজির আবেদন নাকচ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে এ আদেশ দেন।

মোসারাত জাহান মুনিয়া

মোসারাত জাহান (মুনিয়া) রাজধানীর একটি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। গুলশান-২ নম্বরের ১২০ নম্বর সড়কের একটি ফ্ল্যাট থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় রাতেই মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান বাদী হয়ে ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে গুলশান থানায় মামলা করেন। মামলায় সায়েম সোবহান আনভীরকে একমাত্র আসামি করা হয়। আনভীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।

এদিকে শুরু থেকে এই মামলা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা ও ক্ষমতাসীনদের সম্পৃক্ততায় যেন প্রভাবিত না হয় সেই শঙ্কা থেকে জাস্টিস ফর মুনিয়া প্ল্যাটফর্ম থেকে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি পালন হয়ে আসছে। ১৩ আগস্ট তাদের পেজ থেকে লেখা হয়, (Justice For Munia) বরাবরের অবস্থান ছিল (এবং আছে) যে, শেখ হাসিনা সরকার, বিশেষ করে তার তদন্তকারী এবং বিচার ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। আর এ কারণেই কলেজ শিক্ষার্থী মোসারাত জাহান মুনিয়ার ধর্ষণ ও হত্যার বিচার হচ্ছে না। স্বৈরাচারী সরকারের পতন মাত্র এক সপ্তাহ আগে হলো, চট করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক না। কিন্তু একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া একটি বার্তা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। ‘দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যবসায়ীদের আস্থা পেতে হবে।’ এ বিষয়ে আমরাও একমত। কিন্তু তার মানে কী এই যে ‘অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা’র অজুহাতে যেই ব্যবসায়ীরা এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছিল এবং প্রতিদানে তাদের অপরাধগুলো পার পাইয়ে দেওয়া হতো, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে না? তাহলে দুর্নীতিগ্রস্ত তদন্তকারী এবং বিচার ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হবে কীভাবে? আর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা গড়ে উঠবে কীভাবে?

সোহানী জাহান তনু

তনুর বাবা-মা বিচার পাবেন?

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যার আট বছর পূর্ণ হয়েছে চলতি বছরের ২০ মার্চ। দীর্ঘ এই সময়েও চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের কারণ কী ছিল এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত তা জানা যায়নি।

প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে মামলার তদন্তভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থেকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) স্থানান্তর করা হয়। তারাও এ মামলার কোনও কিনারা করতে পারেনি। কোনও আসামি শনাক্ত হয়নি।

২০১৬ সালের ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী তনুর মরদেহ কুমিল্লা সেনানিবাসের জঙ্গলে পাওয়া যায়। তনু সেনানিবাসের ভেতরে একটি বাসায় ওই দিন সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়াতে গিয়েছিলেন। রাতে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন।  মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ, তারপর ডিবি ও সিআইডি তদন্ত করে। গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

তনুর মরদেহের দুই দফা ময়নাতদন্ত করা হয়। কিন্তু ফরেনসিক রিপোর্টে হত্যার কোনও সুস্পষ্ট কারণ উল্লেখ করা হয়নি। ২০১৭ সালের মে মাসে সিআইডি তনুর জামা-কাপড় থেকে নেওয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে তিন জন পুরুষের শুক্রাণু পায়। ঢাকা সেনানিবাসে গিয়ে সন্দেহভাজন তিন জনকে জিজ্ঞাসাবাদও করে সিআইডি। কিন্তু কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ওই শুক্রাণুর সঙ্গে কারও ডিএনএ মেলানো হয়েছে কিনা, মিলেছে কিনা তা-ও কখনও প্রকাশ করা হয়নি। এরপর ২০২০ সালের নভেম্বরে মামলাটির দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআইকে।

এ অবস্থায় তনুর মা-বাবা বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। গত মার্চে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি আর বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী লাভ? গরিবের ওপর জুলুমের বিচার হয় না।’ তনুর মা আনোয়ারা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) ঢাকায় বসে বসে বক্তৃতা দেয়। আমাদের ডেকে পাঠিয়ে উল্টো হয়রানি করে। আমরা গরিব। তাই বলে আমরা কারও গোলাম না যে মেয়ে হত্যার বিচার পাবো না।’

সেই হতাশা ক্ষোভ থেকে বের হয়ে এখন দিন-রাত টিভির দিকে তাকিয়ে থাকেন এই মা। যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কবে তনু হত্যার বিচারের কথা বলবে! একবার যদি আমার মেয়ে হত্যার কথা বলে আমরা শুধু এই আশায় বসে থাকি। যার যায় সে বোঝে। অন্যরা বুঝবে কী করে?’

তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘গত সরকারের আমলে মেয়ের হত্যার বিচার পাবো না, এটা ভেবেই নিয়েছিলাম। কিন্তু নতুন সরকার আসায় অনেক কিছু পরিবর্তন দেখছি। আমি ভাবছিলাম টিভিতে আমার মেয়ের কথাও বলবে। কিন্তু একবারও বলেনি। ওর বাবা সারারাত জেগে থাকে। আমরা পালা করে টিভি দেখি একটা খবরের আশায়।’

তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ড

তাজরীনের আগুন নেভেনি

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন গার্মেন্টসে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। পুড়ে মারা যান ১১২ জন শ্রমিক। ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও স্বজন হারানো শ্রমিকের মনে এখনও জ্বলছে ছাইচাপা আগুন। আহত শরীরে কর্মহীন জীবনে, সম্মানজনক ক্ষতিপূরণের অধিকার আদায়ের যে আন্দোলন; সে আগুনও জ্বলছে বারো বছর ধরে।

লাভলী, রোকসানা, শাহ আলম, বুলবুলিরা সেদিন নিহত হলেও নিশ্চিন্তপুরে কোনও ‘সাক্ষী পাওয়া যায় না’।

ভয়াবহ ওই ঘটনার পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগ এনে মামলা করেন। মামলা দায়েরের ১২ বছর চললেও শেষ হয়নি বিচারকাজ। চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। মামলায় সাক্ষী ১০৪ জন। আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন ১১ জন। ১৯ আগস্ট পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে।

গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এই ঘটনার সাক্ষী সারা বিশ্ব। প্রত্যক্ষ সাক্ষী খোঁজার নামে দিনের পর দিন বিচার পিছিয়েছে। এই সাক্ষীদের পাওয়া যায় না, তাদের অনেকেই ওই নিশ্চিন্তপুরেই রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী হয় তা পরের তারিখে বোঝা যাবে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের বিচার পিছাতে যারা সহযোগিতা করে আসছে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান তাজরীন ফ্যাশনসের এমডি দেলোয়ারসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ঘটনার এক বছর ২৮ দিন পর আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিনি এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন—তাজরীন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আকতার, প্রতিষ্ঠানটির লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল আমিন, স্টোর ম্যানেজার হামিদুল ইসলাম লাভলু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল উদ্দিন ও প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আবদুর রাজ্জাক, কোয়ালিটি ম্যানেজার শহীদুজ্জামান দুলাল, প্রডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জু, নিরাপত্তারক্ষী রানা ওরফে আনারুল। 

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সাহায্য করেছেন বাংলা ট্রিবিউনের কুমিল্লা প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল মারুফ)

/আরআইজে/
সম্পর্কিত
রিমান্ড শেষে কারাগারে পলক
বেনজীর কন্যা তাহসিনের দুবাইয়ের ফ্ল্যাট জব্দ, ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের স্ত্রীর প্লট-ফ্ল্যাট জব্দ, ব্যাংক হিসাব-শেয়ার অবরুদ্ধ
সর্বশেষ খবর
জনগণের বিরুদ্ধে যায় এমন কাজ না করতে সরকারকে আহ্বান মির্জা ফখরুলের
জনগণের বিরুদ্ধে যায় এমন কাজ না করতে সরকারকে আহ্বান মির্জা ফখরুলের
বুদ্ধ পূর্ণিমায় ঢাকায় নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা
বুদ্ধ পূর্ণিমায় ঢাকায় নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে আইপিএল ম্যাচ স্থানান্তর
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে আইপিএল ম্যাচ স্থানান্তর
শতাধিক বিনিয়োগকারী নিয়ে ঢাকা আসছেন চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী
শতাধিক বিনিয়োগকারী নিয়ে ঢাকা আসছেন চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
‘সকালে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয় এএসপি পলাশের, দুপুরে অফিসে নিজ মাথায় গুলি’
‘সকালে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয় এএসপি পলাশের, দুপুরে অফিসে নিজ মাথায় গুলি’
দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
যশোরে তিনটি খাবারের দোকানের বিরুদ্ধে মামলা
যশোরে তিনটি খাবারের দোকানের বিরুদ্ধে মামলা
যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পাকিস্তানি দাবি ‘মিথ্যাচার’: চীনের ভারতীয় দূতাবাস
যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পাকিস্তানি দাবি ‘মিথ্যাচার’: চীনের ভারতীয় দূতাবাস