X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ: উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা (দ্বিতীয় পর্ব)

ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ
০৯ মে ২০২২, ১০:৫২আপডেট : ১৩ মে ২০২২, ১৭:৫৯

মানবসম্পদের ওপর রাষ্ট্র যদি বিনিয়োগ করতে চায় তবে সেই সুযোগ করে দেয় ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ (ইউএইচসি)। কারণ দক্ষ মানবসম্পদই ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে। এ কারণে বিষয়টি চলমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা যাচাই করার ইস্যুটিকেই সামনে নিয়ে আসে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা যাচাই করা হয় মূলত কতজন মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে, সময়মতো চিকিৎসা পাচ্ছে কিনা, চিকিৎসার ব্যয় ও মান কেমন এবং আরও উন্নত ও বৈষম্যহীন সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে কিনা এসবের ওপর ভিত্তি করে।

স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আর্থিক বিপর্যয় এড়াতে উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা স্কিম চালু আছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আছে একটি জটিল ঘরানার মাল্টি-পেয়ার তথা বহুপক্ষীয় প্রদানকারী ব্যবস্থা। অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও কয়েক দশক ধরে চলছে সিঙ্গেল-পেয়ার কিংবা দুয়ে মিলে হাইব্রিড সিস্টেম।

আর এ ধরনের কয়েকটি চলমান ব্যবস্থা নিয়ে একটি গঠনমূলক আলোচনা করা হলে হয়তো সেটা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি যুৎসই কৌশল ঠিক করে ইউএইচসি লক্ষ্য অর্জন করতে নীতিনির্ধারকদের পথ দেখাবে।

সিঙ্গেল-পেয়ার সিস্টেম কীভাবে কাজ করে?

সিঙ্গেল-পেয়ার তথা একপক্ষীয় প্রদানকারী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত খরচ বহন করে সরকার। এ অর্থের যোগান আসে কর থেকে। প্রতিটি দেশেই তাদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে এই সিঙ্গেল-পেয়ার সিস্টেমটাকে সাজানো হয়েছে।

সিঙ্গেল-পেয়ার সিস্টেম ও ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজকে অনেক সময় প্রায় সমার্থক বিবেচনা করা হলেও দুটো এক নয়। সিঙ্গেল-পেয়ার সিস্টেম ছাড়াও ইউএইচসি অর্জন করা সম্ভব।

বিশ্বের ১৭টি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এখন সিঙ্গেল-পেয়ার সিস্টেম চালু আছে। দেশগুলো হলো—  নরওয়ে, জাপান, যুক্তরাজ্য, কুয়েত, সুইডেন, বাহরাইন, ব্রুনাই, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, স্লোভেনিয়া, ইতালি, পর্তুগাল, সাইপ্রাস, স্পেন ও আইসল্যান্ড।

যেহেতু জনগণের স্বাস্থ্যসেবার খরচ সরকার বহন করছে, তাই যাবতীয় খরচ ও সুবিধার আদর্শ মান ঠিক করার ক্রয়ক্ষমতাও আছে সরকারের। জাতীয় নেটওয়ার্কে থাকা সেবা প্রদানকারীদের যাবতীয় সেবা ও খরচের নিয়ন্ত্রণও করে সরকার।

এই ব্যবস্থার প্রশাসনিক খরচও কম, কারণ এখানে সরকার এমন একটি মূল্য পরিশোধ করে যা উৎপাদন মূল্যের কাছাকাছি থাকে। এতে করে আউট-অব-পকেট তথা ওওপি খরচটাও কমে আসে কিংবা একেবারে থাকেই না। এতে করে কাউকে দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে গিয়ে নিঃস্ব হতে হয় না।

এই ব্যবস্থার বিরোধিতাকারীদের যুক্তি হলো, এই ব্যবস্থায় সেবা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। আবার অনেক সময় সেবা পুরোপুরি পাওয়া না-ও যেতে পারে। এমনকি এ ব্যবস্থা জড়িয়ে যেতে পারে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়, যা নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দেবে ট্যাক্স।

একটি দুই স্তর ব্যবস্থা

এমন একটি ইউএইচসি অর্জন করা সম্ভব যেখানে সিঙ্গেল-পেয়ার ব্যবস্থায় মৌলিক স্বাস্থ্যসেবাগুলো দেবে সরকার এবং যারা সামর্থবান তারা বেসরকারি কাভারেজ ব্যবস্থা নেবে। কানাডা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপানসহ আরও কিছু দেশে এই ব্যবস্থা আছে।

জার্মানিতে ইউএইচসি আছে দুটো ব্যবস্থায়— স্ট্যাচুটারি হেলথ ইন্সুরেন্স সিস্টেম (এসএইচআইএস) ও প্রাইভেট হেলথ ইন্সুরেন্স (পিএইচআই)। এসএইচআই হলো একটি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা যেখানে ১০০টিরও বেশি অলাভজনক স্বাস্থ্য বিমা প্ল্যান রয়েছে, যেগুলো বেরসকারি তত্ত্বাবধানে ‘সিকনেস ফান্ড’ পরিচালনা করছে। এই তহবিলে কর্মী ও নিয়োগকর্তারা সমানভাবে অর্থের যোগান দেয়, সঙ্গে থাকে আয়কর রেয়াত সুবিধা। দেশটি আবার জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মেডিক্যাল টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি রয়েছে।

জাপানেও আছে একই ধরনের স্ট্যাচুটারি হেলথ ইন্সুরেন্স সিস্টেম তথা এসএইচআইএস। দেশটির ৯৮ শতাংশ জনসংখ্যাই এর আওতায় আছে। সেখানকার বাসিন্দারাও প্রায় হাজারখানেক হেলথ ইন্সুরেন্স প্ল্যান থেকে প্রিমিয়াম পরিশোধের মাধ্যমে যেকোনও একটি বেছে নিতে বাধ্য। দেশটিতে আবার সাপ্লিমেন্টাল বেরসকারি বিমাও রয়েছে।

২০১১ সালে দুটো সরকারি বিমা প্ল্যানের মাধ্যমে ইউএইচসি অর্জন করেছে চীন। একটি হলো শহরের চাকরিজীবীদের জন্য, আরেকটি হলো গ্রামীণ জনগণ ও শহরের বাসিন্দাদের স্কিমের একীভূতকরণ— যার আওতায় আছে কর্মহীন নাগরিক কিংবা স্ব-নিয়োজিত ব্যক্তিরা। দ্বিতীয় সারিতে শিশুরাও আছে। এক দিক দিয়ে চীন ব্যতিক্রম, তা হলো— দেশটির ৯৫ শতাংশ নাগরিক ইউএইচসি’র আওতায় এলেও সেখানকার আউট-অব-পকেট খরচটা বেশিই রয়ে গেছে। ২০১৮ সালে যা ছিল মোট স্বাস্থ্য-ব্যয়ের ২৮ শতাংশ।

দেশটির স্বাস্থ্য ও অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থাটি একাধিক প্রোগ্রামের আওতাধীন।

চীনের সরকারও দেশটিতে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়াতে মেডিক্যালে শিক্ষার্থীদের পড়তে উৎসাহ যোগাচ্ছে। দেশটির সবকটি মেডিক্যাল স্কুলই সরকারি এবং মেডিক্যাল পড়াশোনায় ব্যাপক হারে ভর্তুকি দেওয়া হয়। চীনের গ্রামগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতেও শিক্ষার্থীদের উচ্চহারে টিউশন ফি মওকুফ করা হয়। কারও কারও জন্য ভর্তির যোগ্যতাও শিথিল করা হয়। এই ব্যবস্থায় যেসব মেডিক্যাল শিক্ষার্থী থাকবে, তাদেরকে অবশ্যই গ্রাজুয়েশনের পর গ্রাম কিংবা প্রান্তিক এলাকাগুলোতে কমপক্ষে ছয় বছর কাজ করতে হবে।

দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্যসেবাও ইউনিভার্সাল এবং বিশ্বের সেরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে একটি। এ দেশে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মানে কোনও পার্থক্য নেই। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে না হলেও এটি ব্যয়বহুল নয়। এ খাতে সরকারের ভর্তুকির পাশাপাশি তামাক কোম্পানির কাছ থেকে আদায় করা সারচার্জ ও চাকরিজীবীদের করের টাকা যায় ন্যাশনাল হেলথ ইন্সুরেন্স প্ল্যান-এ। নাগরিকদেরও প্রতিমাসে তাদের আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ পরিশোধ করতে হয় এই জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা পরিকল্পনায়। পাশাপাশি বেসরকারি বিমাও আছে। দুটো পলিসির খরচও প্রায় এক এবং যাবতীয় খরচের বিপরীতে নাগরিকদের পরিশোধ করতে হয় মাত্র ২০ শতাংশ।

ফ্রান্সের ইউএইচসি সরকারের অধীনে। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে ওওপি খরচও সরকার পরে পরিশোধ করে দেয়।

বাধ্যতামূলক বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমার মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডের ইউএইচসি চালু আছে। নেদারল্যান্ডসের নাগরিকদের মৌলিক একটি বিমা ক্রয় করতে হয়। তা না করলে তাদের জরিমানাও গুনতে হয়। চিকিৎসাসেবায় বেশ এগিয়ে আছে লুক্সেমবার্গ। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রযুক্তিতেও এগিয়ে তারা।

নাগরিকদের সুস্বাস্থ্যের দৌড়ে এ দেশগুলো আছে সবার ওপরে।

থাইল্যান্ডে জনগণের একটি বড় অংশ বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত হলেও তারা একটি জাতীয় স্বাস্থ্য বিমার পরিকল্পনা করতে পেরেছে, যা কিনা তিনটি পৃথক স্কিমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।

স্কিমগুলো মৌলিকভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে একই খরচে একই সেবা প্রদান করে থাকলেও এগুলো আলাদাভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তাদের লক্ষ্য হলো সকল সুবিধাভোগীর জন্য সমান সেবা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যের প্রাথমিক রক্ষাকবচ হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, চিকিৎসা নিয়ে প্রাথমিক মাথাপিছু ব্যয়ে সীমারেখা টানা ও ওষুধ ও মেডিক্যাল সেবাগুলোর খরচ নিয়ন্ত্রণ করা।

ভারতের স্বাস্থ্যসেবার তহবিল প্রায়ই বেশ কম দেখা যায় এবং দেশটি তার জিডিপির মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ স্বাস্থ্যে ব্যয় করে। ভারতের সরকারি বিভিন্ন স্বাস্থ্য-বিমা স্কিমের মধ্যে ২০০৮ সালে চালু হয় ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা’। স্বল্প আয়ের লোকদের চিকিৎসা খরচের বোঝা হালকা করতেই চালু হয় এ ব্যবস্থা। ২০১৬ সাল নাগাদ দেশটির ৪ কোটি ১০ লাখ মানুষ বিমার আওতায় আসে। তবে তাদের ওওপি খরচ কিন্তু উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি।

৩৭ শতাংশ ভারতীয় এখন কোনও না কোনও বিমার আওতায় আছে। তথাপি, ২০১৮ সাল নাগাদ দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত স্বাস্থ্য উদ্যোগ ‘পিএম-জয়’ (প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা) হলো ইউএইচসি অর্জনে দেশটির এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া, যে বিমা-উদ্যোগের আওতায় ভারতের স্বল্প আয়ের ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এসেছে। এ উদ্যোগের আওতায় দেশটি তাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ঢেলে সাজাতে শুরু করেছে।

প্রসঙ্গ সিঙ্গাপুর ও নৈতিকতার সংকট

নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে প্রকাশিত দৈবচয়নের ভিত্তিতে করা একটি গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য বিমা কাভারেজের পরিসর বাড়ানোর পর দুই বছরে জরুরি বিভাগে রোগীর সংখ্যা বেড়েছিল ৪০ শতাংশ।

এদিক দিয়ে সিঙ্গাপুর ব্যতিক্রম। স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সময় নাগরিকদের নৈতিকতার কথা মাথায় রাখতে বলে দেশটির সরকার। সিঙ্গাপুর তার জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যয় করছে স্বাস্থ্যসেবায় এবং এরইমধ্যে মেডিসেইভ, মেডিফান্ড ও মেডিশিল্ড সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তারা ইউএইচসি অর্জন করেছে।

সিঙ্গাপুরের সব নাগরিককেই বাধ্যতামূলকভাবে তাদের আয়ের ৪ শতাংশ থেকে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত দিতে হয় মেডিসেইভ নামের হেলথ সেভিংস একাউন্টে। মেডিসেইভের টাকা শুধু স্বাস্থ্যসেবা বাবদ ব্যয় করা যাবে। এই অর্থের ওপর কর নেই, উপরন্তু মুনাফা পাওয়া যায় এবং উত্তরাধিকার সূত্রে এ তহবিলের মালিকানাও পাওয়া যায়।

এখানে নৈতিকতার সংকটটি দেখা দেয় তখনই, যখন নাগরিকরা এটা বুঝতে পারে যে, এ তহবিল ব্যবহার করা মানে নিজের কষ্টার্জিত অর্থই খরচ করা, বিমার টাকা নয়।

মেডিশিল্ড হলো একটি সহজসাধ্য মেডিক্যাল ইন্সুরেন্স স্কিম, যেটা মেডিসেইভ হিসাবধারীদের বড় অঙ্কের বিল পরিশোধে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির বয়স বা স্বাস্থ্যের অবস্থা যেমনই হোক না কেন, এই ব্যয় নির্বাহ করবে দেশটির সেন্ট্রাল প্রভিডেন্ট ফান্ড বোর্ড।

অপরদিকে মেডিফান্ড হলো অনুদান নির্ভর তহবিল। সিঙ্গাপুরের দরিদ্রদের জন্য সরকার এই তহবিল প্রতিষ্ঠা করেছে। এই তহবিল থেকে আসা সুদ-মুনাফাও চলে যায় হাসপাতালগুলোর কাছে, যা দিয়ে তারা স্থানীয় কমিউনিটিকে সেরা মানের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে।

চিকিৎসার সমাজতন্ত্রকরণ

যুক্তরাজ্য তাদের ইউএইচসি অর্জন করেছে সিঙ্গেল-পেয়ার ব্যবস্থাকে সঙ্গে নিয়ে। এই চিকিৎসা ব্যবস্থা বাস্তবিক অর্থেই সমাজতান্ত্রিক, যে ব্যবস্থায় যাবতীয় হাসপাতালের মালিকানা সরকারের অধীনে। সরকারই সেখানে স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেয়, চিকিৎসার খরচ যোগায় এবং ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে। আয়কর থেকে গঠিত তহবিলের মাধ্যমে এ ব্যবস্থাটির কাভারেজ ব্যাপক এবং বেশিরভাগ সেবাই নাগরিকদের বিনামূল্যে দেওয়া হয়।

ব্যবস্থাটি মূলত গড়ে উঠেছে তিনটি গাইডলাইনের ওপর ভিত্তি করে—প্রথমত, সবার চাহিদাই পূরণ হবে, সেবা দেওয়া হবে বিনামূল্যে এবং সেবা প্রদান নির্ভর করবে চিকিৎসা চাহিদার ওপর, ব্যক্তির সামর্থ্যের ওপর নয়।

যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা অবশ্য চাইলে বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমাও ক্রয় করতে পারেন। এটা রাখা হয়েছে যাতে কেউ চাইলে বেসরকারি হাসপাতালে নিজের পছন্দমতো কোনও চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন বা অপেক্ষার তালিকায় না থেকে দ্রুত সেবা পেতে পারেন। তবে মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেসরকারি বিমাগ্রহীতা আছে মাত্র ১০ শতাংশ। স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত যাবতীয় খরচের ৮০ ভাগই বহন করে যুক্তরাজ্য সরকার। একই ব্যবস্থা চালু আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্পেন ও হংকংয়ে।

এসব ব্যবস্থার মধ্যে মিল কোথায়?

ইউএইচসি’র সারকথা হলো কাভারেজ নিশ্চিত করা, ওওপি খরচ কমানো, সবার জন্য বৈষম্যহীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা ও সহজে সময়োপযোগী চিকিৎসা দেওয়া। সব উন্নত দেশে সরকারই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। সঙ্গে আছে বেসরকারি বিমা কোম্পানির মাধ্যমে বাড়তি কাভারেজ ও সরকারিভাবে চালু করা বিশেষ বিপর্যয়কালীন তহবিলের সেফটি-নেট।

স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এই দেশগুলোতে অ্যাক্রিডিটেশন ও হেলথ ইনফরমেশন ব্যবস্থাও চালু আছে।

সেবার মান নিশ্চিত করা, রোগীর নিরাপত্তা ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে অ্যাক্রিডিটেশন তথা সরকারি সংস্থার দেওয়া স্বীকৃতির ব্যবস্থা। আর একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে সেবা প্রদানকারীরা তাদের স্বাস্থ্যসেবার বিপরীতে পেমেন্ট দাবি করতে পারেন সহজে। এতে সেবার ডুপ্লিকেশন হয় না এবং স্বচ্ছতাও বজায় থাকে।

ইউএইচসির তহবিল আসে কোথা থেকে?

স্বাস্থ্য বিষয়ক অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ হলো, ইউএইচসি অর্জনে সরকারকে জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ ব্যয় করতে হবে স্বাস্থ্যে। পাবলিক হেলথ-এর যাবতীয় ব্যয় মূলত করদাতাদের টাকা থেকেই আসে। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা চলে সরকারি, বেসরকারি, এনজিও ও উন্নয়ন খাতের যৌথ অর্থায়নে।

সরকারি তহবিল

এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত খরচের তহবিল আসে নানা ধরনের কর থেকে। এখানে প্রদায়কের তালিকায় থাকতে পারে— ব্যক্তিপর্যায়ের আয়কর, সম্পত্তির কর, ভ্যাট, আবগারি শুল্ক, তামাকের ওপর কর, অ্যালকোহলের ওপর আরোপকৃত কর, করপোরেট কর, বাণিজ্য শুল্ক, ওয়েজ আর্নার ট্যাক্স ইত্যাদি। যে দেশগুলো বিশেস করে মেডিকেয়ার সেবা প্রদান করছে তাদের তহবিলের যোগান আসে পেরোল ট্যাক্স থেকে। আর ওটা শুধু স্বাস্থ্যসেবার পেছনেই ব্যয় করা যাবে।

বেসরকারি তহবিল

বেসরকারি তহবিল গঠনে দুই ধরনের উৎস আছে। একটি হলো ওওপি খরচের মতো সরাসরি পরিশোধ— এই ব্যবস্থায় যে দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমের ঘাটতি আছে, সেখানে এই ওওপি সাধারণত বেশ মোটা অঙ্কের হয়। আরেকটা উৎস হলো বেসরকারি কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় বিমার জন্য স্বেচ্ছায় অর্থ পরিশোধ। দ্বিতীয় ব্যবস্থাটি সরকার, এনজিও বা স্থানীয় কমিউনিটির তত্ত্বাবধানেও হতে পারে।

বহিঃ তহবিল

উন্নয়ন সংস্থা, বিদেশি বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স; যেসব ফান্ড সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে প্রবাহিত হয় সেগুলোও ইউএইচসির উৎস। এর বেশিরভাগই খরচ হয়ে থাকে বিভিন্ন পাবলিক প্রোগ্রাম, অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যের মানবসম্পদ উন্নয়নে।

ওওপি খরচ ৭৪ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনতে ২০১২-২০৩২ সাল ব্যাপী একটি ২০ বছরের পরিকল্পনা আছে বাংলাদেশের। স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ ২৬ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে উন্নীত করা এবং সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমের খরচকে ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩২ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি বহিঃ তহবিলের ওপর নির্ভরশীলতাও ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে আনতে চায় সরকার। আর্থিক ঝুঁকির নিরাপত্তার পরিসর বড় করার মাধ্যমে ইউএইচসি অর্জনেই এই কৌশল নেওয়া হয়েছে।

লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ও হেলথ সিস্টেম

/এফএ/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ