পাহাড়ের সমস্যা সমাধান করতে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কোনও বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকালে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর গুলিবর্ষণ, হত্যা, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের’ প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের ডাকা কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘অনেকেই বলে থাকেন পাহাড়ের আদিবাসীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী। কিন্তু আমি এক্ষেত্রে একটা কথা বলি, আপনারা অনেকেই দেখেছেন পাহাড়ে গত ১০ বছর আগেও সেভাবে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল না। কিন্তু টেলিকম কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিতো, বাংলাদেশের ৬১ জেলায় নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। কিন্তু বাংলাদেশের জেলা কি ৬১টি? পাহাড়ি মানুষজন সবসময় মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে আসতে চেয়েছিল। কাজেই যারা নেটওয়ার্কের মধ্যে আসতে চায় তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী নাকি যারা বিচ্ছিন্ন রাখতে চায় তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী? এ প্রশ্নগুলো থেকে যায়। পাহাড়ের সমস্যাকে নিরাপত্তার চশমায় না দেখে পাহাড়িদের চোখ দিয়ে দেখতে হবে। পাহাড়ের সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের কোনও বিকল্প নেই।’
মানবাধিকার কর্মী দীপায়ন খীসার সঞ্চলনায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে এই সমাবেশে লিখিত বক্তব্য পেশ করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খায়রুল ইসলাম চৌধুরী। সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য নাজমুল হক প্রধান, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সহকারী সাধারণ সম্পাদক খায়রুজ্জামান লিপন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম প্রমুখ।
অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘পার্বত্য সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের সমস্যার সমাধান হবে না। পাহাড়িরা নিরাপদ না থাকলে বাংলাদেশও নিরাপদ থাকবে না। সেই ১৯৭৬ সাল থেকেই পাহাড়ে যেভাবে সমস্যাগুলো বাড়িয়ে তোলা হয়েছে, তাতে ক্রমশ পাহাড়িদের অধিকারকে সংকুচিত করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর আমরা আশা করেছিলাম পার্বত্য সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সেই সমস্যার সমাধান হয়নি। কাজেই এই চুক্তি অবিলম্বে বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে।’
‘দেশে আর মৃত্যুর মিছিল দেখতে চাই না’, মন্তব্য করে খালেকুজ্জামান লিপন বলেন, ‘মব জাস্টিসের নামে আইনের লঙ্ঘন করা বন্ধ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে।’
খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটিতে সংঘটিত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ‘পাহাড়ের সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারকে সংবিধানে পাহাড়ি মানুষদের অন্তর্ভুক্তি করে একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম দীর্ঘদিন শান্ত ছিল, আবার অশান্তি শুরু হয়েছে উল্লেখ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শাহ আলম বলেন, ‘একটি মোটর সাইকেল চোরের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তৈরি করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর যখন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের মূল্যায়ন করা হয়নি, তখন থেকে পাহাড়ে অশান্তির শুরু হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের বোঝা উচিত একজন বাঙালি যেমন, চাকমারাও তেমনি। একজন চাকমা বাঙালি হতে পারেন না। কিন্তু একজন চাকমা, একজন মারমা, একজন বাঙালি; সবাই মিলে বাংলাদেশি হতে পারি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়া, ভূমি সমস্যার সমাধান না হওয়ার কারণে সেখানে আজকে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের চারপাশে যে ভূরাজনৈতিক টানাপড়েন হচ্ছে, সে বিষয়টি বিবেচনায় চুক্তির বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। একটি আধিপত্যবাদীর নিয়ন্ত্রণ থেকে আরেক আধিপত্যবাদীর নিয়ন্ত্রণে পর্যবসিত হয়েছি। এখনও আমরা প্রকৃত স্বাধীনতা পাইনি।’
সমাবেশ থেকে ৮ দফা দাবি জানানো হয়। দাবিগুলো হলো-
১. দ্রুত পাহাড়ে সংঘটিত ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
২. মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালা হামলার জন্য একটা স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
৩. খাগড়াছড়ি সদর, দিঘীনালা ও রাঙামাটিতে সহিংসতার শিকার পাহাড়ি অধিবাসীসহ তিন পার্বত্যজেলার জুম্ম জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. গুলিতে নিহত হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের সুচিকিৎসা প্রদানের অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. জুম্ম জনগোষ্ঠীর ক্ষতিগ্রস্থ বৌদ্ধ বিহার পুনর্নির্মাণ ও দোকানপাট ও বাড়িঘরের মালিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৬. দায়িত্বরত বিভিন্ন সংস্থা ও মহলের যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার জন্য সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় বিভাগীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৭. পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি স্তিতিশূল করার লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সংলাপ শুরু করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে
এবং ৮. পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রমের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখতে হবে।