বিচার বিভাগে মামলাজট ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রতিবন্ধকতা। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে একদিকে যেমন সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট হয়, তেমনই বিচারপ্রার্থীদের মাঝেও বাড়তে থাকে হতাশা। তাই বিচার বিভাগের মামলাজট নিরসনে উদ্যোগেরও যেন শেষ নেই। তবু বছর শেষের হিসাবে নিষ্পত্তির হারের তুলনায় মামলাজট বৃদ্ধিতে হিমশিম খেতে হয় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগকে।
আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণ করা হয়েছিল বিচার বিভাগকে। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিচারাধীন মামলা সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লাখ ৭০ হাজার। এরপর ধাপে ধাপে আদালত ও বিচারকের সংখ্যা বাড়লেও থেমে থাকেনি মামলা বৃদ্ধির আধিক্য।
সুপ্রিম কোর্ট থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, সুপ্রিম কোর্টসহ সারা দেশের আদালতে বর্তমানে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪৫ লাখ ১৬ হাজার ৬০৩টি। প্রচলিত বিভিন্ন আইনে অধস্তন আদালতের জেলা ও দায়রা জজসহ সব ধরনের ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩২টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭টি ও ফৌজদারি ২২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৮৫টি মামলা বিচারাধীন আছে।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ১২০টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৯ হাজার ২৯১টি, ফৌজদারি ১১ হাজার ৬১৯টি ও অন্যান্য ২১০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫১টি মামলা। এর মধ্যে দেওয়ানি ৯৮ হাজার ৬১৯টি, ফৌজদারি ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৮১টি, রিট মামলা এক লাখ ১৫ হাজার ২১২ এবং বিবিধ ২০ হাজার ৮৩৯টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। শুধু ২০২৩ সালের মামলার সঙ্গে ২০২৪ সালে যুক্ত হয়েছে আরও প্রায় ২ লাখ ১৭ হাজার মামলা।
দীর্ঘ এই মামলাজট নিরসন ও বিচারপ্রার্থীদের দ্রুত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অপ্রতুল বিচারক সংখ্যা ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামো উন্নয়ন বাধা বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট ও পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলছেন তারা।
মামলাজট নিরসনে ২০২৩ সালের ২৮ আগস্ট একটি প্রতিবেদন দেয় আইন কমিশন। ওই প্রতিবেদনে ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে জটের মূল পাঁচটি কারণ হিসেবে পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা, বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা, জনবলের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামোর দিকগুলো তুলে ধরা হয়।
এদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। বিচার বিভাগের বড় পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে তিনি একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। এছাড়া বিচার বিভাগের সংস্কারের জন্য একটি কমিশনও গঠিত হয়। চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে মামলাজট কমানোসহ ৩২টি বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরা হয়। কমিশনের সুপারিশে মামলাজট নিরসনে সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠন, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অধস্তন আদালতের বিচারক সংখ্যা অন্তত ৬ হাজারে উন্নীত করা, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ, বিচার বিভাগকে যথাসম্ভব নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা, বিচার বিভাগের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সারা দেশের আদালতগুলোতে মামলাজট একটি বড় সমস্যা। বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার চাইতে আদালতে আসেন। তাদের সমস্যার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। আমাদের বার (আইনজীবী সমিতি) এবং বেঞ্চকে (বিচারকদের) এক হয়ে কাজ করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই জট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মামলাজট নিরসনসহ আরও কিছু বিষয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতি রোডম্যাপ দিয়েছেন। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। নয়তো এই জট দিন দিন বাড়তেই থাকবে।’
মামলাজট নিরসনের আরও গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিচারকের স্বল্পতা, মামলার তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, অনলাইন সুবিধার অনুপস্থিতি, ই-ফাইলিং সুবিধা না থাকা এবং দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধির যুগোপযোগী সংশোধন না করাসহ এই মোট পাঁচ কারণে দেশে মামলাজট বেড়ে চলেছে। তবে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে সমন এবং মামলা মুলতবির বিধানে সংশোধনী আনা হচ্ছে, বাকি চারটি প্রতিবন্ধকতা দূর করা গেলে মামলাজট অবশ্যই কমে আসবে।’