X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা’

প্রভাষ আমিন
১৪ এপ্রিল ২০২২, ১৯:৫৪আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২২, ১৯:৫৪

বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। কিছু উৎসব ধর্মীয়, কিছু জাতীয়, কিছু আবার রাষ্ট্রীয়। শোকের দিন ২১ ফেব্রুয়ারিকেও আমরা উৎসব বানিয়ে ফেলেছি। ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর আমাদের রাষ্ট্রের জন্মোৎসব। ঈদ, পূজা, বড়দিন, প্রবারণা পূর্ণিমা, এই ধর্মীয় উৎসবগুলোতেও আমরা মেতে উঠি আনন্দে। ছেলেবেলায় আমরা সব উৎসবেই শামিল হতাম। মুসলমানদের দুই ঈদের উৎসব তো আছেই। আমরা শবে কদর, শবে মেরাজ, শবে বরাতকেও উৎসব বানিয়ে ফেলতাম। এই তিনটি উৎসবই রাতে। তাই আমরা অবধারিতভাবে রাতে ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা পেয়ে যেতাম। ছুটিটা পেতাম আসলে মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য। কিন্তু মসজিদে একটু হাজিরা দিয়ে আমরা রাতভর ঘুরে বেড়াতাম। রাতে বাইরে থাকার আনন্দটাই অন্যরকম। এরমধ্যে শবে বরাতে উৎসবটা বেশি হতো। সন্ধ্যার পর গোসল করে ঘরে ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করতাম। আর হিন্দু সম্প্রদায়ের তো বারো মাসে তেরো পূজা। তাদের অনেক উৎসবে আমরা অংশ নিতাম।

আমাদের ছেলেবেলা ছিল উৎসবময়। আমাদের এলাকায় অন্য ধর্মের মানুষ ছিল না বলে বড়দিন বা প্রবারণা পূর্ণিমার আনন্দটা ছেলেবেলায় মিস করেছি। কিন্তু বড় হয়ে দেখেছি, বড়দিনের ক্রিসমাস ট্রি বা সান্তা ক্লজের উপহার আর প্রবারণা পূর্ণিমার ফানুস ওড়ানোও কম আনন্দের নয়। ধর্মীর প্রার্থনার অংশটুকু বাদ দিলে, সব ধর্মের সব উৎসবই আনন্দের, আমাদের সবার। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।

তবে বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ। এই একটি দিনে সব ধর্মের, সব শ্রেণির, সব পেশার মানুষ বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে, আনাচে কানাচে উৎসবে মেতে ওঠে। শুধু বাঙালি নয়, আদিবাসীরাও বৈসাবী উৎসব নিয়ে শামিল হয় বাংলা বর্ষবরণে। এই একটি দিনে বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দের বান ডাকে যেন। গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা, হরেক রকম খাবার, হরেক খেলনা, নাগরদোলা; সত্যিই যেন আনন্দের মেলা বসে।

বাংলাদেশে তিনটি সাল আমরা ব্যবহার করি। আমাদের ধর্ম, জাতীয়তা বা সংস্কৃতির সঙ্গে যার কোনও মিল নেই, সম্পর্ক নেই; সেই খ্রিষ্টাব্দ ব্যবহার করি সবচেয়ে বেশি। অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্রই খ্রিষ্টাব্দের জয়জয়কার। আমরাও ইংরেজি মাসের তারিখ যতটা জানি, বাংলা বা হিজরি মাসের তারিখ ততটা জানি না। খ্রিষ্টাব্দে ‘নিউ ইয়ার’ যতটা উদযাপিত হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ‘থার্টি ফার্স্ট’। হিজরি সাল বা আরবি ক্যালেন্ডার প্রতিদিন না লাগলেও আমাদের নিয়মিতই লাগে। ইসলাম ধর্মের সব হিসাব-নিকাশ এই চন্দ্র মাস বা হিজরি সাল ধরেই হয়। তবে হিজরি সালে নববর্ষ বা নিউ ইয়ার উদযাপনের রেওয়াজ নেই। বরং হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম আসে কারবালার শোকাবহ স্মৃতি নিয়ে। তবে বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ আমাদের জীবনে আসে উৎসবের ডালি সাজিয়ে- গানে, মেলায়, উৎসবে, রঙে অনন্য।

মৌলবাদীদের কেউ কেউ পহেলা বৈশাখকে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বলেন, এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু বাংলা সনের সঙ্গে কোনও ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। কিছুটা সম্পর্ক থাকতে পারে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে। কারণ, বাংলা সন গণনা চালু করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। বাংলা সনের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক হলো কৃষি কাজের, কৃষকের। শুরুতে এটাকে ফসলি সনও বলা হতো। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য শুরুর পর হিজরি সাল অনুসারে কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় হতো। কিন্তু হিজরি সাল চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না। প্রতিবছরই হিজরি সালে দিনের ওলটপালট হয়ে যায়। তাই কৃষকদের ওপর অসময়ে খাজনা দেওয়ার চাপ তৈরি হতো। এই ঝামেলা মেটাতেই সম্রাট আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবরের নির্দেশে প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কার করে ফসলি সন বা বাংলা সন চালু করা হয়। আর এই সংস্কারের কাজটি করেছিলেন তখনকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি। তিনি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম চালু করেন। আকবরের সময় থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। তখন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। সকল দেনা মিটিয়ে পহেলা বৈশাখ শুরু হতো নতুন আশা নিয়ে। ব্যবসায়ীরা নতুন বছর শুরু করতেন নতুন খাতা দিয়ে, যেটাকে বলা হয় হালখাতা। হালখাতা উৎসবও হয়। ব্যবসায়ীরা পাওনা আদায়ে উৎসব করতেন। পহেলা বৈশাখের সাথে কোনও হিন্দুয়ানির সম্পর্ক নেই। যে দু’জনের নাম আছে- একজন সম্রাট, একজন জ্যোতির্বিদ, দুজনই মুসলমান। পহেলা বৈশাখের উৎসবটা হিন্দুয়ানি যেমন নয়, ইসলামিকও নয়; পহেলা বৈশাখ বাঙালির সংস্কৃতি, এই মাটির সংস্কৃতি। আমরা শহুরে লোকজন যতই দেয়ালে ইংরেজি ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে রাখি, গ্রামের মানুষের সব হিসাব কিন্তু বাংলা সনে। তাদের ক্যালেন্ডার লাগে না, আকাশ আর প্রকৃতি দেখেই মাস-ঋতুর হিসাব মেলায়। বাংলা মাসগুলোকে গ্রামের মানুষ ডাকেও নিজেদের মতো করে। জ্যৈষ্ঠ মাস তাদের ভাষায় জষ্ঠি, কাতি মানে কার্তিক, অগ্রহায়ণকে ডাকে আগুন, ফাল্গুনকে ফাগুন, আর চৈত্র হলো চইত মাস। বৃষ্টি-বাদলা, ঝড়-বন্যা-খরার হিসাব তাদের মুখস্থ। প্রকৃতির দিকে তাকালেই বোঝা যায় কোন ঋতু চলছে। কৃষ্ণচূড়ার মতো কড়া রঙের ফুল মানেই গ্রীষ্মকাল, গন্ধরাজের মতো সুগন্ধী মানেই বর্ষা, কাশ মানেই শরৎ। নতুন বছর বাংলার কৃষকদের জন্য সত্যি সত্যি নতুন আশা নিয়ে আসে।

বাঙালি মুসলমানরা যেমন অন্য বাঙালির সঙ্গে মিলে নববর্ষ পালন করে, অন্য দেশের মুসলিমরাও নিজ নিজ অঞ্চলের উৎসব পালন করে। ইরানের মুসলমানরা তাদের নববর্ষ ‘নওরোজ’ পালন করে বিপুল উৎসবে। ইসলাম প্রবর্তনের সময় পহেলা বৈশাখ ছিল না, তাই এর সাথে ইসলামের কোনও বৈরিতা থাকার সুযোগই নেই। এক হুজুর দেখলাম গলা ফুলিয়ে আল্লাহর কসম কেটে বলছেন, পহেলা বৈশাখে যারা পাঞ্জাবি কিনবে; তারা জাহান্নামি, জাহান্নামি, জাহান্নামি। সেই কথাটিও কিন্তু তিনি বলছেন পাঞ্জাবি পরেই। আমি যে পাঞ্জাবি পরে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করি, সেই পাঞ্জারি পরেই ঈদের নামাজে যাই। পোশাক হলো মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। পোশাকের কোনও ধর্ম নেই। দেশে দেশে, অঞ্চলে অঞ্চলে পোশাক বদলে যায়। বাঙালি মুসলমানরা জীবনযাপন করে এ অঞ্চলের পোশাক পরে। গরমের দেশ সৌদি আরবের মুসলমানরা যে পোশাক পরবে, শীতের দেশ রাশিয়ার মুসলমানরা নিশ্চয়ই সেই পোশাক পরবে না। ধর্মকে যারা সংস্কৃতির মুখোমুখি করতে চান তাদের উদ্দেশ্য সৎ নয়। আদতে তারা ধর্মেরই অবমাননা করেন।

গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা বসলেও ঢাকায় বর্ষবরণের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে পহেলা বৈশাখের ভোরে ছায়ানটের বর্ষবরণ। ষাটের দশকে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী আগ্রাসনের প্রতিবাদে গড়ে ওঠে ছায়ানট। পাশাপাশি স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে তাল মিলিয়ে ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। সব অমঙ্গলকে দূর করার আকাঙ্ক্ষায় শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউএনডিপির বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। দুয়ে মিলে রাজধানীর বর্ষবরণে লাগে উৎসবে রঙের বাড়তি ছোঁয়া। কিন্তু পাকিস্তান আমলের মতো গত কয়েক বছর ধরে ধর্মীয় বিবেচনায় বর্ষবরণ আর মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা করা হচ্ছে। সময় এসেছে আবারও রুখে দাঁড়ানোর।

শুরুতে এ অঞ্চলের উৎসবের কথা বলছিলাম। রমজান আমাদের দেশে এবং ঘরে অন্যরকম আবহ নিয়ে আসে। রমজান সংযমের মাস। কিন্তু সেই সংযমটাও আমরা পালন করি উৎসব মুখরতায়। ভোররাতে সেহরি খাওয়ার সময় এক ধরনের উৎসব। দিনভর অপেক্ষার পর সন্ধ্যায় ইফতার আরেক ধরনের উৎসব। মনে হতে পারে সারা দিন না খেয়ে থাকাটা কষ্টকর। কিন্তু একজন বিশ্বাসী মুসলমানের কাছে এটা কষ্ট নয়, এই সংযমেও আনন্দ আছে। আর এক মাসের সংযম শেষে অফুরান আনন্দ নিয়ে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। সংযম-আনন্দ- সব মিলিয়ে রমজান এক অনাবিল উৎসবেরই নাম। এবার বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ এসেছে রমজানের উৎসবের মধ্যেই। করোনার কারণে দুই বছর নববর্ষ উদযাপিত হয়নি। দুই বছর পর আবার উৎসবে মেতেছে বাঙালি। ভোররাতে সেহরি খেয়েই অনেকে ছুটে গেছেন রমনা বটমূলে বর্ষবরণের ঐতিহ্যের অংশ হতে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও শামিল হয়েছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। একসময় মৎস্য ভবন, দোয়েল চত্বর, নীলক্ষেত থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ের ভেতরের পুরো রমনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নববর্ষে আনন্দের মেলা বসতো। মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট, শিশুপার্ক, শাহবাগ হয়ে চারুকলায় শেষ হতো। তবে এটা মানতেই হবে, নিরাপত্তার কড়াকড়িতে গত কয়েক বছর ধরেই উৎসব কিছুটা নিয়ন্ত্রিত। সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে মোকাবিলার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আরও বেশি করে উৎসবে শামিল হওয়া, স্বতঃস্ফূর্ততায় সব শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া।

মৌলবাদীদের নানা অপপ্রচার, হুমকি সত্ত্বেও বাঙালির প্রাণ থেকে শেকড়ের উৎসব কেড়ে নেওয়া যাবে না। রবিঠাকুরেই আমরা সুর মেলাই, ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা’। করোনা মহামারি বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে। নতুন বছরে প্রত্যাশা আর কোনও জরা যেন আমাদের কাবু করতে না পারে। নতুন বছর যেন আমাদের সবার মনের সব গ্লানি ও কালিমা মুছে দেয়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ