X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাহবাগের চেতনা: কতটা পেলাম বা হারালাম

লীনা পারভীন
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৫:৫৮আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:০১

লীনা পারভীন ১৯৭১ সালে যে দেশটি জন্ম নিয়েছিলো তার নাম বাংলাদেশ। সেই জন্মের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। তবে যে অধ্যায়টি বারবার আমাদের সামনে চলে আসে সেটি হলো একটি স্বাধীন বাংলাদেশের অর্জনের পেছনে একটি গোষ্ঠীর বিরোধিতা। অর্থাৎ, ‘আমরা সবাই বাংলাদেশ চাই’ স্লোগানের সঙ্গে সবাই একই সুরে গলা মিলায়নি সেদিন। কিছু মানুষ, একটি দল, একটি গোষ্ঠী ছিল, যারা এই ‘বাংলাদেশ’ নামের শিশুটির জন্মের বিরোধী ছিল। তারা কারা? এক কথায় সেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির নাম জামায়াতে ইসলামী। যাদের ছিল কয়েকটি অঙ্গসংগঠন। কী চেয়েছিলো তারা? তারা চেয়েছিলো পাকিস্তান। চাঁদ-তারার পতাকায় তারা স্বপ্ন দেখতো নিজের দেশের। দলটির সহযোগিতায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা চালিয়েছিলো তাদের হত্যাকাণ্ড, যা ইতিহাসের বুকে গণহত্যার পরিচয় পেয়েছে।
তারা এতটাই ক্ষমতাধর ছিল যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও চালিয়ে গেছে ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানের ছায়াসঙ্গী হয়ে তারা এদেশের আলো বাতাসে বড় হয়ে উঠেছে আর তলে তলে ধ্বংসের পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিল। স্বাধীনতার পর যখন ধ্বংলীলা থেকে ওঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিলো বাংলাদেশ, তখন তারা জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে আবার বাংলাদেশকে পাল্টে দেওয়ার মনোবাসনা নিয়ে এগোতে থাকলো। ক্রমেই আরো শক্তিশালী হতে থাকলো তারা। বিএনপি সরকারের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে একাত্তরের প্রধান ঘাতক বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত গোলাম আযম পেলো বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। তাকে ফিরিয়ে আনা হলো স্বাধীন বাংলাদেশে। সেদিন এদেশের মাটি কেঁপে উঠেছিলো ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ নির্যাতিত নারীর কান্না আর হাহাকারে। শহীদের পরিবারগুলো সেদিন নিজেদের দেখেছিলো অপাংক্তেয় হিসেবে। যৌক্তিকতা খুঁজতে চাইছিলো তাঁদের স্বজন হারাবার সেই ১৯৭১ সালের।

ঘটনা সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে তারা ক্ষমতায় এসেছিলো। চিহ্নিত রাজাকারের গাড়িতে উঠেছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা। ক্ষমতার দম্ভে তারা হুঙ্কার দিয়েছিলো এ মাটি থেকে তাদের উচ্ছেদ করে এমন শক্তি নেই  দেশে।

একটা সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনতা হতাশ হয়ে ভাবতে শুরু করেছিল দেশটা হয়তো আবার পাকিস্তান হতে চলেছে। জাতির জনকের হত্যার পর থেকেই শুরু হয়েছিলো সে প্রক্রিয়া। বাঙালি সংস্কৃতিকে পাল্টে দিয়ে পাকিস্তানি সংস্কৃতির আরও একটি প্রজাতন্ত্র গড়ে তুলতে সেদিনের সেই ষড়যন্ত্র আজও বিদ্যমান।

দেশের তরুণ প্রজন্ম বেড়ে উঠছিলো চরম এক রাজনীতি-বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে বিকৃতির চরমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ছিল অনুপস্থিত। জাতির পিতাকে পরিচিত করানো ছিল প্রায় নিষিদ্ধ। বিরাজনীতিকরণের এক কৌশল হিসেবে এদেশের যুবকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিলো নানামুখী হাতছানি। দেশ ও দশের কথা ভাবার প্রয়োজনীয়তাকে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছিলো। ঘরে ঘরে অভিভাবকদের হতাশা। জাতীয়ভাবে তখন একটাই আলোচনার বিষয়, কী হবে এই প্রজন্মকে নিয়ে? গ্রামীণফোনের একটি আলোচিত প্যাকেজ ছিল ‘ডি-জুস’। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন রাত জেগে ফোনে বিনা পয়সায় আড্ডা দেয় আর সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে। পড়াশুনার প্রচলিত ধারণা গেলো পাল্টে। নিজেদের মাঝে কথাবার্তায় এলো চরম পরিবর্তন। একটা সময় যেখানে ছাত্রদের আলোচনায় থাকতো দেশ, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, বিভিন্ন লেখক বা কবির লেখা বা কবিতা, সেখানে আলোচনা চলতে থাকলো সব ব্যক্তিকেন্দ্রিক আর ভোগবাদিতার বিষয় নিয়ে। রাজনীতি ছিল সবচেয়ে ঘৃণ্য আর দেশপ্রেম ছিল সবচেয়ে হাস্যকর বিষয়।

এমন এক বাংলাদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশ ফিরে পাওয়া ছিল চরম চ্যালেঞ্জিং। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে বিপুল জয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৭৫-এর পর একটা লম্বা সময়ে ক্ষমতার বাইরে ছিল দলটি। ক্ষমতায় আসার পরই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার শুরু করলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম। গঠন করলো ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’। তালিকা করা হলো চিহ্নিত রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম মৃত্যুদণ্ডের রায় আসে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে।

এরপরের রায়টি আসে জামায়াতের আরেক নেতা এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে, যে কসাই কাদের নামে পরিচিত ছিল। সে সরাসরি যুক্ত ছিল কবি মেহেরুন্নিসার হত্যা থেকে শুরু করে বহু হত্যাকাণ্ডে। গোটা বাংলাদেশ প্রত্যাশায় বসেছিলো একটি কাঙ্ক্ষিত রায় শোনার জন্য। সবাইকে হতাশ করে দিয়ে আদালত কসাই কাদেরের রায় দিলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ক্ষোভে ফেটে পড়লো গোটা দেশ। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাধারণ জনতা জড়ো হতে থাকলো শাহবাগে। একদল ব্লগার, অ্যাকটিভিস্টের ডাকে সেদিন জেগে উঠেছিলো উত্তাল জনতা। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের দিন নামে পরিচিত। ৫ ফেব্রুয়ারি রাত নাগাদ শাহবাগ হয়ে উঠলো আরেকটি রেসকোর্স। একে একে ছড়িয়ে পড়লো গোটা দেশে। দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের যেখানেই বাঙালি, বাংলাদেশি ছিল সব জায়গাতেই আন্দোলন গড়ে উঠলো। সবার একটাই দাবি। কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই। সেসব দিনের কথা মনে করলে এখনও আমার গায়ে রক্ত গরম হয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায়, ঘরে ঘরে টিভির সামনে দাঁড়িয়ে সবাই জাতীয় সঙ্গীত গাইছি আমরা। অফিসে আদালতে, সংসদে একত্র হয়ে সবাই জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা উড়ছে, মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে সংহতি জানাচ্ছে আপামর সাধারণ জনতা। ছোট ছোট বাচ্চারা পিতামাতার কোলে চড়ে শাহবাগে আসছে স্লোগান দিতে। সেসব দিনের কথা কি আমরা ভুলে যাবো? সেটার পেছনে একটাই চেতনা ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজাকার আলবদরদের ঠাঁই নেই। রাজাকারের ফাঁসি বিনা কোনও কথা নেই। নির্দলীয় সেই গণজোয়ার আর কে কবে দেখেছিলো ৭১ বা পূর্ববর্তী সময় ছাড়া?

৯০-এর আন্দোলনেও এত সাড়া পড়েছিলো বলে মনে হয় না। তাছাড়া সেটি ছিল একটি ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে আন্দোলন।

আমাদের প্রজন্ম প্রথম আবার নতুন করে জানতে শুরু করলো মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী শক্তি সম্পর্কে। বঙ্গবন্ধু আবার ফিরে এলেন আমাদের মাঝে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন সারা বাংলায়, সেই নিভু নিভু আগুনের শিখা আবার তেজ পেয়েছিলো সেই ঐতিহাসিক ৫ ফেব্রুয়ারির পর। যুদ্ধাপরাধীরা বুঝে গিয়েছিলো তাদের দিন শেষ হতে চলেছে। তাদের উঁচু গলা নিচু হতে শুরু করলো। বিশ্বমোড়লদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেদিন শেখ হাসিনা সরকার সাহসের সঙ্গে জনতার কাতারে মিশে গিয়েছিল। আইন সংশোধন করে জনতার রায়কে আদালতের রায়ে পরিণত করেছিলেন।

এতসব বিজয়ের মাঝেও কিছু হতাশাও আছে। কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক সেসব হতাশাকে সামনে এনে সেই সময়ের সেই অর্জনকে বিতর্কিত করার পেছনেও একটা রাজনীতি থাকতে পারে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিকে কোনও সময় দিয়ে বাঁধা যাবে না। এর অর্জনকে মাপা যাবে ইতিহাসের বিবেচনায়। এর প্রাপ্তিকে একমাত্র চেতনা দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। আজকের বাংলাদেশের যে চেহারা আমরা দেখি, সেটি একমাত্র শাহবাগ আন্দোলনের ফসল। সেই আন্দোলন নির্ধারণ করে দিয়েছে শাসক দল চাইলেই যা ইচ্ছা তা করতে পারবে না বা বাংলাদেশে কেউ মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে রাজনীতি করতে পারবে না। এই বাংলাদেশে কেবল এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাসের কথাই কইবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

/এসএএস/ওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও মার্কিন থিঙ্কট্যাংকের প্রশংসা
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও মার্কিন থিঙ্কট্যাংকের প্রশংসা
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনে জরিমানার পরিমাণ বাড়ছে: আইনমন্ত্রী
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনে জরিমানার পরিমাণ বাড়ছে: আইনমন্ত্রী
চুয়াডাঙ্গাকে টপকে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গড়লো যশোর
চুয়াডাঙ্গাকে টপকে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গড়লো যশোর
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদফতরকে টাকা বাঁচিয়ে কাজের মান অক্ষুণ্ণ রাখার নির্দেশ
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদফতরকে টাকা বাঁচিয়ে কাজের মান অক্ষুণ্ণ রাখার নির্দেশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ