X
বুধবার, ২৮ মে ২০২৫
১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মডেল তিন্নি হত্যা: একমাত্র আসামি খালাস, অপরাধী কে?

নাঈমুল হক
১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:২৪আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:৫৩

২২ বছর আগে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর বুড়িগঙ্গা নদীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর পিলারের পাশ থেকে মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নির (২৪) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরের দিন পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। এরপর সাত জন তদন্ত কর্মকর্তার হাত বদল হয়ে ৮ বছর পর ২০১০ সালে সাবেক ছাত্রনেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে  অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি।

দীর্ঘ ১৪ বছর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) বিকালে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোছা. শাহীনুর আক্তারের আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন।

রায় শুনতে আদালতে উপস্থিত ছিলেন পলাতক আসামি গোলাম ফারুক অভির রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী শাহ ইলিয়াস রতন। আর রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর সৈয়দ আবু জাফর রিজভী। তবে নিহতের পরিবারের কেউও উপস্থিত ছিলেন না।

বেলা ৩টা ১৫ মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। রায়ে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায় বিচারক বলেন, রায়ের সম্পূর্ণ অংশটি পড়া সম্ভব হবে না। সংক্ষিপ্ত আকারে মূল রায়টা জানাচ্ছি। এ মামলায় মোট সাক্ষী ছিলেন ৪১ জন। এর মধ্যে ২৬ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষী ও অন্যান্য উপাদান বিবেচনায় এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এ মামলা থেকে গোলাম ফারুক অভিকে খালাস দেওয়া হলো। এরপর বিচারক এজলাস কক্ষ ত্যাগ করেন।

রায়ের পর তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আজকে যে রায় হবে তা তো আমি জানতামই না। আমাকে কেউ জানায়নি। রায়ের খবর আপনারা প্রথম জানালেন। আমি কিছুই জানি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘তিন্নি খুনের পর অভিকে বিদেশে পালাতে সহায়তা করে তৎকালীন সরকার। এরপর অভিকে দেখিয়ে দেখিয়ে মামলায় এতদিন পার করলো। এখন রায় প্রচার হলো, অভি খালাস। আমার মেয়ে যে খুন হয়েছে সেটি তো সত্য। তাহলে আমার মেয়ের খুনি কে? তা জানার অধিকার কি আমার নেই? আমার এখন বয়স ৭৮ বছর। শরীরে দুই-দুইবার অপারেশন হয়েছে। শরীর ও মাথা আগের মতো কাজ করছে না। তাহলে কি আমার মেয়ে হত্যার বিচার পাবো না?’

তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে। আমি আর দৌড়াদৌড়ি করতে পারবো না। আমার বড় ভাই সৈয়দ রেজাউল করিম, তার অবস্থা আরও খারাপ। তিন্নির আরেক বোন তার মাকে নিয়ে আমেরিকার সানফ্রানসিসকোতে থাকে। আবার নতুন করে দৌড়াদৌড়ি করার কেউ নাই। মৃত্যুর আগে আমার মেয়ের খুনি কে দেখে যেতে পারবো না।’

রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অভির রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী শাহ ইলিয়াস রতন সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আদালত যা ভালো বুঝেছেন সেই রায় দিয়েছেন। এখানে আমার কোনও হাত নেই। এ রায়ে আমি খুশি। রাষ্ট্র আমাকে নিযুক্ত করেছে। আমি ন্যায়বিচারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এ মামলার তদন্তে কিছু ত্রুটি ছিল। পোস্টমর্টেম পর্যায়ে ত্রুটি ছিল। আমি সেটি তুলে ধরেছি। আর এ মামলার চাক্ষুষ সাক্ষী কেউ নাই। মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সুমনের কাছ থেকেও সরকার পক্ষ কিছু জানতে পারেনি।’

অভি যদি আসামি না হন, তাহলে তিনি পলাতক কেন? সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অভির সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। তিনি কেন আদালতে আসেননি, পালিয়ে আছেন—এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’

তবে রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ আবু জাফর রিজভী। তিনি বলেন, ‘৪১ সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও তদন্ত কর্মকর্তার রিপোর্ট বিবেচনা করে বিচারক আসামি অভিকে খালাস দিয়েছেন। এটি তো পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পেলে তথ্য-উপাত্ত দেখে পরবর্তী আপিল দায়েরের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তদন্ত কর্মকর্তার কোনও গাফিলতি ছিল কিনা, মূল রায় দেখে বলা যাবে। অনুমান করে বলা ঠিক হবে না। বিচারক রায়ে কোন বিষয়টি নিলেন, আর কোনটা বাদ দিলেন, তা না দেখে বলা যাচ্ছে না। মূল রায় হাতে পেলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।’

মামলার অভিযোগ বলা হয়, তিন্নির স্বামী পিয়ালের মাধ্যমেই তার সঙ্গে অভির পরিচয় হয়। এরপর তিন্নি ও অভির ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। স্বামী পিয়াল বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি। বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে অভি ২০০২ সালের ৬ নভেম্বর তিন্নিকে দিয়ে পিয়ালকে ডিভোর্স করান। অভির ইচ্ছা ছিল ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিন্নিকে ব্যবহার করে যাওয়া। বিয়ে করে তিন্নিকে স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়ার ইচ্ছা অভির কোনোদিনই ছিল না। বিষয়টি বুঝতে পেরেই তিন্নি তাকে বিয়ের জন্য অভিকে চাপ দেন। কিন্তু অভি বিয়ে করতে অস্বীকার করেন। তখন অভির সব গোপন খবর মিডিয়ায় ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন তিন্নি। এরপর ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে ঢাকার কেরানীগঞ্জের চীন মৈত্রী সেতুর ১১ নম্বর পিলারের পাশে তিন্নির লাশ পাওয়া যায়।

তিন্নিকে না পেয়ে তার চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। ২০০২ সালের ১১ নভেম্বর অজ্ঞাত হিসেবে তিন্নির মরদেহ উদ্ধারের পর অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেন কেরানীগঞ্জ থানার এএসআই মো. সফি উদ্দিন।

এরপর মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় ওই থানার এসআই মো. কাইয়ুমকে। মরদেহের ছবি পত্রিকায় ছাপা হলে নিহতের এক আত্মীয় সুজন তিন্নির মরদেহটি শনাক্ত করেন। পরে একই বছর ২৪ নভেম্বর তদন্তভার ন্যস্ত হয় সিআইডিতে। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির পরিদর্শক ফজলুর রহমানকে। একে একে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পরিদর্শক সুজাউল হক, এএসপি গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ এবং এএসপি মোজাম্মেল হক। সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক একমাত্র আসামি গোলাম ফারুক অভিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১০ সালের ১৪ জুলাই অভির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত। এরপর চার্জশিটভুক্ত ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন আদালত।

২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করেন আদালত। তবে ওইদিন এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষী তিন্নির বাবা ও চাচা সাক্ষ্য দিতে চাইলে আদালত রায় মুলতবি করে সাক্ষ্যগ্রহণ চালিয়ে যান।

/এনএইচ/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সাম্য হত্যার মামলায় রিমান্ডে আরও দুজন, দায় স্বীকার নাহিদের
নিউ মার্কেটে ঢাবির ২ শিক্ষার্থীর ওপর ব্যবসায়ীদের হামলা: ৩ জন রিমান্ডে 
ঢাকাইয়া আকবরকে গুলি করে হত্যা: সন্ত্রাসী সাজ্জাদের ভাই-ভাগনে গ্রেফতার
সর্বশেষ খবর
জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে ডিএমপির প্রতিনিধিদল
জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে ডিএমপির প্রতিনিধিদল
২০৩১ সাল পর্যন্ত ইয়ামাল বার্সেলোনার
২০৩১ সাল পর্যন্ত ইয়ামাল বার্সেলোনার
জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের খালাসের প্রতিবাদে বিক্ষোভ
জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের খালাসের প্রতিবাদে বিক্ষোভ
পান্তের সেঞ্চুরি ছাপিয়ে দারুণ জয়ে প্রথম কোয়ালিফায়ারে বেঙ্গালুরু
পান্তের সেঞ্চুরি ছাপিয়ে দারুণ জয়ে প্রথম কোয়ালিফায়ারে বেঙ্গালুরু
সর্বাধিক পঠিত
সৌদি আরব থেকে উট এনে খামারে লালন-পালন, প্রতিটির দাম ৩০-৩২ লাখ
সৌদি আরব থেকে উট এনে খামারে লালন-পালন, প্রতিটির দাম ৩০-৩২ লাখ
ঈদের আগেই বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-বোনাস পরিশোধের নির্দেশ
ঈদের আগেই বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-বোনাস পরিশোধের নির্দেশ
নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয় দখলের চেষ্টা
নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয় দখলের চেষ্টা
একীভূত করা ব্যাংকের আমানতকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান
একীভূত করা ব্যাংকের আমানতকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান
সচিবালয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে বাইরে ২ ছাত্র সংগঠনের অবস্থান
সচিবালয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে বাইরে ২ ছাত্র সংগঠনের অবস্থান