X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন তারা

নুরুজ্জামান লাবু ও আমানুর রহমান রনি
৩০ জুন ২০১৭, ১৩:৪৯আপডেট : ০১ জুলাই ২০১৭, ১৭:১৬


হলি আর্টিজান ঘিরে সেনা কমান্ডোদের অভিযান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার সেই রাতটি ছিল বিভীষিকাময়। জঙ্গিরা রাতভর অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রেখেছিল ২৫ জনকে। এর মধ্যে রেস্তোরাঁর স্টাফ ছিলেন ১৪ জন। এদের মধ্যে সাত জন সেই দুর্বিষহ রাতের স্মৃতিচারণ করেছেন বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকদের সঙ্গে।। তাদের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হলো-

শিশির সরকার (পাস্তা শেফ): হলি আর্টিজান বেকারির পাস্তা শেফ হিসেবে কর্মরত ছিলেন শিশির সরকার। দুই সন্তানের জনক শিশির সরকারের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার খুললাবাদ এলাকায়। হলি আর্টিজানে হামলার দিন তিনি কোল্ড রুমে এক জাপানি নাগরিকের সঙ্গে তিনঘণ্টা পালিয়ে ছিলেন। রাত ১২ টার দিকে জঙ্গিরা জাপানি নাগরিককে নিয়ে গিয়ে খুন করে। রাতে জঙ্গিরা যে খাবার খেয়েছিল, তা শিশিরকে দিয়েই তৈরি করিয়েছিল।

শিশির সরকার বলেন, ‘রাত পৌনে ৯ টার দিকে হঠাৎ গেস্টদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে উঁকি দিয়ে অস্ত্রধারী জঙ্গিদের দেখতে পাই। এরপর জাপানি নাগরিকসহ কোল্ড রুমে ঢুকে পড়ি। আমি ভাবি, হয়তো ডাকাত বা বড় সন্ত্রাসী ঢুকেছে, তারা টাকা পয়সা নিয়ে চলে যাবে। আমরা দুজনই চিলে কোঠা বা কোল্ড রুমের  দরজার রাবারের অংশটা ধরে রাখছিলাম। যেন বাইরে থেকে টেনে খুলতে না পারে। আমি কান পেতে ‘আল্লাহ আকবর’ আর ফায়ারিংয়ের শব্দ শুনেছি। কিছুক্ষণ পর ফায়ারিংয়ের শব্দ বন্ধ হয়ে যায়।’

 সেদিনের হলি আর্টিজান,একজন বিদেশির ধারণ করা ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি শিশির বলেন, ‘রাত ১২ টার দিকে চিলার বা কোল্ড রুমের বাইরে থেকে দরজা টানে জঙ্গিরা, খোলার জন্য। কিন্তু ভেতর থেকে দরজা টেনে ধরে ছিলমাম আমরা।  কোল্ড রুমে ঠান্ডায় আমরা কাঁপতে ছিলাম। হঠাৎ দরজাটা খুলে যায়। দরজা খোলার পর আমি জঙ্গি রোহানকে দেখতে পাই। পরে পেপারে দেখে ওকে চিনেছি। এরপর আমাকে নিচে যেতে বললে, আমি সামনে গিয়ে বসি। গেস্টদের লাশ ও রক্ত ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘অনেকক্ষণ পর একজন জঙ্গি, লম্বা মতো, তার নাম মনে হয় নিবরাস, ও আইসা জিজ্ঞাসা করল যে, তোমাদের মধ্যে ওয়াইফাইয়ের পাসওয়ার্ড কে জানে? যে জানো তাড়াতাড়ি বলো। পরে ভয়ে শাহরিয়ার বলল যে আমি জানি। ও (জঙ্গি) বলল যে এই মোবাইলে পাসওয়ার্ড দাও। ওরে একটা মোবাইল দিলো। ওরা (জঙ্গিরা) এর পরে মোবাইল দিয়ে লাশের ছবি তুলছে, কোথায় কোথায় যেন কথা বলল। ওদের কাছে টর্চ লাইট ছিল।’

শিশির বলেন, ‘রাত দুইটা কি আড়াইটার দিকে জঙ্গিরা বলে তোমাদের মধ্যে বাবুর্চি কে? তখন অন্যরা আমাকে দেখিয়ে দেয়। জঙ্গিরা বলল যে আসো। আমাদের কিচেন রুমটা ভেতর থেকে আটকানো ছিল। ওইটা ওরা খোলার জন্য কোপাইছে। আমাকে বলল যে, কেউ ভেতরে থাকলে খুলতে বলো। কিন্তু কেউ খুলেনি। পরে আমি পেছন থেকে গিয়ে দরজা খুলেছি। আমার সঙ্গে দুই জঙ্গিও সেখানে যায়। গিয়ে গ্যাসের চুলাগুলো বন্ধ করি। জঙ্গিরা জানতে চাইলো, মাছ কী কী আছে? পরে বললাম যে সি-বাস’সহ সব ধরনের মাছ আছে। আমারে জিজ্ঞাসা করল কোরাল মাছ আছে? আমি বললাম আছে। বলে যে বের কর। বের করলাম। বলল যে আর কী আছে? চিংড়ি আছে? বললাম, আছে। আমি ওগুলো বের করে দিলাম। ওরা বলে এগুলো মশলা দিয়ে ফ্রাই কর। ওদের কথা মতো মাছগুলো আমি তেলে ফ্রাই করলাম। পরে তা প্লেটে করে তাদের দিলাম। জঙ্গিরা খাবারগুলো গেস্টদের দিলো আর আমাদের বলল যে, তোরা মিলে সেহরি কর। কিন্তু কারও পেটে খাবার যায় না। কেউবা ভয়তে মুখ লাগিয়ে ছিল।’

আকাশ খান (সহকারী কুক): হলি আর্টিজান বেকারিতে সহকারী কুক হিসেবে কর্মরত ছিলেন আকাশ খান। গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদীখান এলাকার শেখর নগরে। ১ জুলাই নারকীয় জঙ্গি হামলার দিন আকাশ অন্যদের মতো জিম্মি অবস্থায় ছিলেন। সারা রাত তাদের কেটেছে একটি বাথরুমে বন্দি হয়ে।

আকাশ খান বলেন, ‘ঘটনার সময় সবার দৌড়াদৌড়ি দেখে মনে হয়েছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। গেস্টরা দেয়ালের পেছনে দৌড়াইছে, লুকাইছে, টেবিলের নিচে ঢুকছে। আমিও দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলাম। তখন দেখলাম অর্ডার টেবিলের পাশে আমার বিপরীত দিকে ঘুরে দাঁড়ানো একটি ছেলে, কাঁধে ব্যাগ। হাতে বড় একটা অস্ত্র। তা দিয়ে গেস্টদের লক্ষ্য করে পাখির মতো গুলি করছে। তা দেখে আমি সবার সঙ্গে ওয়াশ রুমে পালাই। সেখানে ঢুকে আমরা স্যাররে (হলি আর্টি আর্টিজানের সাদাত মেহেদি) ফোন দিয়ে বিষয়টি জানাই। তাকে পুলিশ পাঠাতে বলি। আমি ভাবছি, ওরা ছোট সন্ত্রাসী  ছিনতাই করে চলে যাবে। কিন্তু তারা যায়নি। রাত সোয়া দুইটার দিকে ওরা আসে। এসে দরজায় টোকা দিয়ে বলে ভেতরে কারা আছো, বাইর হও। আমরা কোনও কথা বলি নাই। তখন বলে যে, বের হবা নাকি গ্রেনেড মাইরা সব উড়ায়া দেবো। তখন তো মনে করেন কী করব? আর কিছু করার নাই। দরজা খুললাম। দুটা ছেলে দুই পাশ থেকে আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। বিদেশি আছে কিনা চেক করলো। ওরা চেক করে আবার বাইরে থেকে আটকে দিয়ে চলে গেল। দরজাটা লাগানোর পর বিন্দুমাত্র ফাঁক ছিল না। তখন মনে করেন যে এমন অবস্থা, আমরা শ্বাস কষ্টে এতটা পরিমাণ কষ্ট করছি, এইটা কাউকে বইলা বোঝানো সম্ভব না।’

হলি আর্টিজান বেকারি তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার মালিককে ফোন দিয়ে জানাচ্ছিলাম, ভেতরে কেউ শ্বাস নিতে পারছি না। স্যার বলল, পানির কল ছেড়ে দাও, সেখান থেকে অক্সিজেন আসবে। দরজার নিচে ছোট্ট ফাঁকা দিয়ে পালাক্রমে নাক দিয়ে অক্সিজেন নিছি শুয়ে শুয়ে। আমাদের মালিক জানালো, আর্মি আসছে। তোমরা ফজর পর্যন্ত অপেক্ষ করো। এরপর আমরা আজান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের নয় জনের মধ্যে দুই জন প্রায় অজ্ঞানের মতো অবস্থা। সমীর আর  তার ভাগ্নে রিন্টু। আমাদেরও শ্বাসকষ্টে বুকে ব্যথা উঠে গেছে।  যখন দেখি যে আর সম্ভবই না। পরে আমরা সবাই ডিসিশান নিলাম যে, এইভাবে মরার চাইতে গুলি খেয়ে মরা অনেক ভালো। যা থাকে কপালে, দরজা ভাঙি। আমরা দরজায় অনেক পিটাপিটি শুরু করি। এরপর ভোরের দিকে জঙ্গিরা এসে দরজা খুলে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘ওদের (জঙ্গি) কথা থেকে বুঝতে পারছি যে, ওদের মূল টার্গেটই আছিল বিদেশিরা।ওরা আমাদের বলছিল, ইউরোপিয়ানরা বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের কালচার নষ্ট করছে। তাই বিদেশিদের হত্যা করা হয়েছে। ওরা বিভিন্ন কথা বলার পর বলে যে, আমরা এখন বের হয়ে যাবো। বলেই তারা বলল যে, বিদায়। জান্নাতে দেখা হবে। এইটা বলেই ওরা বের হয়ে যায়।’

মিরাজ হোসেন (বেকারি কুক): হলি আর্টিজানের বেকারি শাখার সহকারী কুক হিসেবে কাজ করতেন মিরাজ হোসেন। বাবার নাম লাল মিয়া হাওলাদার। গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের পূর্ব নলুয়াতে। জঙ্গি হামলার সময় তিনি দোতলায় আইসক্রিম বানাচ্ছিলেন। গোলাগুলির শব্দ শুনে তিনি দোতলাতেই লুকিয়ে ছিলেন। পরে জঙ্গিরা তাকে বের করে দোতলায় জিম্মি করে রাখে।

হামলাস্থলে ছুটে আসে সেনাবাহিনী মিরাজ বলেন, ‘হঠাৎ রাত পৌনে ৯ টার দিকে (আনুমানিক) একটা শব্দ হলো। আমার সহকারী জুবায়ের আমাকে বলল যে, ভাই গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। আমি বলতেছিলাম, নারে, গুলি না, হয়তো ওয়েটারের হাত থেকে গ্লাস পড়ে ভেঙে গেছে। জুবায়ের বলে না ভাই, গোলাগুলির শব্দ হইতেছে। তারপর আমিও শুনি। এরপর আমি পালাই। আমি এক চিপার মধ্যে একটা কার্টনের ওপরে বসে ছিলাম। জঙ্গিরা ওপরে এসে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে আমি বলি যে, আমি স্টাফ। আমার ধর্মের বিষয়ে বিষয়ে জানতে চায়। আমি তাদের জানাই, আমি মুসলমান। তখন বলে যে, সুরা ফাতিহা পড়ো। আমি সুরা ফাতিহা পাঠ করলাম। তারপর বলে যে, আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা মুসলমানদের কোনও ক্ষতি করব না। যারা ইহুদি-খ্রিস্টান, যারা আল্লাহর শিরক করে তাদের আমরা ধ্বংস করব। আমি বসা অবস্থায় ছিলাম। ওরা চলে গেল।’

তিনি বলেন, ‘জঙ্গিরা হত্যাকাণ্ডের পর দু’টি মোবাইল ব্যবহার করেছিল। একটিতে ছবি তুলে, আরেকটিতে বাইরে যোগাযোগ করছিল।

শিশির বৈরাগী (সহকারী কুক): হলি আর্টিজান বেকারিতে সহকারী কুক হিসেবে কাজ করতেন শিশির বৈরাগী।  বাবার নাম অশোক বৈরাগী। গ্রামের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝড়ার জোবারপাড় এলাকায়। বিবাহিত শিশিরের স্ত্রীর নাম স্মৃতি বৈরাগী। তার সাত বছর বয়সী ছেলে শান্ত বৈরাগী। জঙ্গি হামলার সেই রাতে শিশির কিচেনে কাজ করছিলেন। হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলে অন্য সহকর্মীদের মতো তিনিও স্টাফ টয়লেটে গিয়ে আশ্রয় নেন। সারারাত সেখানে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। ভয়ঙ্কর সেই রাতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে শিশির বলেন, ‘সারারাত ধরে মাঝেমধ্যেই গোলাগুলি হইছে। মানুষের চিৎকারের শব্দও পেয়েছি। ওরা আমাদের টয়লেটের সামনে দিয়ে হাটাহাটি করে। জঙ্গিরা কিছুক্ষণ রেস্টুরেন্টের বাতি বন্ধ করে দিছিল। কিছুক্ষণ পর আবার জ্বালিয়ে দেয়।’

সকালে ছাড়া পাওয়ার পর শিশিরসহ চার জন পেছনের  দিক দিয়ে লাফিয়ে পড়েছিলেন। শিশির বলেন, ‘লাফিয়ে পড়ার পর র‌্যাব সদস্যরা আমাদের ধরে নিয়ে যান। পানি খাওয়ায়। পরে আমাদের ডিবি অফিসে নিয়া যায়। ডিবি অফিসে নিয়ে স্যারেরা আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে। তারা আমাদের দুই বেলা নাস্তা খাওয়াইছে। পানি খাওয়াইছে।  ডিবিতে আমরা ১৯ জন ছিলাম। সেদিনই বিকালে আমাদের ছাইড়া দিছে। আমাদের বলছে, তোদের ছেড়ে দেওয়া হবে। আমাদের ঠিকানা লিখে নিছে। ঘটনার বর্ণনা লিখে নিয়ে সিগনেচার নিছে। আর ছবি তুইলা রাখছে।’

দেলোয়ার হোসেন (সহকারী কুক): দেলোয়ার হোসেন। হলি আর্টিজান বেকারির সহকারী কুক। ছয় বছর ধরে মালিক সাদাত মেহেদীর সঙ্গে কাজ করছেন। পুরনো স্টাফ। বাবার নাম মৃত আব্দুল শহীদ। গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের পূর্বচর মটুয়া এলাকায়।

স্বজনদের আহাজারি দেলোয়ার বলেন, ‘হামলার সময় সবাই বলতেছিল ডাকাত, মানুষ মারতেছে, পালাও। তখন আমরাও মেইন গেট দিয়ে বাইর হওয়ার জন্য গেছি। কিন্তু দেখি বাকি স্টাফরা আবারও ভেতরের দিকে আসতেছে। এরপর আমরাও ভেতরে আসি টয়লেটে লুকাই। আমরা আট জন গিয়া টয়লেটে ঢুকি। একজন আগে থেকেই টয়লেটের ভেতরে ছিল। টয়লেটের ভেতর আটকা থাকা অবস্থায় এক পর্যায়ে দেলোয়ারসহ অন্যরা দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন। এক সময় তারা দরজা কিছুটা ভেঙেও ফেলেন। ঠিক সে সময় সবুজ নামে এক ওয়েটার গিয়ে তাদের দরজার ছিটকিনি খুলে দেয়।’

দেলোয়ারের বর্ণনায় জঙ্গিদের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার প্রমাণ পাওয়া যায়। জঙ্গিরা শেষ মুহূর্তে কোরআন-হাদিস নিয়ে তাদের ভাবাদর্শের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে কথিত জিহাদের পক্ষে কথা বলে।

দেলোয়ার বলেন, ‘বিদেশি হত্যা করার পক্ষে ভোরে যুক্তি দেয় জঙ্গিরা। তারা হলি আর্টিজান বেকারিতে কাজ করতেও আমাদের নিষেধ করে। জঙ্গিরা বলে, বিদেশিরা খারাপ কাজ করে। ওরা মদ খায়, গাঁজা খায়। ওরা অশ্লীল কাজ করে, অশ্লীল জামা-কাপড় তৈরি করে। ওরা আমাদের ধর্ম নষ্ট করে। পরে বলে, আমরা ওদের মারছি, আমরা জিহাদ করছি। কিছুক্ষণ পর আমরাও মারা যাবো। আবার বলে, কুরআন শরীফ থেকে সুরা রহমানের ৭১ বা ৭২ আয়াতে কী আছে তোরা দেখিস। আল্লাহ বলছে, জিহাদ করতে। আমরা জিহাদ করছি। তোরা সুরা আর রহমানের আয়াতগুলো দেখিস। আমরা আর কিছুক্ষণ পর লাশ হয়ে যাবো। আমরা জান্নাতে যাবো, বেহেশতে যাবো। তোদের সঙ্গে আমাদের জান্নাতে দেখা হবে, বেহেশতে দেখা হবে। প্রায় আধঘণ্টা এসব কথা বলছে।’

সবুজ হোসেন (সহকারী কুক): হলি আর্টিজানে সহকারী কুক হিসেবে কাজ করতেন সবুজ হোসেন। বাবার নাম খোকন হাওলাদার। গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির পরমহল এলাকায়। ঢাকায় নতুন বাজারের নূরেরচালা এলাকায় থাকেন। ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি হলি আর্টিজানে যোগ দেন।

সেই রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সবুজ বলেন, ‘বিদেশিসহ সেদিন টুকটাক গেস্ট ছিল বেকারিতে। জঙ্গিরা প্রথম অ্যাটাকটাই করেছে ইতালিয়ান আর জাপানিজ টেবিলে। এইটুকু দেইখাই পালাইছি আমরা সবাই। এক দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকছি । আমরা সবাই ধারণা করেছি, যে এরা হয়তো লুটপাট করতে আসছে, টাকা পয়সা নিতে আসছে। এরা যে এইখানে থাকবো এইটা আমরা বুঝতে পারি নাই। ভেবেছিলাম, লুটপাট করে চলে যাবে। তখন আমরা বের হবো।’

টয়লেটে বন্দি থাকা অবস্থায় সবুজসহ অন্যরা বাইরের জঙ্গিদের নৃশংসতার আওয়াজ পাচ্ছিল ঠিকই, তবে এতটা বর্বরতা আঁচ করতে পারেননি তারা।

রিন্টু কীর্তনিয়া (ডিস ওয়াশার): রিন্টু কীর্তনিয়া ডিস ওয়াশার হিসেবে কাজ করতেন হলি আর্টিজান বেকারিতে। বাবা মহাদেব কীর্তনিয়া কাঠ মিস্ত্রির কাজ করেন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের আগৈলঝড়া থানাধীন কাঠিরায়।

তিনি বলেন, ‘আমার বস আমার কাছ দিয়া দৌড়ে গেলেন। আমি ভাবলাম ভূমিকম্প কিনা। পরে দেখি, সব স্টাফররা দৌড়াচ্ছে। সবাই দৌড়ায়া বাথরুমে গেল। আমারে ওরা ডাকে। আমিও গিয়া টয়লেটে ঢুকি। টয়লেটের ভেতরে গিয়া জানতে পারি, সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করছে। আমরা ভাবছিলাম টাকা-পয়সা লুট করার জন্য আসছে।’

রিন্টু বলেন, ‘টয়লেট থেকে আমরা যখন বাইরে বেরিয়ে আসি, তখন তিন জন জঙ্গি ছিল। একজনের গলায় ঝুলানো বড় অস্ত্র আর হাতে পিস্তল। আরেকজনের হাতে দাও। অন্য একজনের হাতেও পিস্তল ছিল। আমরা খুব ভয় পাচ্ছিলাম। আমার হাত-পা কাঁপতেছিল। মনে হইতেছিল এই বুঝি আমাদের মেরে ফেলা হবে। আমরা বাঁচব কিনা তা নিশ্চিত ছিলাম না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সকাল সাতটার একটু আগে হঠাৎ ওয়েটার সবুজ আমাদের দরজা খুলে দেয়। সে আমাদের জানায় জঙ্গিরা আমাদের কিছু করবে না। সবাইকে হল রুমে যেতে বলছে। প্রথম যারা বের হয়েছে তারা হলরুমের দিকে গেছে। পেছন থেকে আমরা চার জন দৌড়ে দোতলায় উঠি। সেখান থেকে কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গায়া পালানোর জন্য লাফ দেই। সে সময় র‌্যাব আমাদের ধরে ফেলে। আমার তখন খালি গা আছিল। আমি লাফ দেওয়ার পর জামাটা পরছিলাম। র‌্যাব বন্দুক তাক কইরা কয়, হাত উঁচা কর তা না হলে ফায়ার করবো। আমরা হাত উঁচু করি। পরে হাতকড়া পরাইয়া আমাদের একটা বাড়িতে নিয়া যায়। সেখানে আমাদের মালিককে দেখতে পাই। তিনি আমাদের হাত খুলে দিতে বলেন। পরে সেখান থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং বিকালে  ছেড়ে দেওয়া হয়।’

উল্লেখ্য, গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে নিহত হয় তিন বাংলাদেশি নাগরিকসহ ২০ জন। অন্যদের মধ্যে ৯ জন ইতালির, ৭ জন জাপানের এবং একজন ভারতীয়। এছাড়া জঙ্গিদের হামলার শুরুতেই  তাদের আক্রমণে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। রেঁস্তোরার ভেতরে রাতভর জিম্মি ছিলেন অন্তত ২৪ জন, যাদের প্রায় ১১ ঘণ্টা পর পরদিন সকালে সেনা কমান্ডো পরিচালিত অপারেশন থান্ডারবোল্টের সময় উদ্ধার করা হয়। এছাড়া রাতের বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয় আরও অন্তত ৭ জনকে। অপারেশন থান্ডারবোল্টের পর রেঁস্তোরা থেকে ৫ জঙ্গিসহ ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া পালাতে গিয়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক রেস্তোরাঁকর্মী।এ ঘটনায় গুলশান থানায় দায়ের হওয়া মামলাটি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট তদন্ত করছে।

 /এপিএইচ/

আরও পড়ুন:

হলি আর্টিজান এখন

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা