X
বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫
২৫ বৈশাখ ১৪৩২

জামায়াতকে নিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ঐক্যের সম্ভাবনা কতটা

সালমান তারেক শাকিল
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২২:০০আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:৫০

‘এখন থেকে আমরা সবাই একে অপরের জন্য। সবাই সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকবো, ইনশাআল্লাহ। অতীতের কোনও আচরণের জন্য আপনারা যদি সামান্য কষ্ট পেয়ে থাকেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। আশা করি আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।’

গত ১৮ আগস্ট রাজধানীর মগবাজারে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখের সঙ্গে আমিরে জামায়াতের মতবিনিময় সভায়’ এমন বক্তব্য ছিল ডা. শফিকুর রহমানের। এরপর এক মাস অতিবাহিত হলেও তার সেই আহ্বানে কতখানি সাড়া পড়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও অনুসারীদের মধ্যে?

ডা. শফিকুর রহমানের এই আহ্বানের আগে-পরে বেশ কিছু দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে জামায়াত। এসব বৈঠকে ইসলামি রাজনীতির অনুসারী দলের মধ্যে ছিল—খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজি আন্দোলন, মাজারভিত্তিক সংগঠন জাকের পার্টি, ১২ দলীয় জোটের শরিক দল হিসেবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম, ইসলামী ঐক্যজোটের (একাংশ) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুর রাকিব, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আব্দুল করিম।

এসব বৈঠকে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মে আলোচনার সূত্রপাত করে জামায়াত। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কওমি মাদ্রাসার আলেম ও রাজনীতিকদেরও আমন্ত্রণ করা হয়। এরপর দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা যেকোনও ছাড়ের বিনিময়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ঐক্য গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া অব্যাহত রাখেন।

এক মাসে জামায়াতের এই ঐক্যের প্রক্রিয়া কতদূর এগোলো, এ প্রশ্নে ধর্মভিত্তিক একটি দলের যুগ্ম মহাসচিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রসেসটি একেবারে শূন্যের জায়গায় রয়েছে। এখানে প্রশ্ন রয়েছে।’ এরইমধ্যে ইসলামী আন্দোলনের প্রভাবশালী নেতা ফয়জুল করীম ঐক্য না করার বিষয়ে স্পষ্ট মত দিয়েছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে।

আবার কোনও কোনও দলের নেতারা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াতের সঙ্গে উদারপন্থি ডান ঘরানার দলগুলোর ঐক্য হতে পারে। ইতোমধ্যে ববি হাজ্জাজের এনডিএম, মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির সঙ্গে বৈঠক করেছেন জামায়াত আমির। 

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়ে বিভিন্ন সময় ইতিবাচক অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।

জামায়াতের নেতৃত্বে ঐক্যে আগ্রহ রয়েছে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন কল্যাণ পার্টির। দলটির মহাসচিব আবদুল আউয়াল মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরিবর্তিত বাংলাদেশে সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য শুধু জামায়াতে ইসলামী না, যে কেউ যদি বাংলাদেশে সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য কোনও নির্বাচনি জোট করে, কোনও রাজনৈতিক জোট করে, কোনও ইসলামী জোট করে, আমরা যদি দেখি—সত্যিকার অর্থে দেশের ভালোর জন্য তারা কিছু করছে, সেখানে আমাদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকলে অবশ্যই আমরা যুক্ত হবো।’

বৈঠকে বিভিন্ন ইসলামপন্থি দলের নেতারা (ফাইল ফটো) আবদুল আউয়াল মামুন ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে কল্যাণ পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। আবদুল আউয়ালের ভাষ্য, ‘মূল প্রায়োরিটিটা থাকবে বাংলাদেশ। আমরা কিছু একটা করতে পারবো দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। সুতরাং, আমাদের কারও সঙ্গেই কোনও রিজারভেশন নাই যে জামায়াত হলে যেতে পারবো না, আওয়ামী লীগ হলে যেতে পারবো না, বিএনপি হলে যেতে পারবো না, এরকম না।’

‘দেশের স্বার্থে যারাই আমাদের ইনক্লুসিভ পলিটিক্সে আহ্বান করবে, অন্তর্ভুক্ত করবে, আমরা তাদের সঙ্গে অ্যাকোমোডেট হতে রাজি আছি। আমরা তাদের বুকে নিতে রাজি আছি—তারা যদি আমাদের বুকে টেনে নেয়। যেহেতু আমরা ছোট দল, হয়তো অনেকে আমাদের ডাকে সাড়া নাও দিতে পারে, সুতরাং বড় দলগুলোকে এ দায়িত্ব নিতে হবে।’

‘‘সুতরাং, আমি পার্সোনালি মনে করি দেশের স্বার্থে দেশের মানুষের স্বার্থে এবং সত্যিকার অর্থে পরিবর্তনের জন্য কেউ যদি আমাদের ডাকে, আমরা অবশ্যই ইতিবাচক সাড়া দেবো। আমাদের রাজনৈতিক স্লোগানটাই হচ্ছে ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। এই স্লোগান ধারণ করেই আমরা রাজনীতি করছি’’- বলেন আবদুল আউয়াল মামুন।

হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী মনে করেন, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যালট একটিই থাকবে। দল আলাদা থাকতে পারে, কিন্তু নির্বাচনি সমঝোতা হবে।

হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বাংলা ট্রিবিউনের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ঐক্য সম্ভব। এখানে স্বার্থের বিষয় প্রাধান্য নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি—ইসলামবিরোধী শক্তি, জালেমরা মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব করছে। এখন ইসলামি দলগুলো পরস্পরের কাছাকাছি আসছে, এটা সুদৃঢ় ঐক্যের আলামত। ঐক্য আরও দৃঢ় হবে।’

ধর্মভিত্তিক দলের একাধিক নেতা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে উল্লেখ করেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাত্রদের মধ্য থেকে একটি রাজনৈতিক ধারার সূত্রপাত হচ্ছে নিশ্চিত। ইতোমধ্যে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ শুরু করেছেন তারা। পাশাপাশি বিএনপিসহ দলটির সঙ্গে যুগপৎ ধারার দলগুলো রয়েছে।

নেতারা এও বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে যারা এই দুই ধারার বাইরে আছে, তারা জামায়াতকে কেন্দ্র করে একটি অবস্থান তৈরির চেষ্টা করবে, এটি স্বাভাবিক। ইসলামি, ইসলামি ঘরানার দক্ষিণপন্থি দলগুলোর ঐক্য হতে পারে। এতে ভোটে প্রভাব পড়বে’, এমন সম্ভাবনার কথা জানান নেতারা।

২২ আগস্ট জামায়াতের সঙ্গে বৈঠক করেছে খেলাফত মজলিস। দলটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে এখনও আলোচনা হয়নি। তবে ইসলামি দলগুলোর ঐক্য, সামগ্রিক বিষয়ে ইসলামি দলগুলোর অবস্থান নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে।’

‘নির্বাচনে সব ইসলামি দলের এক আসনে এক প্রার্থী’—এই হিসাবে যদি সামগ্রিক ঐক্য করা যায়, তাহলে একটা কিছু হতে পারে। না হলে কিছু হবে না। এটার মানে এই না যে জোট করা’- বলেন আহমদ আবদুল কাদের।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীনের ভাষ্য, ‘আমরা ঐক্যের পক্ষে। এসব দলের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনও আলোচনা হয়নি। অনানুষ্ঠানিক কিছু আলোচনা আছে। আমরা মনে করি আগামী নির্বাচনের আগে অর্থবহ ইসলামি ঐক্য হতে পারে।’

১২ সেপ্টেম্বর বিকালে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির পক্ষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির নেতারা বৈঠক করেন। ওই বৈঠক নিয়ে নেজামে ইসলাম পার্টির নির্বাহী সভাপতি মাওলানা একেএম আশরাফুল হক বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শরিক সব জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী শক্তির মধ্যে মজবুত ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

ইসলামি দলগুলোর ঐক্য নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারী বলেন, ‘যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে মেতেছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। না হলে ধর্মপ্রাণ মুসলিম সুফিবাদী জনতা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত দেখতে চাই।’

‘দুর্নীতি, লুটপাট, পেশিশক্তি ও কালোটাকার প্রভাবমুক্ত নির্বাচন, সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠাসহ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করাসহ বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজগুলো করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কিছু সময় দেওয়া দরকার।’

‘অনেকেই এই দেশে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখছে। সুপ্রিম পার্টি মনে করে, এ ধরনের হীন চক্রান্ত জনগণ কখনও মেনে নেবে না।  সুপ্রিম পার্টি ও লিবারেল ইসলামিক জোটের সঙ্গে সমমনা সুন্নি সুফিবাদী দলগুলোর সঙ্গে জোট হতে পারে’- বলেন সাইফুদ্দীন আহমদ।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ঐক্য নিয়ে জানতে চেয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়াতের আপিলের শুনানি ১৩ মে
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে এনসিপির শোক
ব্যারিস্টার রাজ্জাকের জানাজা পড়ালেন ছেলে, প্রিয় আইনাঙ্গন থেকে শেষ বিদায়
সর্বশেষ খবর
দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
দেশ ছেড়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ
চুল চকচকে করবে অ্যালোভেরার এই প্যাক
চুল চকচকে করবে অ্যালোভেরার এই প্যাক
মাদকাসক্ত জামাইয়ের ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেলো চাচাশ্বশুরের, শ্যালক আহত
মাদকাসক্ত জামাইয়ের ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেলো চাচাশ্বশুরের, শ্যালক আহত
ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ থেকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশত শিক্ষার্থী আটক
ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ থেকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশত শিক্ষার্থী আটক
সর্বাধিক পঠিত
‘তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি’
‘তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি’
ফিরে গেছে কুয়েত ও তার্কিশ এয়ারের ঢাকাগামী ২ ফ্লাইট
পাকিস্তানে ভারতের হামলাফিরে গেছে কুয়েত ও তার্কিশ এয়ারের ঢাকাগামী ২ ফ্লাইট
‘সকালে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয় এএসপি পলাশের, দুপুরে অফিসে নিজ মাথায় গুলি’
‘সকালে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয় এএসপি পলাশের, দুপুরে অফিসে নিজ মাথায় গুলি’
সিঁদুর অভিযান: ভূপাতিত ভারতীয় বিমানের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা
সিঁদুর অভিযান: ভূপাতিত ভারতীয় বিমানের সংখ্যা নিয়ে ধোঁয়াশা
বাণিজ্যিক স্পেস ভাড়া দেওয়া হবে মেট্রোরেলের ২ স্টেশনে
বাণিজ্যিক স্পেস ভাড়া দেওয়া হবে মেট্রোরেলের ২ স্টেশনে