প্রিমিয়ার লিগের একটি ম্যাচের উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে দলের জন্য সুজন হোসেনের আত্মত্যাগ কতটুকু। বসুন্ধরা কিংসের দোরিয়েলতনের সঙ্গে সংঘর্ষে মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছিল। ব্যান্ডেজ বেঁধে তারপরও শেষ বিন্দু দিয়ে খেলে গেছেন। পুরো মৌসুমে এমন আত্মত্যাগ ও নৈপুণ্য দেখেই তাকে প্রথমবার লাল-সবুজ দলে জায়গা দিয়েছেন হাভিয়ের কাবরেরা। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অস্ট্রেলিয়া ও লেবাননের বিপক্ষে ডাক পেয়ে সুজন ভীষণ আনন্দিত। দলে ডাক পাওয়ার খবর সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে বাবা-মাকেও জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু খুশির খবর দিতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি!
সুজনদের পরিবার ফুটবল-পরিবার। আপন মামা মিডফিল্ডার সোহেল রানা খেলছেন জাতীয় দলে। ছোট ভাই পাপ্পু হোসেনও আগে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন। বর্তমানে খেলছেন আবাহনী লিমিটেডে। তাদের ধারাবাহিকতায় সুজন অনেক আশায় ছিলেন একসময় মামা ও ছোট ভাইয়ের মতো জাতীয় দলে তারও ডাক পড়বে। কিন্তু আশায় বুক বাঁধলেও প্রতিবারই হতাশই হতে হয়েছে তাকে। এবার নিজের নাম দেখে সুজন তো ভীষণ অবাক। বাংলা ট্রিবিউনকে নিজের মুখে অবাক হওয়ার কারণটাও বলেছেন এভাবে, ‘আসলে এতদিন ধরে আশায় ছিলাম জাতীয় দলে ডাক পাবো। কিন্তু প্রতিবারই নিজের নাম না দেখে হতাশ হয়েছি। তাই এবার আর কোনও আশা করিনি। হঠাৎ নিজের নাম দেখে অনেকটাই অবাক হয়েছি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। তবে ডাক পেয়ে আসলে কেমন লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এই আনন্দ অন্যরকম।’
নিজের নাম জাতীয় দলে দেখতে পেয়ে সুজন প্রথমেই ফোন করে বাবা-মাকে জানিয়েছেন। অপ্রত্যাশিতভাবে ডাক পাওয়ার খবরে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। সুজনের ভাষায়, ‘আমার এখানে আসার পেছনে বাবা-মায়ের অনেক অবদান। তাদের ছাড়া আমার জীবন বৃথা। যখন ফোন করে তাদের সুখবরটি দিলাম, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না আমি কান্না করে ফেলেছি। আসলে এটা ছিল আনন্দের।’
মাত্রই প্রিমিয়ার লিগ শেষ হয়েছে। এখনও সুজন সাদা-কালোদের টেন্ট ছাড়েননি। ২০১৫ সাল থেকে মোহামেডানে অতন্দ্র প্রহরীর মতো খেলছেন। এর আগে খেলেছেন চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ঢাকা ইউনাইটেডসহ অন্য দলে। জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে খেললেও এবারই প্রথম কাবরেরার জাতীয় দলে জায়গা হয়েছে। এখন তার সামনে মূল দলে জায়গা করে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ। তবে সেটা যে কঠিন তা বুঝতে পারছেন ২৭ বছর বয়সী গোলকিপার, ‘মিতুল ও শ্রাবণ ভালো খেলছে। এখন আমাকে টিকে থাকতে হলে চূড়ান্ত দলে জায়গা করে নিতে হবে। আর একাদশে খেলতে হলে তো অনুশীলনেও ভালো করতে হবে। এছাড়া বিকল্প নেই। এটা ভালো করেই জানি। ওরা আমার চেয়ে বয়সে ছোট। তবে আমি লড়াই করে নিজের জায়গাটা করে নিতে চাই।’
সুজন মূলত অভিজ্ঞ আনিসুর রহমান জিকোর জায়গায় সুযোগ পেয়েছেন। জিকোর পারফরম্যান্স উঠা-নামা করায় ভাগ্য খুলে গেছে তার। জিকো সম্পর্কে সুজনের মূল্যায়ন,‘জিকোকে হারিয়ে আগেও অনূর্ধ্ব-২৩ দলে জায়গা করে নিয়েছিলাম। ও আসলে অনেক ভালো গোলকিপার। মাঝে একটা দুর্ঘটনায় সে পিছিয়ে যায়। আমার মনে হয়, তার সামনে ফেরার সুযোগ আছে।’
জাতীয় দলে জায়গা করে নেওয়ার পেছনে মোহামেডানের গোলকিপার ছাইদ হাসান কাননের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন সুজন। তাছাড়া জমে থাকা একটি আক্ষেপের কথাও শুনিয়েছেন এই প্রথম, ‘‘এর আগে জাতীয় দলে আমার মামা সোহেল রানা ও ছোট ভাই পাপ্পু হোসেন জায়গা পেয়েছিল। দুজনেই বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে একটা অনুশীলনের ছবি দিয়েছিল। সেটা দেখে তখন একটু খারাপ লেগেছিল। যদি ওদের সঙ্গে থাকতে পারতাম। তখনই বলেছিলাম, ‘এই ছবিতে তোমাদের সঙ্গে একসময় আমিও থাকবো।’ সেই সুযোগ এবার এসেছে। তবে পাপ্পুকে পাচ্ছি না। একটু খারাপ লাগছে। ও আগে থেকে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে। এতে বড় ভাই হিসেবে আমার আনন্দ ছিল অন্যরকম।এবার ও সুযোগ পেলে ভালো লাগতো।’’
দৃঢ়চেতা মনোবল আর কঠোর পরিশ্রমের কারণে অবশেষে লাল-সবুজের দরজা সুজনের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে। এখন এটাকেই পুঁজি করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পণ করেছেন তিনি।