কান্নাজড়িত কণ্ঠে বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদীন নূর পরশের বাবা নুর উদ্দিন রানা বলেছেন, ‘একটা কষ্ট হচ্ছে, আবরারকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অথচ আমার সন্তানকে আত্মহত্যার অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। আজ দুই-আড়াই বছর হয়ে গেছে। আজও এ অপবাদ থেকে মুক্ত হতে পারেনি সে। বিগত সরকার দুই মাস ৮ দিনে তদন্ত শেষ করতে পারলো। সেটার তদন্ত করতে কেন এখন দুই বছর সময় লাগবে? তাদের কাছে মূলত বিশ্বাসযোগ্য কোনও ডকুমেন্টস ছিল না। সেজন্য মূলত সময়ক্ষেপণ করেছে।’ বর্তমান সরকারের দিকে তাকিয়ে আছি। আশা করি, তারা একটা বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন দেবে।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর রাত থেকে নিখোঁজ ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ। পরের দিন রাজধানীর রামপুরা থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা কাজী নূর উদ্দিন। নিখোঁজের তিনদিন পর ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিন নূর পরশের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। ৮ নভেম্বর সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে ফারদিনের মরদেহ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার দেউলপাড়া কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় বান্ধবী বুশরাসহ অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে হত্যা করে লাশ গুম করার অভিযোগে রামপুরা থানায় ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বাদী হয়ে মামলা করেন। ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ফারদিনের বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরার অব্যাহতি চেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ইয়াসিন শিকদার। ১৬ এপ্রিল ডিবি পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মামলার বাদী নুর উদ্দিন রানার নারাজির আবেদন মঞ্জুর করে সিআইডিকে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। এরপর থেকে দীর্ঘ প্রায় দুই বছর পার হলেও এখনও কোনও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি সিআইডি তদন্ত কর্মকর্তারা। অভিযোগ রয়েছে, অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনে দেওয়ার পর তদন্ত কাজ থেমেই ছিল। সরকারের পট পরিবর্তনের পর সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার সরাফত উল্যা তিন মাস তদন্ত কাজ পরিচালনা করার পর নতুন করে দায়িত্ব পেয়েছেন আরেক কর্মকর্তা মশিউর রহমান। গত ১২ ফেব্রুয়ারি আদালত এ মামলার অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ পিছিয়ে ১৫ মার্চ দিন ধার্য করেন।
ফারদীনের হত্যার ব্যাপারে তার বাবা নুর উদ্দিন রানা বলেন, আমার সন্তানকে ছাত্রলীগ পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। এতে সরকারের সহযোগিতা ছিল। এ কথাটা ফারদীন হত্যার পর পরই আমি বলতে চেয়েছি। কিন্তু আইনজীবীসহ অনেকে আমাকে বলেছেন, ছাত্রলীগের কথা বললে আপনি বিচার পাবেন না। এ মামলাটা করতে গিয়ে রামপুরা থানা আমাকে চার ঘণ্টা ঘুরিয়েছে। তারা প্রথমে মামলা নিতে চায়নি। যে দিন বুশরাকে অব্যাহতি দেওয়া হল, ওইদিন আমি বলেছি, এটা ছাত্রলীগের কারণে হয়েছে। এবং দুইজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম বলছি। সে দিন রাত সাড়ে ১২টা বাজে আমার বাসার গলিতে পুলিশ এসেছে।
ফারদীনকে হত্যার উদ্দেশ্য কী হতে পারে সে কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, পরের বছর ছিল জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনের আগে দেশের সকল ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতিকে সোচ্চার করাই ছিল তাদের টার্গেট। কিন্তু বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেটার বিরুদ্ধে লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার ক্যাম্পেইন করে। ফারদীন বুয়েট ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি থাকুক এটা কখনোই চায়নি।
আবরারকে আমার ছেলে ধারণ করেছে। সে একটা আর্কাইভ করেছে, আমিই আবরার। ফারদীন বুয়েট ডিবেটিং ক্লাবের সেক্রেটারি ছিল, সেজন্য লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে সে ছিল প্রথম সারিতে। সে একটা পোস্ট করেছে, হাউ টু সার্ভাইভ ইন দিস কান্ট্রি। তার এ পোস্টে সে দেখিয়েছে, চোখ, কান, নাক বন্ধ রাখতে হবে। এটাতে দুই হাজারের উপরে রিয়েক্ট পড়েছে। এসব কারণে আমার মেধাবী ছেলেটা তাদের টার্গেটে পড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, আবরার ফাহাদের হত্যাটা বুয়েট ক্যাম্পাসে হওয়ায়, সুবিধা করতে পারেনি। এ হত্যায় ওদের ২৫ জন কর্মী হারিয়েছে। সেজন্য ফারদীনের ক্ষেত্রে ওরা ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। এবার ওরা ক্যাম্পাসের বাইরে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্যাম্পাসের বাইরে হলে প্রশাসনের কোনও ঝামেলা থাকে না। ফারদীনের বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাকে ট্যাপ করেই ওরা ফারদীনকে হত্যা করেছে। ছেলেটা আমাকে বাসা থেকে বলে গেছে, গ্রুপ স্টাডি করবে। হলে যাবে। পরের দিন পরীক্ষা শেষে এসে পুঁইশাক দিয়ে মাছ দিয়ে ভাত খাবে।
পুলিশের তদন্তে আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ তদন্তের বিষয়ে তিনি নারাজি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বলেন, পুলিশ তদন্তে রামপুরা ও যাত্রাবাড়ীর সিসিটিভি ফুটেজের কথা বলে। চার ঘণ্টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে সে ছিল। কোথাও একটা ফুটেজ নাই। এসব এলাকার অল্প সময়ের ফুটেজ দেওয়া আছে। সিসিটিভির ফুটেজ তো দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। তাহলে অল্প সময়ের ফুটেজ কেন দেওয়া হল? তাকে মূলত রামপুরা থেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এরপর কেরানীগঞ্জ ব্রিজ, বাবু বাজার ব্রিজ নেওয়া হলো, এরপর গুলিস্তানের পাতাল মার্কেটে নেওয়া হলো। সেখানে তার উপর নির্যাতন হয়, তার পা ভেঙে দেয়। সেখান থেকে ওয়ারী এলাকায় ছিল ১ ঘণ্টা। সেখানে তার সঙ্গে কারা ছিল, সেখানে কী কী করেছে? ওখানের সিসিটিভি ফুটেজ কোথায়। তারা যাত্রাবাড়ীতে তাকে ছেড়ে দেওয়ার নাটক করে। তার সঙ্গে লেগুনাতে উঠা অন্যরা কারা? আর সে যদি আত্মহত্যাই করবে, তাহলে এতোগুলো ব্রিজ ঘুরার কী প্রয়োজন ছিল। সে তো হাতিরঝিল থেকেই লাফ দিতে পারতো। ওটাতো আরও সহজ ছিল৷ সর্বশেষ দুই বছর যে কেরানীগঞ্জ সে যায়নি। পরীক্ষার আগের রাতে সেখানে কেন যাবে? মূলত, তারা রাজধানীর মধ্যে তাকে মেরে ফেলার সাহস করতে পারেনি। যদি কেউ দেখে ফেলে, সেজন্য তারা তাকে রাজধানী থেকে দূরে সুলতানা কামাল ব্রিজের ওখানে নিয়ে যায়। ব্রিজের উপর থেকে নাকি আমার ছেলে লাফ দিয়েছে। সে ফুটেজ কোথায়? মিডিয়ায় সেটি আসেনি কেন? বালিশে মতো একটা জিনিস ছড়িয়ে সেটাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পরে তারাই (পুলিশ) সে ভিডিও সরিয়ে নেয়। তারা জানে, এ স্ক্রিপ্ট দুর্বল হয়েছে। আমার সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা ছেলে, লাফ দিলে তো প্রথমে রেলিংয়ের উপরে উঠবে। তদন্তে তারা আত্মহত্যার কারণ হিসেবে লিখেছে, আর্থিক অসচ্ছলতা ও স্পেনে যাওয়ার টাকা না থাকা। অথচ আমার সন্তান উদ্ভাসে ক্লাস নিতো। লাখ টাকার মতো তার আয় ছিল। আর আমাদেরও তো টাকা পয়সা আছে। ফারদীন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতেছিল। সে ছিল তার ক্লাসের রিপ্রেসেন্টেটিভ। এখানে খরচের কোনও প্রয়োজন ছিল না। এগুলোতে স্পন্সর থাকে।
আগের তদন্ত কর্মকর্তা মাত্র ৩৮ দিনে তদন্ত করে, একটা মিথ্যা গল্প সাজিয়েছে। আমি নারাজি দেওয়ার পর অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিগত সরকার চায়নি বিধায়, অধিকতর তদন্ত হয়নি। আমাকে অনেকে বলেছে, এটা সাগর-রুনির মতো হবে। তদন্ত পেছাবে, কোনও লাভ হবে না। আমি আশা ছাড়িনি। কিন্তু ওনি বদলি হওয়ায় বর্তমানে এ মামলা গেছে মশিউর রহমানের কাছে। ওনি আবার পুনরায় মামলাটি দেখছেন। আশা করি, সঠিক তদন্ত হবে। প্রকৃত খুনিদের বিষয় আমরা জানতে পারবো।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমান বলেন, আমি কয়েকদিন আগে দায়িত্ব পেয়েছি। আজই মামলাটি দেখছিলাম। মামলার তদন্ত কাজ চলমান। এ মুহূর্তে কোনও কিছুই বলতে পারবো না। তদন্ত শেষ হলে আপনারা জানতে পারবেন।