X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ও হেলথ সিস্টেম (প্রথম পর্ব)

ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ
০৮ মে ২০২২, ০০:৪২আপডেট : ১৩ মে ২০২২, ১৮:০০

২০৩২ সাল নাগাদ ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ (ইউএইচসি) অর্জন করার অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩ দশমিক ৮-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এ লক্ষ্য নিঃসন্দেহে উচ্চাভিলাষী। বহু দশক ধরে সমাজকল্যাণ সংক্রান্ত পরিস্থিতির ক্রমাগত বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ইউএইচসি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে দেশগুলো স্বেচ্ছায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি শুরু করেছিল, তারা তাদের প্রত্যেক নাগরিককেই বাধ্যতামূলক এ প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্ত করেছে।

প্রতিরোধমূলক, প্রচারমূলক, নিরাময়মূলক, পুনর্বাসনমূলক এবং উপশমকারী স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করে ইউএইচসি। কোনও আর্থিক টানাপোড়েন ছাড়াই এতে পাওয়া যায় সাশ্রয়ী ও মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা। লক্ষ্যটিকে অবশ্যই চলমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলনীতির সঙ্গে একীভূত হতে হবে, যেখানে কিনা সাধারণ মানুষেরা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা ও জরুরি ওষুধ পাবে। এই খরচটাও থাকবে হাতের নাগালে এবং একটি বৃহৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অংশ হিসেবে প্রশাসনের কাছে এই পদ্ধতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের জবাবদিহিও থাকবে।

ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার কী? এটি অর্জনে মূল উপাদানগুলো কী?

একটি পরিস্থিতি কল্পনা করুন—একটি মধ্যম আয়ের পরিবারের মূল উপার্জনকারী ব্যক্তিটি হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় একেবারে মুমূর্ষু অবস্থায় চলে গেলেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে এমআরআই, অস্ত্রোপচার, পোস্ট-অপারেটিভ কেয়ার ও পুনর্বাসনসহ সব মিলিয়ে পরিবারটির ওপর চেপে বসে খরচে সুবিশাল বোঝা। চিকিৎসার খরচ মেটাতে পরিবারটিকে একে একে সম্পত্তিও বিক্রি করতে হয়। মানুষকে এ ধরনের পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচানোই মূলত ইউএইচসির লক্ষ্য।

ইউএইচসির মূলনীতি হলো সরাসরি ‘আউট-অব-পকেট’ খরচ কমানো। যাকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে ওওপি। খরচ কমানোর পাশাপাশি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবার পরিসর আরও উন্মুক্ত করাও এর নীতি।

ওওপি হলো চিকিৎসা-ব্যয়ের একটি অংশ, যা চিকিৎসাধীন ব্যক্তি বা তার পরিবারের সঞ্চয় থেকে মেটানো হয়। যেসব দেশে স্বাস্থ্যবিমা বড় আকারে চালু আছে, সেখানে সেখানে ওওপি হলো উপকারভোগীর আয়ের একটি অংশ, যা তিনি আর ফেরত পাবেন না। এটার আরেক নাম ডিডাকটিবলস বা কো-পেমেন্ট।

বাংলাদেশে এমন কোনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা বা বিমার স্কিম চালু নেই। এখানকার ওওপি’র প্রাথমিক খরচটা হলো মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৪ শতাংশ। এই পরিমাণটা নিঃসন্দেহে বেশ বড়, যেখানে ভারতে ওওপি হলো ৫৪.৭৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৩.৮১ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৩৪.৫৭ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৪২.৯৫ শতাংশ ও থাইল্যান্ডে ৮.৬৭ শতাংশ।

এই বিপুল পরিমাণ ওওপি খরচের কারণে চিকিৎসাসেবার ব্যয় মেটাতে দরিদ্র পরিবারগুলোকে টাকা ধার করতে হয়, সম্পদ বিক্রি করতে হয়, সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিতে হয়। এই ব্যাপারটাকে বলে রেট্রোগ্রেসিভ—অর্থাৎ এতে কম আয়ের মানুষ আরও দারিদ্র্যের দিকে যায়। এমনকি এ কারণে অনেক আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারকেও দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা বা পেলিয়েটিভ কেয়ারের জন্য সম্পত্তি বিক্রি বা ঋণ নিতে হয়। একটি দরিদ্রপন্থী নীতি এবং নগর সুরক্ষা প্রকল্প এই ধরনের আর্থিক বোঝা অনেকাংশে কমিয়ে দিতে পারে।

ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার অর্জনের মূল ভিত্তি হলো স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সময় যেন সরাসরি ব্যয়ের বোঝা এড়ানো যায়। এটি সম্ভব হতে পারে একটি স্বাস্থ্যবিমা স্কিম ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে।

তবে খরচকে নিয়ন্ত্রণ করার যত চেষ্টাই করা হোক, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা বেড়ে চলার কারণে স্বাস্থ্যসেবার খরচও বেড়ে চলেছে। খরচ বৃদ্ধির কারণের তালিকায় আরও আছে দামি প্রযুক্তি, চিকিৎসা সংক্রান্ত পণ্য ও সেবার আধুনিকায়ন এবং এই খাতে নানা অংশীজনের অন্তর্ভুক্তি।

আধুনিক রাষ্ট্রচালিত স্বাস্থ্যবিমা, বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা বা ‍দুয়ে মিলে হাইব্রিড ব্যবস্থা থাকা দেশগুলোতেও স্বাস্থ্যসেবার খরচটাকে সাধ্যের মধ্যে রাখতে ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্যে যেতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্যসেবায় চলমান পেমেন্ট সিস্টেমগুলো কেমন?

যেসব দেশে ইউএইচসি ব্যবস্থাটা ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত, সেসব দেশে নানা ধরনের একক-প্রদানকারী তথা সিঙ্গেল-পেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণত স্বাস্থ্যসেবার প্রদত্ত অর্থটা জনগণের তরফ থেকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে পরিশোধ করে সরকার। আর ওই অর্থটা আসে মূলত করদাতাদের কাছ থেকেই। যেখান থেকে স্বাস্থ্য খাতের জন্য তহবিল রাখা হয়। ইউএইচসির এটাই সর্বজনস্বীকৃত পন্থা, যেখানে প্রত্যেকেরেই একটি মানসম্পন্ন সেবায় প্রবেশাধিকার রয়েছে—খরচ নিয়ে কোনও ধরনের দুশ্চিন্তা ছাড়াই। 

‘অসুস্থতার তহবিল’ নামের একটি ব্যবস্থা আছে যা কিনা অলাভজনক স্বাস্থ্যবিমা করাটা অনেকটা বাধ্যতামূলক ও সেটা বেসরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে বেতনভোগী ও চাকরিদাতারা তাদের আয়ের অংশ দিয়েই এই তহবিল গড়ে তোলেন এবং সেখানে সরকারও একটি অংশ ভর্তুকি দেয়।

মাল্টি-পেয়ার তথা বহু-প্রদানকারী পদ্ধতি হলো বিভিন্ন পেমেন্ট মেথডের মিশ্রণ। সরকারি সিঙ্গেল-পেয়ার ব্যবস্থার পাশাপাশি থাকে তৃতীয় পক্ষের বেসরকারি ইনশিওরার ও হেলথ ইন্সুরেন্স এক্সচেঞ্জ। এক্ষেত্রে মুক্তবাজারে বেসরকারি ইন্সুরেন্স কোম্পানিগুলোকে প্রতিযোগিতা করতে হয়। ওরা তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরিদাতাদের কাছে নিজেদের নানা প্রস্তাব তুলে ধরে। আর ওই প্রতিষ্ঠানই তখন তার কর্মীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যয়ভার গ্রহণ করে। এই ব্যবস্থাটি এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ, নিত্যনতুন সেবা ও উচ্চমান সম্পন্ন সেবার প্রসারে কাজ করে।

এরপরই আসে ওওপির খরচের প্রসঙ্গ। যেসব রাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তার কোনও স্কিম চালু নেই, সেখানে এই আউট-অব-পকেট তথা ওওপি ব্যবস্থাই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

আবার, যেসব দেশে স্বাস্থ্যবিমা চালু আছে, সেখানেও ওওপি ব্যবস্থা আছে, যেখানে উপকারভোগীরা বড় পরিসরে স্বাস্থ্যসেবার খরচ মেটাতে বাড়তি খরচ ও কো-পেমেন্ট পরিশোধ করে। ওওপি হলো মূলত স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক ব্যবস্থার একটি সূচক। এটা যদি খুব বেশি হয়, তবে লোকজন স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার প্রতি অনীহা প্রকাশ করে; আবার এটি যদি সাধ্যের মধ্যে থাকে, তবে স্বাস্থ্যসেবা সবার নাগালেই থাকে।

কোন দেশটির স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সবচেয়ে খরুচে, সেটা কেন?

বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে জটিল ও ব্যয়বহুল মাল্টি-পেয়ার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা আছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটি তাদের জিডিপির ১৮ শতাংশ ব্যয় করে স্বাস্থ্যসেবার পেছনে। ২০১৯ সালে যেটা ছিল ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এ বিপুল পরিমাণ খরচ সত্ত্বেও দেশটির শতভাগ জনগণ স্বাস্থ্যসেবার কাভারেজের আওতায় আসেনি, এসেছে ৯১ দশমিক ৪ শতাংশ।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, দেশটিতে ১৯৩০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্যবিমার সূচনা হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের আইডিয়া ছিল জাতীয় স্বাস্থ্যবিমা হবে সিঙ্গেল-পেয়ার ভিত্তিক তথা বিমার টাকা পরিশোধ করবে একটি মাত্র সরকারি সংস্থা। কিন্তু তাতে ভেটো পড়ে দুটো কারণে—প্রথমত, কর বেড়ে যাওয়ার ভয় ও দ্বিতীয়ত, সমাজতন্ত্রের একটি ভুল উপসংহারে আসার শঙ্কা (ফলস অ্যানালজি)। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালে প্রণীত হয়েছিল মেডিকেয়ার ও মেডিকএইড নামের দুটো সোশাল ইন্সুরেন্স প্রোগ্রাম। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৬৫ বছর বয়সী বা তদূর্ধ্ব নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে মেডিকেয়ার এবং মেডিকএইড সেবা দিচ্ছে দেশটির স্বল্প আয়ের নাগরিকদের।

মেডিকেয়ার হলো একটি সিঙ্গেল-পেয়ার ব্যবস্থা, যা কর্মী, নিয়োগকর্তা এবং স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের আয়কর থেকে তহবিল গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থায়ন করে। যুক্তরাষ্ট্রের লোকজন আবার এটা আশা করে না যে, অবসরের পর তাদের সন্তানরা তাদের দেখভাল করবে। তাই চাকরিতে থাকা অবস্থাতেই তাদের করের একটি অংশ ও নিয়োগকর্তা থেকে দেওয়া একটি অংশ চলে যায় স্বাস্থ্যসেবার ট্রাস্ট ফান্ড অ্যাকাউন্টে। অ্যাকাউন্ট থাকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ট্রেজারিই ওই অ্যাকাউন্টের ধারক। বয়স ৬৫ পার হলেই উপকারভোগীর জন্য উন্মুক্ত করা হয় ওই তহবিল।

অপরদিকে, কম আয়ের জনগণের জন্য যৌথভাবে মেডিকএইড তহবিলের জোগান দেয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার।

এসবের বাইরে, দেশটির সবচেয়ে বড় সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা হিসেবে আছে ভেটেরানস অ্যাফেয়ার্স-এর অধীনে ভেটেরানস হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ভিএইচএ)। যা প্রতিবছর ৯০ লাখ মার্কিন বয়স্ক নাগরিককে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে।

ভিএইচএ হলো সিঙ্গেল-পেয়ার সিস্টেম, যার তহবিলের জোগান দেয় শুধু কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১৯ সালে এর জন্য বরাদ্দ ছিল ৭৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, মেডিকেয়ার ও মেডিকএইডের আওতায় আছে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭ শতাংশ জনগণ।

কর্মসংস্থারভিত্তিক যে বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো আছে, তাদের আওতায় আছে যুক্তরাষ্ট্রের ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ জনগণ। এদের জন্য কাজ করে বিমার তৃতীয় পক্ষ। আর দেশটিতে এমন বেসরকারি বিমা কোম্পানি আছে সহস্রাধিক। তারা একেক কর্মী ও নিয়োগকর্তাদের জন্য একেক ধরনের পলিসি ডিজাইন করে। তবে এগুলোর ৮০ শতাংশই হলো কর্মীদের জন্য নিয়োগকর্তাদের স্পন্সর করা স্বাস্থ্যবিমা। এই সুবিধাটা কর্মী ও নিয়োগকর্তা উভয়ের করযোগ্য আয়ের বাইরে থাকে এবং এই প্ল্যানের আওতায় আরও অনেক স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যখন এর সুবিধাভোগীরা বাড়তি কো-পেমেন্ট বা ডিডাকটিবলস পরিশোধ করতে সম্মত হয়।

কয়েক দশক ধরে নানা ধরনের সংশোধন করার পরও মেডিকেয়ার ও মেডিকএইড এখনও লাখ লাখ মানুষকে বিমার আওতায় আনতে পারেনি। বারাক ওবামার শাসনামলে এই গ্যাপ পূরণে খসড়া করা হয়েছিল অ্যাফোরডেবল কেয়ার অ্যাক্ট ২০১০-এর। সেই ‘ওবামাকেয়ার’-এর তহবিল এসেছিল রাজ্যগুলোর মেডিকএইড-এর বাড়তি বরাদ্দ, নামিদামি স্বাস্থ্য-বিমার আবগারি শুল্ক, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি থেকে পাওয়া শুল্ক, ব্র্যান্ডেড ওষুধ থেকে পাওয়া কর ইত্যাদি থেকে।

২০১২ সালে দেশটিতে বিমার বাইরে ছিল ৪ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ। ওবামাকেয়ার চালুর পর ২০২০ সালে সংখ্যাটা কমে ২ কোটি ৮০ লাখে দাঁড়ায়।

এই সুবিশাল স্বাস্থ্যসেবা খরচের প্রদায়ক কারা?

চিকিৎসকের মোটা অঙ্কের বেতন, হাসপাতাল সেবার উচ্চ ব্যয়, দামি ওষুধ, স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত প্রশাসনিক খরচ; যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা খাতের খরচ বেড়ে যাওয়ার বড় কয়েকটি কারণ হলো এগুলো। দেশটিতে আবার ফি-ফর-সার্ভিস নামের একটি পলিসিও রয়েছে, যা কিনা মূলত একটি পরিমাণ-নির্ভর পেমেন্ট ব্যবস্থা। এতে করে স্বাস্থ্য খাতের সেবার যত ব্যবহার হবে, আনুপাতিক হারে খরচও তত বাড়তে থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ খাতে উচ্চহারে খরচের যৌক্তিকতা কী?

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা খাতের মধ্যে কেবল ওষুধের পেছনেই খরচ হয়েছিল ৩৭০ বিলিয়ন ডলার। ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের আয়ের ২৫ শতাংশ খরচ করে নতুন ওষুধের গবেষণা ও উন্নয়নে কিংবা প্রচলিত ওষুধের নতুন সংস্করণ বের করার পেছনে। ২০১৯ সালে এ খাতেই খরচ ছিল ৮৩ বিলিয়ন ডলার।

দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ) নামের সংস্থাটিও করদাতাদের বিলিয়ন ডলার খরচ করে নতুন ওষুধ বা মেডিক্যাল যন্ত্র আবিষ্কারের পেছনে। এ ধরনের গবেষণাগুলো বেশি হয় ওষুধ কোম্পানি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এনআইএইচ ও বেসরকারি ফার্মাসিউটিক্যালগুলো থেকে এ গবেষণা বাবদ বরাদ্দ পায়। গত কয়েক দশকে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে এনআইএইচ-এর তুলনায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর বাজেট বেড়েছে দারুণ গতিতে। ২০২০ সালে এ খাতে এনআইএইচ-এর বাজেট ছিল ৪১ বিলিয়ন ডলার, ওষুধ কোম্পানিগুলোর ছিল ৯১ বিলিয়ন ডলার।

গত বিশ বছরে আবিষ্কৃত নতুন ওষুধগুলোর এক-তৃতীয়াংশ তৈরি করেছে ছোটখাটো ও সম্ভাবনাময় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো। ওই কোম্পানিগুলোর আয় তুলনামূলক কম এবং তারা নতুন ওষুধ তৈরির গবেষণার জন্য বড় কোম্পানি ও ভেঞ্চার বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দ পেয়ে থাকে। বড় কোম্পানিগুলো এই ছোট কোম্পানিগুলো কাছ থেকে সেই ফর্মুলা কিনে বাজারজাতের অনুমোদন পাওয়ার আগ পর্যন্ত চালায় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)-এর নিয়মানুযায়ী সাধারণত তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা ক্ষেত্রবিশেষ চারটিরও প্রয়োজন হয়। আবার অনেক সময় ফার্মাসিউটিক্যালগুলোকে এটাও প্রমাণ করতে হয় যে তাদের নতুন ওষুধটি বাজারে থাকা প্রচলিত একই ধরনের ওষুধের চেয়ে আরও বেশি কার্যকর।

ধারণা করা হয় যে গড়ে কোম্পানিগুলো একটি নতুন ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পেছনে ৮০ কোটি থেকে ১৪০ কোটি ডলার ব্যয় করে। আর এর আগে গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করে প্রায় ১০০ কোটি ডলার।

ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর এই গবেষণা ও উন্নয়ন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি মূলত ভবিষ্যতের মুনাফার ওপর ভিত্তি করে চালিত হয়। আর ওই মুনাফা নির্ভর করে ওই ওষুধটি সারা দুনিয়া থেকে কী পরিমাণ আয় করলো, গবেষণা ও উন্নয়নে কতটা খরচ হলো এবং ওষুধের চাহিদা ও যোগান সংক্রান্ত নীতিমালার ওপর। একবার একটি ওষুধ বাজারজাতকরণের অনুমতি পেলে পরবর্তী ২০ বছর ওটার প্যাটেন্ট থাকে উৎপাদনকারী কোম্পানির। এই সময়ে ওষুধটির একচেটিয়া ব্যবসা থাকে ওই কোম্পানির দখলে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারও গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করে এবং মেডিকেয়ার, মেডিকএইড, ভিএইচএস ও অ্যাফোরডেবল কেয়ার অ্যাক্ট-এর জন্য ওষুধ কেনে। এ ওষুধ সরকার কেনে অবসরে যাওয়া ব্যক্তি, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও অল্প আয়ের পরিবারগুলোর জন্য।

সরকারের এমন ওষুধ কেনার ফলে ফার্মাসিউটিক্যালগুলোর যে আয় হয় তাতে তারা নতুন ওষুধ আবিষ্কারে আরও আগ্রহ পায়। আর এটা পরিষ্কার যে, যেহেতু ব্যবসায়িক কৌশলটা হলো ওষুধ উৎপাদনের যাবতীয় খরচ তুলে আনা, তাই, ওষুধের দামও হয় তুলনামূলক বেশি।

অ্যাক্রিডিটেশন (স্বীকৃতি)-এর ভূমিকা কী?

স্বাস্থ্যসেবা খাতে অ্যাক্রিডিটেশন তথা স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এ খাতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় কিছু আদর্শমান নির্ধারণ করে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও স্বীকৃতি পেতে সেই সব আদর্শমান মেনে চলতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু হাসপাতালগুলোর জন্য এমন পাঁচটি বড় মাপের অ্যাক্রিডিটেশন সংস্থা আছে। হাসপাতালগুলো ঠিক করে তারা কোন ধরনের অ্যাক্রিডিটেশন নেবে। স্বীকৃতি নির্ভর করে রোগীর নিরাপত্তা, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও মানোন্নয়নের ওপর। এই ধরনের স্বীকৃতি পেলে প্রতিষ্ঠানের পারফরমেন্সও শক্তিশালী হয়। তবে প্রক্রিয়াটির জন্য দুই-তিন বছর লেগে যায় এবং স্বীকৃতির সনদ ধরে রাখতে কয়েক বছর পর পর এর রিভিউ করতে হয়। এ প্রক্রিয়াতেও খরচ বাড়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধির এটিও একটি কারণ।

যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এই ধরনের অ্যাক্রিডিটেশনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে সরকারের তরফ থেকে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করার কাজটা সহজ হয়। আর এর ফলে প্রতিষ্ঠানও তাদের ক্রমাগত মানোন্নয়নে সচেষ্ট থাকে এবং বরাদ্দ প্রাপ্তির জন্য নিজেদের যোগ্যতা ধরে রাখে।

হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম কি খরচ বাড়ায়?

স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা তথা হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম (এইচআইএস) হলো এমন এক প্রণালি, যার মধ্য দিয়ে মেডিকেয়ার কিংবা কর্মসংস্থার সংক্রান্ত যাবতীয় বিমা দাবির নিষ্পত্তি করা হয়। সেবা প্রদানের প্রমাণ প্রক্রিয়াকরণ করে এটি। অনেক এইচআইএস আবার যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সেন্টার ফর মেডিকেয়ার অ্যান্ড মেডিকএইড (সিএমএস)-এর সঙ্গে যুক্ত থাকে। এতে করে সেবার বিপরীতে সরাসরি অর্থের দাবি করা যায়।  ব্যাপক পরিসরে একটি সমন্বিত এইচআইএস ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে বেশ ব্যয়বহুল।

উপরের আলোচনাটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ও জটিল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিয়ে একটি অগোছালো বিশ্লেষণ, যেখানে রোগী, সেবা প্রদানকারী, অর্থদাতা ও নীতিনির্ধারকরাই হলেন অংশীজন। তাদের মূল চ্যালেঞ্জটা হলো খরচ। এই ক্রমবর্ধমান খরচে লাগাম পরাতে তারা একটি মান-ভিত্তিক পদ্ধতি বেছে নিচ্ছে। এ পদ্ধতিতে সেবা প্রদানকারীদের বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হয়, যাতে তারা তাদের সুবিধাভোগীদের মানসম্পন্ন প্রাথমিক যত্ন নিশ্চিত করে। যার ফলে সুবিধাভোগীদের জন্য দামি হাসপাতাল সেবা, জরুরি সেবা বা বিশেষজ্ঞদের যত্নের প্রয়োজন কমে আসে।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের মতে, সিঙ্গেল-পেয়ার সিস্টেমে— বিশেষ করে ভিএইচএ সেবা প্রদানকারীরাই অন্যদের চেয়ে উপকারভোগীদের বেশি সন্তোষজনক সেবা দিতে পারছে।

এ ধরনের একটি জটিল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা তৈরি করতে আরও বহুদূর যেতে হবে বাংলাদেশকে। তবে বাইরে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা জেনে রাখাও কিন্তু জরুরি।  

লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।

/এফএ/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ